‘তুলসি সরনাম গুলামু হৈ রামকো, জাকো রুচৈ সো কহৈ কছু ওউ।
মাঁগি কৈ খৈবৌ, মসীতকো সোহবো, লৈবোকো একু ন দৈবেকো দোউ।।’ (তুলসি তো রামের প্রসিদ্ধ গোলাম। যার যা রুচি, বলতে পারো যা খুশি। ভিক্ষা মেগে খাবো, আর মসজিদে গিয়ে শোবো। কারও কাছে আমার কিছু পাওয়ারও নেই, কিছু দেওয়ারও নেই।) লিখেছিলেন কবি তুলসীদাস।
ক্লান্ত শরীরে তিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন মসজিদে, আর লিখছেন ‘রামচরিতমানস’! অথচ তাঁর সৃষ্ট কাব্যের নায়ক রামলালার মন্দিরের নাম করেই একদল ভেঙে ফেলেছে ভারতের ৫০০ বছরের প্রাচীন স্থাপত্য বাবরি মসজিদকে! ১৯৯২ থেকে ২০২১, এই ৩০টা বছর ধরে অভিশপ্ত ৬ ডিসেম্বর তারিখটিকে ভারতের শান্তিপ্রিয়, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক বোধ সম্পন্ন মানুষ স্মরণ করেছেন এক অভিশপ্ত দিন হিসাবে। ব্যথায় স্মরণ করেছেন সেদিনের পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডে প্রাণ হারানো হাজারের বেশি মানুষকে। শপথ নিয়েছেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার।
৩০ বছর ধরে বিজেপি নেতারা তাঁদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর হিসাবে এই একটি বিষয়কে বড় করে তুলে ধরেছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওই ভেঙে দেওয়া মসজিদের স্থলে রামমন্দিরের শিলান্যাস অনুষ্ঠানে গিয়ে এটাকেই ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে গর্ব করেছিলেন। তিনি যে সংগঠনের সদস্য, যাদের নীতিতে চলে তাঁর দল বিজেপি– সেই আরএসএস পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করে এসেছে সর্বদা। তাঁদের গুরু গোলওয়ালকর ব্রিটিশের সাথে সহযোগিতা এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়াইকেই স্বাধীনতা সংগ্রাম মনে করতেন। যারা অন্য ধর্মের সাথে যুক্ত প্রাচীন স্থাপত্যকে ভেঙে নিজের ধর্মের বড়াই করে আজকের পৃথিবীতে তাদের সবচেয়ে বড় উদাহরণ আফগানিস্তানের তালিবান। বামিয়ানের বুদ্ধ মূর্তি ভেঙে তারা এমন ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের’ পথই দেখিয়েছিল। ভারতে সংঘ পরিবার-বিজেপি বাবরি মসজিদ ভেঙে সেই পথেই হেঁটেছে। এতে তাদের ভোটবাক্সের লাভ বেড়েছে। আর আঘাত পেয়েছে এই ভারতের সাধারণ মানুষের সামাজিক বন্ধন, পারস্পারিক বিশ্বাস, নানা ধর্ম-নানা বিশ্বাসের মানুষের সম্মানের সাথে পাশাপাশি বাস করার দীর্ঘ দিনের ঐতিহ্য।
বিজেপি আজ কেন্দ্রীয় সরকারের গদিতে। অর্থাৎ ভারতের কোটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থান, জীবন-জীবিকার সুষ্ঠ ব্যস্থা, সকলের কাছে স্বাস্থ্য-শিক্ষা-পানীয় জল পৌঁছে দেওয়া, সুলভে দেশবাসীর জন্য বিদ্যুৎ পাওয়ার ব্যবস্থা করা, আইন-শৃঙ্খলার সামগ্রিক উন্নতি, কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম ইত্যাদির ব্যবস্থা করার কথা তাদেরই। অথচ বিজেপি নেতাদের মুখে এ বিষয়ে শোনা যায় সবচেয়ে কম। কারণ তাঁদের কিছু বলবার নেই। তাই সম্প্রতি দেখা গেল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপির দ্বিতীয় প্রধান নেতা অমিত শাহ উত্তরপ্রদেশে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিলান্যাস করতে গিয়ে শিক্ষা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বিশেষ কথা খরচ করেননি। তিনি জোর গলায় কৃতিত্ব দাবি করেছেন রামমন্দিরের কাজ শুরু করার। বিশ্ববিদ্যালয় গড়াটাকে তিনি বিশেষ কোনও কাজ বলে মনেই করেননি নিশ্চয়! তাদের আর এক মন্ত্রী কেশব প্রসাদ মৌর্য একই লাইনে হেঁটে বলেছেন, বিজেপির আসল কীর্তি এবার দেখা যাবে কাশী আর মথুরায় মন্দির তৈরিতে। অমিত শাহ নিজেও এটা ভাল জানেন বলেই বোধহয় যে প্রকল্পের শিলান্যাস করতে গেছেন তা নিয়ে বেশি কিছু বলা সমীচিন মনে করেননি! যদিও বিশেষ বলবার কিছু ছিলও না। তাঁরা উত্তরপ্রদেশে নিরঙ্কুশ সরকার চালিয়ে পাঁচ বছরে যে রকম ‘উন্নয়ন’ করেছেন তা টের পেয়েছেন অমিত শাহের নিজের দলের এমএলএ সূচি মৌসম চৌধুরি। তিনি ৩ ডিসেম্বর বিজনৌরে নারকেল ফাটিয়ে