অবশেষে সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ভারতে পৌঁছেছে পাঁচটি রাফাল যুদ্ধবিমান৷ বিগত প্রায় দুই দশকের মধ্যে এটাই ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীতে সবচেয়ে বড় যুদ্ধবিমান কেনাকাটা৷ মোট ৩৬টি বিমান কেনা হয়েছে যদিও ইউপিএ সরকারের আমল থেকে ১২৬টি বিমান কেনার কথা হয়েছিল৷ মেরিগ্রাক এ রাফাল প্রস্তুতকারক সংস্থা দসাউ–এর তত্ত্বাবধানে এগুলি নির্মিত হয়েছে৷ এই যুদ্ধবিমান যার গতি নাকি রকেটের থেকে বেশি৷ বায়ু থেকে বায়ু কিংবা বায়ু থেকে ভূমিতে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের ক্ষেত্রে নাকি এর জুড়ি মেলা ভার৷ বিজেপি নেতাদের দাবি প্রতিবেশি দেশগুলো এর ভয়েই কাঁপতে শুরু করেছে
এবার একটু পূর্ব ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাক৷ বেশ কয়েক বছর আগে এই রাফাল কেনাবেচার প্রক্রিয়া চলাকালীন দুর্নীতি নিয়ে এ দেশের রাজনীতি বেশ সরগরম ছিল৷ এই বিতর্কের সূচনা হয় ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার ফ্রান্স সফরের সময় টানা ৮ বছরের আলোচনা প্রক্রিয়াকে বাতিল করে ১২৬টির পরিবর্তে ৩৬ রাফাল বিমান কেনার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন৷ বিতর্কের সূচনা দুটি দিক থেকে৷ প্রথমত ইউপিএ সরকারের সময়ে চুক্তি হওয়া ১২৬টির দাম যেখানে (১০.২ বিলিয়ন ডলার) ৫৯,০০০ কোটি টাকা ছিল সেখানে মোদি সরকারের কেনা ৩৬টি রাফাল এর দাম স্থির হয়েছে ৮.৭ বিলিয়ন ডলার৷ আগের বার যেখানে বিমান পিছু দাম ছিল ৭০০–৭৫০ কোটি টাকা সেখানে এবার দাম পড়েছে বিমান প্রতি ১৬৬০ কোটি টাকা৷ কোন জাদুবলে বিমান প্রতি দাম ৯০০ কোটি টাকা বেডে গেল তা প্রধানমন্ত্রীই জানেন৷ কিন্তু উত্তর দিতে তো তিনি বাধ্য কারণ টাকাটা যে আম আদমির পকেট থেকেই যাবে
দ্বিতীয়ত ১২৬টি বিমান কেনার জন্য ১০ বছর ধরে যে আলোচনা চলছিল তা রাতারাতি বাতিল হয়ে ৩৬টি বিমান কেনার সিদ্ধান্ত হল একতরফা ভাবে কেন? ‘স্বপ্ন কি সওদাগর’ নরেন্দ্র মোদি প্রত্যেক বিদেশযাত্রায় বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা বিশেষ করে আদানি ও আম্বানি গোষ্ঠীর একাধিক নতুন প্রকল্পের চুক্তি সম্পাদন করেছেন এবং সেটা প্রায় একতরফা ভাবেই৷ এই কাজের মধ্য দিয়ে তিনি শুধু প্রতিরক্ষামন্ত্রীর গুরুত্বকে খাটো করেননি একই সঙ্গে ডিফেন্স অ্যাকুইজিশন কাউন্সিল (DAC)কে গুরুত্বহীন করলেন৷ বিশিষ্ট আইনজীবী ও এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগকারী প্রশান্ত ভূষণের বক্তব্য উল্লেখযোগ্য৷ তিনি বলছেন, ‘বায়ুসেনা কর্তৃপক্ষকে বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বা বায়ুসেনা প্রধান এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, এটা বেআইনি’৷ উত্তরে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, এটা জরুরি ভিত্তিক বিষয় ছিল৷ যদি তাই ধরে নেওয়া হয় তা হলে সিদ্ধান্ত ঘোষণার আগে প্রতিরক্ষামন্ত্রকে বিষয়টি নিয়ে কী আলোচনা হয়েছিল তার বিবরণী কোথাও সংরক্ষণ করা নেই কেন? এই প্রশ্ণের উত্তরে সরকার যে উত্তর দিয়েছে তা যে কতখানি ভ্রান্ত তা বোঝা যায় সুপ্রিম কোর্টে দেওয়া একটি হলফনামায়, যেখানে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের মে মাসে ভারতে ‘নেগোশিয়েটিং টিম’ গঠন করা হয় যে টিম ১১ মাস ধরে ফ্রান্সের সঙ্গে আলোচনা করে ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানায়৷ এখানেই প্রধানমন্ত্রীর ঝুলি থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়ে৷ কারণ তিনি ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে বিমান কেনার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন আর তার পরের মাস থেকে শুরু হল বিমান কেনার আলোচনা এ সমস্ত কিছু প্রমাণ করছে নরেন্দ্র মোদি একতরফা ভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং মুখ বাঁচাতে নেগোশিয়েটিং টিমের নাটক করেছেন৷ রাফাল বিতর্কের ক্ষেত্রে অপর একটি বিষয় হল ফ্রান্সের ‘দাসাউ’ কোম্পানির সহযোগী হিসাবে অর্থাৎ ভারতবর্ষে রাফাল আনা এবং তার রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত দেখভালের দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে না দিয়ে অনিল আম্বানির রিলায়েন্স গোষ্ঠীকে দেওয়া৷ এ প্রশ্ন উঠেছে এবং ওঠাটাই স্বাভাবিক৷ সরকার দায় এডিয়ে গেলেও মোদি যাকে পাশে বসিয়ে বিমান কেনার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন ফ্রান্সের সেই প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলান্দ একেবারে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়ে একটি ফরাসি সরকারি সংবাদপত্রে বলেছেন, ‘আম্বানিদের সাথে না নিয়ে উপায় ছিল না৷ কারণ এই শিল্পপতি মোদিজির একান্ত প্রিয়পাত্র এবং তার নাম নেওয়ার ব্যাপারে মোদি সরকারই বারবার চাপ দিতে থাকে৷’ এর মধ্য দিয়ে বাস্তবে যা ঘটল তা হল ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থা ‘হিন্দুস্থান অ্যারোনেটিক্স লিমিটেড’ (হ্যাল) এর মৃত্যু এবং পাহাডপ্রমাণ পুঁজির মালিক অনিল আম্বানির জমে থাকা পুঁজি ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিতে খাটিয়ে আরও পুঁজি বাড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া৷ এমনও শোনা গিয়েছে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক থেকে অনিল আম্বানির নেওয়া কোটি কোটি টাকার ঋণ মুকুব করেছে ভারত সরকার তথা নরেন্দ্র মোদি৷ আর তারই উপঢৌকন হিসাবে এই ৯০০ কোটি টাকা ঘুরপথে কার পকেটস্থ হবে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ এ তো হল এই সংক্রান্ত একটি দিক৷ আরেকটি সংশয় যা ইতিমধ্যেই বিশেষজ্ঞ মহলে দেখা দিয়েছে তা হল, এই যুদ্ধবিমান ভারতকে কি আদৌ কোনও সুবিধা এনে দেবে? ভারত সরকারের দাবি, এই যুদ্ধবিমান নাকি উত্তর ও পশ্চিম সীমান্তের আকাশ যুদ্ধে একটা ‘গেম ও চেঞ্জারের’ কাজ করবে৷ যদিও সামরিক পর্যবেক্ষকরা অনেকেই মনে করছেন রাফালকে বিমানবাহিনীতে সক্রিয় করতে এখনও বেশ সময় লাগবে এবং এই যুদ্ধবিমান পাকিস্তান বা চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে ঠিক কতটা সুবিধা দিতে পারবে সেটাও স্পষ্ট নয়৷ আর এই বিমান আসা মানেই যে ভারতের বাজিমাত করে ফেলা নয়, এটা মনে করিয়ে দিয়েছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ ও ভারতীয় বিমানবাহিনীর সাবেক মেজর জেনারেল দীপঙ্কর ব্যানার্জী৷ তিনি বলেন, ‘প্রথম কথা, রাফাল আসছে বেশ কম সংখ্যায়৷ তারপর পাইলটদের ড্রেনিং করাতে হবে, ওয়েপনাইজেশন বা অস্ত্রসম্ভার যোগ করতে হবে যেটা বেশ সময় সাপেক্ষ, দ্বিতীয়ত রাফালকে মূলত যেখানে উডতে হবে, হিমালয়ের সেই হাই অল্টিটিডডে সেটাও দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন ও দুরূহ ফ্লাইং এলাকা৷ ফলে এগুলোর ব্যবহার সম্পর্কে ভারতকে বেশ সতর্ক থাকতে হবে৷’ তিনি রাফালকে গেম চেঞ্জারের স্বীকৃতি দিতে নারাজ৷ কারণ এই ধরনের হাই অল্টিটিউড এই বিমানগুলো এখন আর অপরাজেয় নয়৷ আসলে বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষার থেকে পুঁজিবাদের বাজার সংকট থেকে এই ব্যবস্থাকে বাঁচানোটাই আজ সব থেকে বড় তাগিদ শাসকের৷ শুধু ভারত নয় গোটা বিশ্বের পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পডেছে৷ ভোগ্যপণ্যের বাজার প্রায় তলানিতে৷ লক্ষ লক্ষ কলকারখানা বন্ধ, শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে, অন্যান্য ক্ষেত্রেও নিয়োগ বন্ধ৷ ফলে বেকারি দারিদ্র ইত্যাদি কারণে মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানোর মতো ক্রয়ক্ষমতা নেই৷ অন্য দিকে সর্বাধিক শ্রমিক শোষণের ফলে শিল্প পুঁজিপতিদের মুনাফা বাড়ছে৷ সেই অতিরিক্ত পুঁজি খাটানোর শেষ উপায় হল পুঁজির সামরিকীকরণ৷ যেখানে রাষ্ট্রই যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করছে আবার রাষ্ট্রই কিনছে৷ এ ক্ষেত্রে ভারত সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে ভারতের নাম্বার ওয়ান পুঁজিপতি তথা অনিল আম্বানির রিলায়েন্স ডিফেন্স এজেন্টকে বরাত পাইয়ে দিয়ে কোটি কোটি টাকা বিজেপির নির্বাচন–উপঢৌকন আসার পথ পরিষ্কার করে রেখেছে৷ ‘ঘুষ নেহি খাউঙ্গা আউর নেহি দুঙ্গা’র প্রবক্তা মোদিজির গদির বরাত হয়ত তাতে বাড়বে কিন্তু কোটি কোটি বুভুক্ষু ভারতবাসীর চোখের জল আর হাহাকার বাড়বে বই কমবে না৷