ক্ষমতায় আসার পর সংসদে ঢোকার সিঁড়িতে মাথা ঠুকে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এ হল গণতন্ত্রের মন্দির। সেই মন্দিরে সাজানো বিগ্রহ রূপেও গণতন্ত্রের অস্তিত্ব আর রাখছে না বিজেপি সরকার।
সংসদ, বিচারবিভাগ, সরকার– বুর্জোয়া গণতন্ত্রের একদা এই তিনটি বিভাগের স্বতন্ত্র স্বাধীনতা, ক্ষমতা সুনির্দিষ্ট ছিল। একচেটিয়া পুঁজির দাপটের যুগে তা ধীরে ধীরে লুপ্ত হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদি তথা বিজেপি সরকারের হাত ধরে সেই লয়ের গতি আরও বাড়ছে। ১৫ অক্টোবর গুজরাটে আইনমন্ত্রীদের সম্মেলনে দিল্লি থেকে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, সরকার হোক বা সংসদ বা আদালত, এই তিনই সংবিধানরূপী এক মায়ের তিন সন্তান। এই তিনটির মধ্যে বিবাদের কোনও জায়গা সংবিধানের আত্মায় নেই।
‘বিবাদের জায়গা নেই’ বলে প্রধানমন্ত্রী কি বোঝাতে চাইছেন, এগুলির কোনও স্বাধীন সত্তা থাকবে না? অন্তত তাঁর সরকারের কার্যকলাপে তাই তো মনে হয়। এগুলির যতটুকু নিজস্ব স্বাধীন সত্তা আজও অবশিষ্ট রয়েছে, সংসদ, বিচারবিভাগ, প্রশাসনে মাঝে মাঝে কেউ যতটুকু নিরপেক্ষ ভূমিকা নেওয়ার চেষ্টা করেন, সেটুকু ভূমিকাও প্রধানমন্ত্রীর ‘অন্তরাত্মা’ মানে তো! বাস্তবে তো মনে হয় না।
প্রধানমন্ত্রী কথিত ‘সংবিধানের আত্মা’-র অন্যতম হল সংসদ। সেখানে বিরোধী মতের তোয়াক্কা না করে ২০২১-এ বর্ষাকালীন অধিবেশনে মাত্র ১০ মিনিটে ১৪টি বিল পাশ করানোর রেকর্ড করতে পারে কী করে বিজেপি সরকার? বুর্জোয়া তাত্ত্বিকরাও অস্বীকার করতে পারেন না– আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের পরিবেশ হল গণতন্ত্রের প্রাণ। শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে, বিরোধী সদস্যদের আলোচনার দাবিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কৌশলে আইন পাস করিয়ে নেওয়ার যে নজির সংসদে রচিত হয়ে চলেছে তা গণতন্ত্রের পক্ষে বড় বিপদ। গণতন্ত্রের ধারণায় সংসদ, বিধানসভা বিরোধীপক্ষের জন্যই। অথচ আজ সংসদে আলোচনার পরিস্থিতিই নেই। সংসদীয় কমিটিগুলিও ঠুঁটো জগন্নাথ। বিরোধীরা যে ক’টি কমিটির শীর্ষে ছিল, তাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এমনকি সংসদকে এড়িয়ে সরকার নানা জনবিরোধী পদক্ষেপ নিচ্ছে।
বিচারব্যবস্থাকেও সরকার এবং আমলাতন্ত্রের আজ্ঞাবহ করে তুলতে চেষ্টার শেষ নেই। বিচারব্যবস্থাকে পুরোপুরি সরকার-নির্ভর করে তুলতে চাইছে বিজেপি। বিচারপতি নিয়োগে সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ ঘটছে। কলেজিয়াম ব্যবস্থায় বিচারপতি নিয়োগে যতটুকু স্বচ্ছতা ছিল, তার বিরুদ্ধে বারবার বিষোদগার করছেন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরেণ রিজিজু, যা আসলে বিজেপিরই গোপন অ্যাজেন্ডা। বিচারকের অভাবে কয়েক কোটি মামলা ঝুলে থাকলেও বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে সরকারের কোনও তৎপরতা নেই। নিজেদের ‘জো হুজুর’ কাউকে পাওয়া না গেলে বিচারপতি নিয়োগ বন্ধ করছে বা দেরি করিয়ে দিচ্ছে