একটি রাস্তা উদ্বোধন করার চেষ্টা করেছিলেন। নারকেলটি তো ফাটেইনি, রাস্তাই ফেটে খুবলে গেছে। উত্তরপ্রদেশ জুড়ে এটাই উন্নয়নের চেহারা। মানুষের দারিদ্রের নিরিখে ২৯টি রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের মধ্যে উত্তরপ্রদেশ তৃতীয়। বেকারত্বের হারে তার স্থান নবম। আখচাষিদের বকেয়া পাওনায় সমস্ত আখ উৎপাদকারী রাজ্যের মধ্যে প্রথম। সে রাজ্যে মহিলাদের উপর অত্যাচার, ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং হত্যা চার বছরে বেড়েছে ৬৬ শতাংশ। করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় উত্তরপ্রদেশের গঙ্গায় শত শত মানুষের লাশ ভাসিয়ে দিতে হয়েছে, এমনই রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো। ফলে সামনের বিধানসভা ভোটে বিজেপি কী বলবে ভোটারদের কাছে? গদি বাঁচাতে যোগী আদিত্যনাথ থেকে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহের মতো সব জাঁদরেল নেতারা এখন স্মরণ নিয়েছেন তালিবানের। আফগানিস্তানে তালিবান ক্ষমতা দখল করেছে সেই জুজু দেখিয়ে তাঁরা উত্তরপ্রদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষকে ভয় পাওয়াতে চাইছেন। আর তার সাথে রাম মন্দির, কাশী-মথুরার মন্দির তৈরি, তাজমহল ভেঙে শিব মন্দির তৈরির জিগির এই সব নিয়েই তাদের পড়ে থাকতে হচ্ছে। প্রশ্নটা হল, কেন্দ্রীয় সরকার এবং উত্তরপ্রদেশের রাজ্য সরকারের দায়িত্ব কি মন্দির তৈরি? দেশ এবং রাজ্যের মানুষের জীবন-জীবিকা, কর্মসংস্থান, কৃষির উন্নয়ন, আইনশৃঙ্খলা, নারী পুরুষ নির্বিশেষে মানুষের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য-শিক্ষা, পানীয় জল, রাস্তাঘাট ইত্যাদি বিষয়গুলির সুষ্ঠ ব্যবস্থার বদলে সরকারের দায়িত্ব কি হয়েছে এখন মন্দির নির্মাণ?
শুরু থেকেই বিজেপির উত্থানের পথে দেশের মানুষের মূল সমস্যাগুলি নিয়ে প্রচার শোনা গেছে খুবই কম। ১৯৯১ সালে উত্তরপ্রদেশে রাজ্য সরকারি ক্ষমতায় আসার জন্যও তারা কোনও উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেয়নি। জেতার হাতিয়ার ছিল রাম রথ আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। তারপর বাবরি মসজিদ ভেঙে, রামন্দিরের ইটপুজোর হিড়িক তুলে তারা বাড়িয়েছিল সাংসদের সংখ্যা। ২০০২ সালে গুজরাট গণহত্যার মধ্য দিয়ে সে রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর সহযোগী হিসাবে অমিত শাহ গুজরাট রাজ্য তথা নিজের দলের় উপরেও নিরঙ্কুশ আধিপত্য কায়েম শুরু করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে তীব্র ধর্মীয় মেরুকরণ এবং সাম্প্রদায়িক ঘৃণার় রাজনীতিই বিজেপির প্রধান রাজনৈতিক অবলম্বন হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। ভারতের একচেটিয়া পুঁজিপতি গোষ্ঠী দেখে এই সাম্প্রদায়িক বাতাবরণের মধ্যেই সারা দেশের রাজনীতির মূল অ্যাজেন্ডাকে ঠেলে দিতে পারলে তাদের অনেক দিকে লাভ। পুঁজিবাদী শোষণে নিষ্পেষিত খেটে খাওয়া মানুষ যাতে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ না গড়ে তুলতে পারে তার জন্য পুঁজিপতি শ্রেণি চায় তাদের বিভক্ত করতে। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় বিদ্বেষ এ কাজে খুবই কার্যকরী হাতিয়ার।
২০১৪ সালে বিজেপি কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসার আগে যতটুকু বিকাশ-টিকাশ নিয়ে কথা বলত, গদিতে বসার পর তা ক্রমাগত চলে গেছে ভুলে যাওয়া অধ্যায়ে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে পশ্চিমবঙ্গে ভোটে প্রচারে এসে, উত্তরপ্রদেশে নানা সভায় বত্তৃতা দিতে গিয়ে মুসলিম বিদ্বেষ তৈরি করার রাস্তাতেই হেঁটেছেন। সিএএ বিরোধী আন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সমার্থক করে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, পোশাক দেখলেই সন্ত্রাসবাদী চেনা যায়। বিজেপি কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় বসার পর থেকে যুক্তিবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা নিয়ে