এ বছরটি বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ও রুশ বিপ্লবের রূপকার কমরেড লেনিনের মৃত্যুশতবর্ষ। এই উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে বর্ষব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তারই অঙ্গ হিসাবে ভি আই লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ রচনাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। অনুবাদ সংক্রান্ত যে কোনও মতামত সাদরে গৃহীত হবে।এ বার দশম কিস্তি।
কমিউনই সেই রাজনৈতিক রূপ যা ধ্বংসপ্রাপ্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের স্থান গ্রহণ করতে পারে
জাতীয় ঐক্য গঠন
‘‘কমিউন যে জাতীয় সংগঠনকে বিকশিত করে তোলার সময় পায়নি, তার সংক্ষিপ্ত রূপরেখাটির মধ্যেই স্পষ্ট করে বলা আছে যে, কমিউনকে হতে হবে এমনকি ক্ষুদ্রতম গ্রামেরও রাজনৈতিক রূপ…।’’ কমিউনেরই প্যারিসে ‘জাতীয় প্রতিনিধিমণ্ডলী’-কে নির্বাচিত করার কথা ছিল।
‘‘অল্প কয়েকটি, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ যে কাজগুলি তখনও কেন্দ্রীয় সরকারের ছিল, সেগুলিকে চেপে দেওয়া হত না। ইচ্ছাকৃত মিথ্যা প্রচার করতেই এই চেপে দেওয়ার কথা বলা হত। বরং সে সব কাজের দায়িত্ব দেওয়া হত কমিউনের কর্মচারীদের হাতে, সেই কাজের জন্য যাদের কঠোর জবাবদিহি করতে হত।’’
‘‘জাতীয় ঐক্য ভাঙার কথা ছিল না, বরং কমিউনের সংবিধানের সাহায্যে তা সংগঠিত করা হত। যে রাষ্ট্রক্ষমতা, পরজীবী আঁচিলের মতো জাতির অঙ্গ থেকে উদগত হয়ে সেই জাতির থেকেই স্বতন্ত্র এবং শ্রেষ্ঠতর বলে নিজেকে জাহির করত, তাকে ধ্বংস করার ফলে জাতীয় ঐক্য বাস্তবে মূর্ত হয়ে উঠত। কর্তব্য ছিল, পূর্বতন শাসকের নিছক নিপীড়ক সংস্থাগুলি কেটে বাদ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ন্যায়সঙ্গত কাজগুলিকে সমাজের ওপর প্রাধান্য বিস্তারকারী কর্তৃত্বের কবল থেকে কেড়ে নিয়ে সমাজের দায়িত্বশীল কার্যনির্বাহকদের হাতে তুলে দেওয়া।’’
এখনকার সুবিধাবাদী সোসাল ডেমোক্র্যাটরা মার্ক্সের এইসব বক্তব্যের অর্থ বুঝতে কতখানি ব্যর্থ হয়েছেন– আরও সঠিক ভাবে বলতে গেলে, যা তাঁরা বুঝতে চাননি– তা দলত্যাগী বার্নস্টাইন-এর লেখা ‘সমাজতন্ত্রের মূল সূত্র ও সোসাল ডেমোক্র্যাসির কর্তব্য’ নামক হেরোস্ট্র্যাটাস-মার্কা কুখ্যাত বইতে বেশ স্পষ্টই প্রকাশ পেয়েছে।* উপরে উদ্ধৃত মার্ক্সের অনুচ্ছেদ সম্পর্কে বার্নস্টাইন লিখছেন,
‘‘রাজনৈতিক সারবস্তুর দিক থেকে প্রুধোঁর যুক্তরাষ্ট্রীয়তা (ফেডেরালিজম)-র সঙ্গে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারেই এর সাদৃশ্য সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পায়। … মার্ক্স ও পেটি-বুর্জোয়া প্রুধোঁর মধ্যে (বার্নস্টাইন পেটি-বুর্জোয়া কথাটি উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছিলেন যাতে তা বিদ্রুপের মত শোনায়) অন্যান্য সব বিষয়ে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এই বিষয়ে তাঁদের চিন্তাধারা যথাসম্ভব মিলে যাচ্ছে।’’