সরকার। মন্ত্রীরা ঠিক করে দিচ্ছেন, দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রিম কোর্ট কোন বিচার করবে, আর কোনটা করবে না। আইনমন্ত্রী বলেছেন, জামিনের আর্জি, তুচ্ছ বিষয়ে জনস্বার্থ মামলা শোনার প্রয়োজন নেই সুপ্রিম কোর্টের। সরকারের সমালোচনা করার অপরাধে একের পর এক সাংবাদিক, সমাজকর্মী, বুদ্ধিজীবীদের বিজেপি সরকার জেলবন্দি করছে। সরকারের চোখ রাঙানিতে নিম্ন আদালত জামিন দিতে ভয় পেয়েছে, এমন ঘটনাও ঘটছে। অবশেষে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টে আসতে হয়েছে সামান্য জামিনের জন্য। এটাই মন্ত্রীমশায়ের গোঁসার কারণ। এই ভাবে বিচারব্যবস্থাকেও মোদি সরকার নিজের সম্প্রসারিত অঙ্গে পরিণত করছে।
বিচারপতি কে এম জোসেফ, বিচারপতি এ এ কুরেশি, বিচারপতি তাহিলরামানি সহ সরকারের বিরুদ্ধে রায় দেওয়া নির্ভীক বিচারপতিদের সঙ্গে সরকার যে ব্যবহার করেছে তা বিচারব্যবস্থাকে সরাসরি নিজের আজ্ঞাবহ করার প্রচেষ্টার বড় উদাহরণ। শুধু তাই নয়, গুজরাটের নারোদা পাটিয়া গণহত্যা মামলায় ৯৭ জন মানুষকে হত্যার দায়ে সাজা পেয়েছিলেন বিজেপির প্রাক্তন মন্ত্রী মায়াবেন কোডনানি। তাঁর শাস্তি সংক্রান্ত মামলায় হাইকোর্টের সাত জন বিচারপতি মামলা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন, একাধিক বিচারপতি প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছেন। শেষে গুজরাট হাইকোর্ট তাঁকে মুক্তি দেয়। হাইকোর্ট বলে, তাঁর বিরুদ্ধে কিছু প্রমাণের চেষ্টাই করেনি গুজরাট পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল ‘সিট’।
কংগ্রেস আমলেও বিচারব্যবস্থাকে সরকারের তাঁবেদারে পরিণত করার চেষ্টা সব সময় হয়েছে। কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন ‘কমিটেড জুডিশিয়ারি’ শব্দবন্ধটি। অর্থাৎ বিচারবিভাগের টিকি বাঁধা থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তাদের হাতে। সব সরকারই সেই পথেই বিচারবিভাগকে বেঁধে রাখতে চেয়েছে। কিন্তু বিজেপি আমলে তা আরও ব্যাপক আকার নিয়েছে।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ধারক বাহক সব দলই কম-বেশি এই অগণতান্ত্রিক ধারা বহন করছে। কেন সংসদের মতো একটা উচ্চতম প্রতিষ্ঠানে এভাবে গণতন্ত্র খর্ব হচ্ছে? পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শুরুর দিকে সংসদে যতটুকু গণতন্ত্রের চর্চা হত, তর্ক-বিতর্ক হত, কেন তার বিলুপ্তি ঘটছে? এর কারণ হল পুঁজির কেন্দ্রীকরণের পথে রাষ্ট্র ক্রমাগত ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠছে। পুঁজি যত কেন্দ্রীভূত হচ্ছে, একচেটিয়া রূপ নিচ্ছে, তত তার আধিপত্যবাদী ক্ষমতা বাড়ছে, তত সে আগ্রাসী হচ্ছে।