চলা লেখক, সাংবাদিকদের হত্যা করেছে তাদের ঘনিষ্ঠ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত খুনিরা। বিজেপি মদতে চলা লোকজনই গোরক্ষার অজুহাতে পিটিয়ে মেরেছে শতাধিক মানুষকে। যত দিন যাচ্ছে কার্যত দেখা যাচ্ছে জনজীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়ে সরকারের কিছু বলবারই নেই। এমনকি যে নরেন্দ্র মোদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে চ্যাম্পিয়ান সেজে ‘না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা’ বলে খুব গলার জোর দেখাতেন, সে জোরও চুপসে গেছে রাফাল নিয়ে সঠিক তথ্য ফাঁসের জেরে। ফলে এখন বিজেপি নেতাদের সামনে একটাই পথ মন্দিরের ইট-কাঠ পাথর ধরে ঝুলে পড়া। মন্দির নিয়ে জিগির তোলা এবং সংখ্যালঘু বিদ্বেষকে আরও বাড়ানো। এর মধ্য দিয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে নিজেদের ভোটব্যাঙ্ককে যে করে হোক ধরে রাখার।
বিজেপির এই কাজে সুবিধা করে দিয়েছে তাদের প্রধান বিরোধী বলে পরিচিত কংগ্রেস। তারা একটু অন্য সুরে একই ধরনের ‘নরম’ সাম্প্রদায়িক রাজনীতিই চালিয়ে গেছে। কংগ্রেসই বাবরি মসজিদের তালা খুলে দিয়ে বিতর্ক উস্কে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। বিজেপির মতোই পুঁজিপতি শ্রেণির সেবাদাস হিসাবে কংগ্রেস নেতারাও নানা সময়ে সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কানি দিয়ে গেছে। তাদের নেতারা মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে একই ধরনের ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি করেছেন বারবার। জাতপাতের রাজনীতি করা দলগুলি এমনকি সেকুলার রাজনীতির পক্ষে সওয়াল করা বেশ কিছু দল এমনকি বামপন্থী বলে পরিচিতরাও কখনও সংখ্যাগুরু আবার কখনও সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি করতে গিয়ে এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দিকেই পাল্লা ভারি করেছেন।
এর ফলে ভারতে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও সমাজের নানা স্তরে সাম্প্রদায়িক চিন্তার প্রভাব থেকে গেছে। এমনিতেই স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে কংগ্রেসের আপসকামী অংশের নেতৃবৃন্দ এবং হিন্দুমহাসভা ও মুসলিম লিগের ভূমিকার ফলে ভারতীয় সমাজের গণতন্ত্রীকরণ প্রক্রিয়াটাই সম্পূর্ণ হয়নি। যার সুযোগ বারে বারে নিতে পারছে বিজেপি-আরএসএসের মতো সাম্প্রদায়িক শক্তি।
এ দেশের সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে সাম্প্রদায়িকতা আর ধর্মীয় বিশ্বাস এক বিষয় নয়। বিজেপি, কংগ্রেসের মতো দলগুলি জনজীবনের প্রকৃত সমস্যা থেকে মানুষের চোখ ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য বারবার মানুষকে সাম্প্রদায়িক বিভেদের মধ্যে ফাঁসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেই। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষকে তার অধিকার বুঝে নিতে গেলে লড়তে হবে ধর্ম-বর্ণ-জাতপাত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে। সদ্য বিজয়ী কৃষক আন্দোলন শিক্ষা দিয়েছে কীভাবে মানুষের এই রকম সংগ্রামী ঐক্য অত্যাচারী শাসকদের চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
বাবরি মসজিদ ভাঙার ২৩ দিন পরে ওই ভগ্নস্তুপে দাঁড়িয়ে এক নিষ্ঠাবান হিন্দু, মাধব গোডবোলে, লিখেছিলেন ‘সেদিন আমি আগের মতো রামলালা দর্শন করার ইচ্ছা অনুভব করিনি, প্রসাদও নিতে পারিনি। যদিও আমি একজন ধর্মবিশ্বাসী মানুষ, তবুও …সেদিন অযোধ্যায় আমি কোনও টান অনুভব করিনি। মন থেকে অনুভব করেছি শঠতা, প্রতারণা আর ভয়াবহ হিংসার জোরে তৈরি মন্দিরে আমার দেবতা বাস করতে পারেন না'(আনফিনিশড ইনিংস)।
বিজেপি নেতারা রাম মন্দিরের চূড়াকে যতই আকাশে ঠেকিয়ে দিয়ে নিজেদের গরিমা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করুক, মানুষ বুঝছে, বিজেপি নেতাদের আসল আরাধ্য রামও নয়, ধর্মও নয়। তাদের একমাত্র আরাধ্য ক্ষমতার মসনদ। এ সত্য অনেক চেষ্টাতেও চাপা দেওয়া যাচ্ছে না।