বার্নস্টাইন তারপর লিখছেন যে, মিউনিসিপ্যালিটিগুলির প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই বাড়ছে, কিন্তু ‘‘মার্ক্স ও প্রুধোঁ যা কল্পনা করেছেন, আধুনিক রাষ্ট্রগুলির তেমন বিলোপ ও তাদের সংগঠনের সম্পূর্ণ রূপান্তর (প্রাদেশিক বা জেলা পরিষদ থেকে প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় পরিষদ গঠিত হবে, এই প্রাদেশিক বা জেলা পরিষদগুলি আবার কমিউন থেকে প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হবে), যার ফলে জাতীয় প্রতিনিধিত্বের আগেকার সব পদ্ধতিই পুরোপুরি অবলুপ্ত হবে– গণতন্ত্রের প্রথম কাজ সে রকম হবে কি না, এ নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।’’ (বার্নস্টাইন, ‘মূলসূত্র’, জার্মান সংস্করণ, ১৮৯৯, পৃঃ ১৩৪ ও পৃঃ ১৩৬)।
‘‘মার্ক্সের ‘পরজীবী রাষ্ট্রক্ষমতা ধ্বংসে’র মতবাদকে প্রুধোঁর যুক্তরাষ্ট্রীয়তার মতের সাথে এইভাবে গুলিয়ে ফেলা সত্যিই বীভৎস ব্যাপার! কিন্তু এটা কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়, কারণ, সুবিধাবাদীর মাথাতে কখনই ঢোকে না যে, মার্ক্স এখানে আদৌ কেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রীয়তার কথা বলছেন না। বলছেন, সমস্ত বুর্জোয়া দেশে প্রচলিত পুরনো বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের ধ্বংসের কথা।
সুবিধাবাদীর মাথায় ঢোকে শুধু সেইটুকু, যা তিনি তার চারিপাশে পেটি-বুর্জোয়া গতানুগতিকতা ও ‘সংস্কারবাদী’ অচলতার পরিবেশে দেখেন, অর্থাৎ শুধু ‘মিউনিসিপ্যালিটি’! শ্রমিক বিপ্লবের কথাটা ভাবতে পর্যন্ত সুবিধাবাদী ভুলে গেছে।
হাস্যকর ব্যাপারই বটে। কিন্তু লক্ষণীয় যে, এই বিষয়টিতে বার্নস্টাইনের কথার প্রতিবাদ কেউই করেননি। অনেকেই, বিশেষভাবে রুশ লেখাপত্রে প্লেখানভ এবং ইওরোপীয় রচনায় কাউটস্কি, বার্নস্টাইনের যুক্তি বহুবার যথেষ্ট পরিমাণে খণ্ডন করেছেন, কিন্তু বার্নস্টাইন যে মার্ক্সকে এইভাবে বিকৃত করেছেন, সে বিষয়ে এঁদের কেউ কোনও কথা বলেননি।
বিপ্লবীর মতো করে চিন্তা করতে এবং বিপ্লব নিয়ে মাথা ঘামাতে সুবিধাবাদীরা এতটাই ভুলে গেছে যে, ‘যুক্তরাষ্ট্রীয়তা’-র মতবাদ সে মার্ক্সের নামে আরোপ করে এবং নৈরাজ্যবাদের প্রবর্তক প্রুধোঁর সাথে মার্ক্সকে গুলিয়ে ফেলে। আবার কাউটস্কি ও প্লেখানভ যাঁরা নিজেদের গোঁড়া মার্ক্সবাদী বলেন, তাঁরাও এই বিষয়ে নীরব! মার্ক্সবাদ ও নৈরাজ্যবাদের মধ্যে পার্থক্যের বিষয়ে মতামতের চরম অপব্যাখ্যার অন্যতম মূল এইখানেই, যা কাউটস্কিপন্থী ও সুবিধাবাদীদের বৈশিষ্ট্য। আমরা পরে এই সম্পর্কে আলোচনা করব।
কমিউনের অভিজ্ঞতা নিয়ে মার্ক্সের যে বক্তব্য আমরা উপরে উদ্ধৃত করেছি, তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রীয়তার নামগন্ধও নেই। ঠিক যে বিষয়টিতে মার্ক্স, প্রুধোঁর সাথে একমত ছিলেন, সেটি সুবিধাবাদী বার্নস্টাইন দেখতে পাননি। বার্নস্টাইন যে-বিষয়ে মার্ক্স ও প্রুধোঁর মধ্যে মতৈক্য লক্ষ করেছেন, ঠিক সেই বিষয়েই প্রুধোঁর সঙ্গে মার্ক্সের মতবিরোধ ছিল।
প্রুধোঁর সঙ্গে মার্ক্সের মিল এখানে যে, তাঁরা দুজনেই আধুনিক রাষ্ট্রযন্ত্র ‘ধ্বংস করা’র পক্ষে। মার্ক্সবাদ এবং নৈরাজ্যবাদ (প্রুধোঁ ও বাকুনিন উভয়ের)-এর মধ্যে এই মিলটা কাউটস্কিপন্থী কিংবা সুবিধাবাদীরা কেউই দেখতে চায় না, কারণ এই বিষয়ে তারা নিজেরাই মার্ক্সবাদ থেকে বিচ্যুত হয়েছে।