বুর্জোয়া ব্যবস্থার প্রথম যুগে যতদিন অবাধ প্রতিযোগিতার সুযোগ ছিল, পুঁজির একচেটিয়া রূপ আসেনি, ততদিন রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও নানা মত, চিন্তার অবাধ প্রকাশ, তর্কবিতর্কের সুযোগ ছিল, সংসদে তার প্রতিফলন ঘটত। কিন্তু পুঁজির একচেটিয়াকরণ ও চূড়ান্ত কেন্দ্রীভবনের ফলে এই অবাধ আলোচনার সুযোগ আর অবশিষ্ট নেই। সংসদ সহ সব প্রতিষ্ঠানে তার ছাপ পড়ছে। সব কিছুই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে মুষ্টিমেয় একচেটিয়া পুঁজিপতি গোষ্ঠীর ইচ্ছায় এবং তাদের প্রভাবিত আমলাতন্ত্রের কঠিন ফাঁসের মাধ্যমে। দেশের আইন-কানুন, বিচারবিভাগ, পুলিশ-প্রশাসন সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে। একচেটিয়া পুঁজিপতি আর রাষ্ট্র সমার্থক হয়ে গেছে। একচেটিয়া পুঁজিপতিরা নির্দেশ দিচ্ছে, রাষ্ট্র– বকলমে সরকার সেগুলি পালন করছে। আসলে সরকার পুঁজিপতিদের লেজুড়বৃত্তি করছে। আর এই একচেটিয়া পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থ পূরণে দেশের জনগণের কণ্ঠরোধ করছে, সমালোচনা তর্ক-বিতর্ককে পদদলিত করছে, গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করছে, সরকারের সমালোচনা করলেই সাংবাদিকদের জামিন অযোগ্য ধারায় আটক করে রাখছে। এমনকী এই একচেটিয়া পুঁজিপতিরা আইনের মাধ্যমে নির্বাচনী বন্ডকে বৈধ করিয়ে রাজনৈতিক দলকে প্রভাবিত করছে। দেখা যাচ্ছে, বন্ডের ৮৫ শতাংশই শাসক দল বিজেপির দখলে। এই একচেটিয়া পুঁজি মালিকরাই কোন দলকে তুলবে, কাকে ফেলবে তা ঠিক করছে। পুঁজির শক্তিই নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণ করায় তা প্রহসনে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতায় কারা বসবে, এমনকী কে মন্ত্রী হবে, কোন দপ্তরের মন্ত্রী হবে, সেটাও এরাই ঠিক করে দেয়। জানা গেছে, পূর্বতন তেলমন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধানের নাম আম্বানিরাই ঠিক করে দিয়েছিল। কংগ্রেস আমলে টু-জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি ফাঁস হতে দেখা গিয়েছিল, অভিযুক্ত টেলিকম মন্ত্রী হিসাবে এ রাজার নাম টাটা গোষ্ঠীর সুপারিশেই এসেছিল।
ফলে পার্লামেন্ট একচেটিয়া পুঁজির দাসত্ব করছে ও প্রশাসন হয়ে উঠেছে বেপরোয়া ভাবে ফ্যাসিস্টিক। পুঁজিবাদ চূড়ান্ত একচেটিয়া রূপ নেওয়ায় দেশের মানুষের নূ্নতম গণতান্ত্রিক অধিকারও দিতে নারাজ। সেজন্য প্রয়োজন হলে সংসদকে রবার স্ট্যাম্পের মতো ব্যবহার করতেও পিছপা নয়। ইউএপিএ সহ সন্ত্রাস দমনকারী নানা আইন, দেশদ্রোহী হিসাবে দাগিয়ে দেওয়ার আইন পাশ করিয়ে বিনা বিচারে বছরের পর বছর আটক করে রাখা হচ্ছে। আসলে সরকার, সংসদ ও বিচারবিভাগকে এক ছাতার তলায় আনতে পারলে রাষ্ট্রের স্বৈরশাসনই আরও পাকাপোক্ত হবে।
আজ পুঁজিবাদের চরম ক্ষয়িষ্ণু যুগ। এই ব্যবস্থার রক্ষক ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বাধীন সরকার তাদের কাজকর্মের বিরোধিতার, প্রশ্ন তোলার বিন্দুমাত্র আভাস পেলেই তা রুখতে খড়গহস্ত। সেজন্য সংসদের মাধ্যমে, বিচারবিভাগের দ্বারা বা পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে জনসাধারণের উপর নিয়ন্ত্রণ জারি করছে। অক্টোপাসের মতো সব দিক থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে দম আটকে তাদের দমন করছে সরকার। জনসাধারণকে ঠিক করতে হবে, তারা শাসকের এই স্বৈরতন্ত্রকে মেনে নেবেন, না কি এর প্রতিবাদ করবেন?