প্রুধোঁ ও বাকুনিন উভয়ের সাথে মার্ক্সের মতপার্থক্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রীয়তার (সর্বহারা শ্রেণির একাধিপত্যের কথা ছেড়ে দেওয়া গেল) প্রশ্নেই। নৈরাজ্যবাদের পেটি-বুর্জোয়া ধারণা থেকে যুক্তিসঙ্গত ভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয়তা একটা নীতি হিসাবে আসে। মার্ক্স ছিলেন কেন্দ্রিকরণবাদী। উপরে মার্ক্সের যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, সেখানেও মার্ক্স কেন্দ্রিকতার ধারণা থেকে একটুও বিচ্যুত হননি। রাষ্ট্র সম্পর্কে যাদের সংকীর্ণ ‘কুসংস্কারাপন্ন বিশ্বাস’ আছে, শুধু তারাই বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের বিনাশকে কেন্দ্রিকতার বিলোপ বলে ভুল করতে পারে।
আচ্ছা, যদি সর্বহারা শ্রেণি ও দরিদ্র কৃষককুল নিজের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা তুলে নেয়, কমিউনের মধ্যে স্বাধীন ভাবে নিজেদের সংগঠিত করে এবং পুঁজির বিরুদ্ধে আঘাত হানতে, পুঁজিপতিদের প্রতিরোধ চূর্ণ করতে এবং রেলপথ, কল-কারখানা, জমি ইত্যাদির মালিকানা ব্যক্তির হাত থেকে নিয়ে গোটা জাতি ও সমাজের হাতে তুলে দিতে তারা যদি সমস্ত কমিউনের কার্যকলাপকে ঐক্যবদ্ধ করে, তা হলে তা কি কেন্দ্রিকতা হবে না? সেটা কি সবচেয়ে সুসঙ্গত গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা হবে না? সেটাই কি সর্বহারা কেন্দ্রিকতা হবে না?
বার্নস্টাইন স্বেচ্ছামূলক কেন্দ্রিকতার সম্ভাবনার কথা ভাবতেই পারেন না। ভাবতেই পারেন না যে, কমিউনগুলি স্বেচ্ছায় একটি জাতিতে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, বুর্জোয়া শাসন ও বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্র ধবংসের উদ্দেশ্যে সর্বহারা শ্রেণির কমিউনগুলি স্বেচ্ছায় ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। সমস্ত কূপমণ্ডূকের মতো বার্নস্টাইনও কেন্দ্রিকতাকে ভাবেন উপর থেকে আসা জিনিস হিসাবে যা কেবলমাত্র আমলাতন্ত্র ও সামরিক চক্রের সাহায্যে চাপিয়ে দেওয়া ও বজায় রাখা সম্ভব।
ভবিষ্যতে তাঁর মতামতের বিকৃতি ঘটার সম্ভাবনা আগে থেকে বুঝেই যেন মার্ক্স এই কথায় বিশেষ জোর দিয়েছিলেন যে, কমিউন জাতীয় ঐক্য ধ্বংস করতে ও কেন্দ্রীয় শক্তির বিলোপ ঘটাতে চেয়েছিল বলে যে অভিযোগ, তা আসলে ইচ্ছাকৃত মিথ্যা প্রচার। বুর্জোয়া, সামরিক, আমলাতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে সচেতন, গণতান্ত্রিক, সর্বহারা শ্রেণির কেন্দ্রিকতাকে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে মার্ক্স ইচ্ছা করেই ‘জাতির ঐক্য সংগঠিত করতে হবে’ কথাটি ব্যবহার করেছেন।
কিন্তু যে শুনবে না তার মতো বধির আর কেউ নেই। এবং আজকের দিনের সোসাল ডেমোক্রেসির সুবিধাবাদীরা রাষ্ট্রক্ষমতা ধ্বংস, পরজীবী আঁচিল কেটে বাদ দেওয়ার কথা শুনতেই চায় না।
পরজীবী রাষ্ট্রের বিলোপ
ইতিপূর্বেই আমরা এই বিষয়ে মার্ক্সের উক্তি উদ্ধৃত করেছি, এখন তাঁর উপস্থাপনাটি সম্পূর্ণ করা প্রয়োজন। মার্ক্স লিখেছেন–
‘‘সাধারণত সমস্ত সম্পূর্ণ নতুন ঐতিহাসিক সৃষ্টির ভাগ্যটা এমনই হয় যে, তার থেকে পুরনো, এমনকি অচল হয়ে পড়া কোনও সামাজিক রূপের সঙ্গে তার সামান্য কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেই এই নতুন সৃষ্টিকে পুরনোটারই প্রতিরূপ বলে ভুল করা হয়। এই যে নতুন কমিউন, যা আধুনিক রাষ্ট্রশক্তিকে ভেঙে ফেলে, তাকেও একই ভাবে মধ্যযুগীয় কমিউনের নতুন জন্ম হিসাবে দেখানো হচ্ছে। …এ যেন ছোট ছোট রাজ্যের মিলিত একটি যুক্তরাষ্ট্র (মন্তেস্কু ও জিরোন্ডিন যেমন মনে করতেন) …এ যেন অতিকেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে পুরনো সংগ্রামেরই একটি বর্ধিত রূপ।
সমাজের যে সমস্ত শক্তিকে শুষে খেয়ে সমাজের গায়ে পরজীবী আঁচিলের মতো এতদিন রাষ্ট্র বেঁচে থেকেছে ও সমাজের স্বাভাবিক গতিকে রুদ্ধ করে চলেছে, কমিউন রাষ্ট্রের গঠনের ফলে সমাজ সেই সমস্ত শক্তি ফিরে পেতে পারত। এই একটি মাত্র কাজের ফলেই ফ্রান্সের পুনরুজ্জীবন শুরু হয়ে যেত।
… কমিউনের সংবিধান গ্রাম্য উৎপাদকদের নিয়ে আসত তাদের জেলার কেন্দ্রীয় শহরগুলির বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের অধীনে। সেখানে শ্রমজীবীদের মধ্যে তারা তাদের স্বার্থের স্বাভাবিক রক্ষকদের খুঁজে পেত। কমিউনের অস্তিত্বটাই জড়িয়ে আছে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের স্বাভাবিক স্বীকৃতির সাথে। কিন্তু অনাবশ্যক হয়ে পড়া রাষ্ট্রশক্তিকে সংযত করার জন্য তার আর প্রয়োজন হত না।’’ (‘ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ’, পূর্বোক্ত ইংরেজি সংস্করণ, পৃঃ ৮১-৬২)
‘‘আধুনিক রাষ্ট্রশক্তিকে ভাঙা’’, এই ‘‘পরজীবী আঁচিল’’-কে ‘‘কেটে বাদ দেওয়া’’ এর ‘‘বিনাশ’’, ‘‘রাষ্ট্রশক্তি তখন অনাবশ্যক’’–কমিউনের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ ও যাচাই করবার সময় মার্ক্স রাষ্ট্র সম্পর্কে এই সব কথা ব্যবহার করেছেন।
পঞ্চাশ বছরের কিছু কম সময় হল এই সব কথা লেখা হয়েছে। অথচ মার্ক্সের সঠিক তত্ত্ব জনসাধারণের গোচরে আনতে হলে আজ যেন প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা করতে হয়। যে বিরাট বিপ্লবের কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে মার্ক্সের জীবন অতিবাহিত হয়েছিল, যে বিপ্লবকে পর্যবেক্ষণ করে মার্ক্স তাঁর সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন, আজ তার পরবর্তী শ্রমিক বিপ্লবের সময় উপস্থিত, ঠিক তখনই মার্ক্সের সেই সিদ্ধান্তকে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
‘‘কমিউনের অর্থ অসংখ্য রূপে দেখা দিয়েছে। বহু জনের স্বার্থ এর মধ্য দিয়ে রূপ পেয়েছে। এর থেকে বোঝা যায় যে, কমিউন ছিল সর্বদিক থেকে নমনীয় একটি রাজনৈতিক রূপ। অন্য দিকে, এর পূর্ববর্তী সমস্ত সরকারের রূপই ছিল মূলত দমন-পীড়নের। এর মূল কারণ, এই কমিউন ছিল মূলত শ্রমিক শ্রেণির নিজস্ব শাসনব্যবস্থা। অপরের শ্রমফল আত্মসাৎ করে যারা ভোগদখল করছে তাদের বিরুদ্ধে উৎপাদক শ্রেণির সংগ্রামের সুনির্দিষ্ট ফল কমিউন। কমিউন অবশেষে আবিষ্কার করেছে সেই রাজনৈতিক অধারটিকে, যার মধ্য দিয়ে শ্রমের অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব হবে। এই সর্বশেষ শর্তটি ছাড়া কমিউনের গঠনতন্ত্র গড়ে ওঠা ছিল অসম্ভব এবং মিথ্যা মরীচিকা।’’
যে রাজনৈতিক রূপের মাধ্যমে সমাজের সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠন সম্ভব হতে পারে, কল্পনাবিলাসী ইউটোপিয়ান সমাজতন্ত্রীরা সেই রূপ ‘আবিষ্কার’ করবার জন্য ব্যস্ত ছিল। নৈরাজ্যবাদীরা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কাঠামোর ধরনের প্রশ্নটিকে একেবারেই উপেক্ষা করেছে। আধুনিক সোসাল-ডেমোক্র্যাট সুবিধাবাদীরা পার্লামেন্টারি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বুর্জোয়া রাজনৈতিক কাঠামোকেই চরম সীমা বলে স্বীকার করে নিয়েছে। তারা মনে করে এই রূপকে অতিক্রম করা সম্ভব নয়। এই ‘বিগ্রহের’ দ্বারে ধর্না দিয়ে তারা কপাল ফাটিয়ে ফেলেছে এবং এইসব কাঠামো ভেঙে ফেলবার প্রত্যেকটি প্রচেষ্টাকে তারা নৈরাজ্যবাদ বলে অপবাদ দিচ্ছে।
সমাজতন্ত্র ও রাজনৈতিক সংগ্রামের সমগ্র ইতিহাস পর্যালোচনা করে মার্ক্স এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, রাষ্ট্র অবলুপ্ত হতে বাধ্য এবং তার অবলুপ্তির মধ্যবর্তী পর্বে (রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্রহীন সমাজব্যবস্থায় উত্তরণ) ‘শাসক শ্রেণি রূপে সংগঠিত সর্বহারা শ্রেণি’ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে। কিন্তু সেই ভবিষ্যৎ স্তরের রাজনৈতিক রূপ ‘আবিষ্কার’ করতে মার্ক্স আত্মনিয়োগ করেননি। ফ্রান্সের ইতিহাস সঠিকভাবে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করার কাজে মার্ক্স নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। ১৮৫১ সালের ঘটনাবলি যে উপসংহারে পৌঁছেছিল, অর্থাৎ বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের বিনাশের অভিমুখে ঘটনাবলির অগ্রগতির আলোচনাতেই মার্ক্স পূর্ণ মনোনিবেশ করেন।
সর্বহারা শ্রেণির বৈপ্লবিক গণআন্দোলন যখন বিস্ফোরণের আকার নিল, সে-আন্দোলন ব্যর্থ এবং ক্ষণকাল মাত্র স্থায়ী হলেও, তার সুস্পষ্ট দুর্বলতা সত্ত্বেও সেই আন্দোলন যে রাষ্ট্র-রূপকে আবিষ্কার করল, মার্ক্স তা পর্যালোচনা করতে আরম্ভ করেন। শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবের ফলে ‘অবশেষে আবিষ্কৃত’ হল রাষ্ট্রের সেই নতুন রূপ যার আধারে শ্রমের অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব।
বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রকে চূর্ণ করবার জন্য সর্বহারা বিপ্লবের প্রথম প্রচেষ্টা কমিউন প্রতিষ্ঠা করা। এই কমিউনই ‘অবশেষে আবিষ্কৃত’ সেই রাজনৈতিক রূপ যা ধবংসপ্রাপ্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের স্থান গ্রহণ করতে পারে এবং অবশ্যই করবে।
আমরা পরে দেখব, ১৯০৫ ও ১৯০৭ সালের রুশ বিপ্লব ভিন্ন পরিস্থিতিতে ও ভিন্ন অবস্থায় কমিউনের কাজকেই এগিয়ে নিয়ে চলেছে এবং মার্ক্সের প্রতিভাদীপ্ত বিশ্লেষণের যথার্থতা প্রমাণ করছে।(চলবে)
* এশিয়া মাইনরে গ্রিক-অধ্যুষিত আইওনিয়াতে বারোটি নগরের মধ্যে একটি ছিল এফেসস। সেখানে আর্তেমিসদেবীর একটি মন্দির ছিল। জনশ্রুতি আছে, গ্রিসে মাকেদনএ পরবর্তী কালের দিগ্বিজয়ী সম্রাট আলেক্সান্দর যেদিন জন্মগ্রহণ করেন, সেইদিন রাত্রিতে হেরোস্ট্র্যাটাস নামক এক ব্যক্তি বিখ্যাত হবার বাসনায় এফেসস-এ আর্তেমিসদেবীর মন্দিরটি পুড়িয়ে দেয়।