বেশি দিনের কথা নয়। নব্বইয়ের দশকেও কেন্দ্র এবং রাজ্য দুই সরকারেরই বার্ষিক বাজেটের কিছু সারবত্তা ছিল। তা নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে আগ্রহ ঔৎসুক্য দেখা যেত। বাজেটে সরকার কী কী পণ্যে কর বসাল, কীসে কর কমাল, শিক্ষায়-স্বাস্থ্যে কত টাকা সরকার ব্যয় করবে, শিল্প-কল-কারখানা কী হবে, কৃষিক্ষেত্র কী পাবে ইত্যাদি বিষয়গুলি দিয়ে হিসেবপত্র চলত সংবাদমাধ্যমে। ক্রমে এসব অতীতের বিষয় হয়ে গেছে। একদিকে লোকসভা-বিধানসভাকে বিরোধীশূন্য করে দেওয়ার তোড়জোড়, শাসকদলের নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা, অন্যদিকে নয়া উদারবাদী আর্থিক নীতির ঢল– দুইয়ে মিলে বাজেটের গুরুত্বই লঘু হয়ে গেছে। পূর্বেকার রীতিতে সরকার কোনও আর্থিক নীতি পরিবর্তন“সংশোধন করার জন্য প্রস্তাব করলে লোকসভায় বিতর্ক হত, তারপর ভোটাভুটি। এখন ওসবের বালাই নেই। গরিষ্ঠতার জোরে শাসক দল পরিবর্তন-সংশোধন ও এমনকী সম্পূর্ণ নতুন প্রস্তাবও হেলায় পাশ করিয়ে নেয়। অন্যদিকে সরকারের আর্থিক নীতি এখন একমুখী। নয়া উদারবাদী আর্থিক জমানায় মুক্ত বাজার হচ্ছে মূলমন্ত্র, যার জোরে পুঁজিপতিদের ও ধনকুবেরদের লাগামছাড়া সুবিধা দেওয়াই সরকারের কাজ। ফলে বাজেটে দেশের জনগণের জন্য কিছু ছিটেফোঁটা প্রতিশ্রুতি দিয়েই জনসেবা শেষ। আর আছে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। এই বিষয়টাই নির্লজ্জতার সকল সীমা ছাড়িয়েছে বিজেপি জমানায়। প্রধানমন্ত্রী এখন মিথ্যা প্রতিশ্রুতির প্রধান হোতা।
এই প্রেক্ষাপটে রাজ্য বাজেটের গুরুত্ব কী আর থাকতে পারে! পশ্চিমবঙ্গে এবার নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ভোটের মুখে সরকার জনগণকে কী দিচ্ছে, সেদিকে ভোটার জনসাধারণের দৃষ্টি বিশেষভাবে নিবদ্ধ থাকবে, তা জেনেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবার বাজেট বত্তৃতা নিজে দেবেন বলে ঘোষণা করে দেন। সরকারের কোনও কাজ বা প্রকল্পকে ‘আমার কাজ’, ‘আমি দিচ্ছি’ বলে বত্তৃতা করাই মমতা ব্যানার্জীর রীতি। শাসক তৃণমূল দলের মুখও তিনি। দাবিও করেন যে, রাজ্যের ২৯৪টি আসনে তিনি তৃণমূল দলের প্রার্থী। তাই ভোটের পূর্বমুহূর্তে সরকারের বাজেট পেশকেই তিনি প্রচারের হাতিয়ার করেছেন। তা করুন, আপত্তি নেই। কিন্তু আছে কী সেখানে?
জবাবে তৃণমূল নেতৃত্ব বলবেন, কী চান, বলুন। সমস্যা এখানেই। ‘নেই’-এর রাজ্যে কোনও মুখ্যমন্ত্রী যদি বিধানসভায় দাঁড়িয়ে শুধু একটির পর একটি নতুন প্রকল্প ঘোষণা করে যান, তখন বাহবার চেয়ে আশঙ্কাই হয় বেশি। যদি হাজার হাজার বেকারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতেই পারেন, পার্শ্বশিক্ষকদের ন্যায্য দাবি মেনেও নেন, রাস্তা-ঘাট-সেতু সবেতেই দরাজ হাতে অর্থ বরাদ্দ করতে পারেন, এমনকি বৃদ্ধদের জন্য পেনশন দেওয়াও সম্ভব হয়, তবে গত দশ বছরে তা করা হল না কেন? মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের জনগণের উদ্দেশে বলেছেন, ‘‘আপনারা আমায় বিশ্বাস দিন, আমি আপনাদের সেবা দেব”। কিন্তু বাস্তব হল, ২০১১ ও ২০১৬ সালে দু’বার বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের জনগণ তো আপনার উপর বিশ্বাস করে ভোট দিয়ে আপনার দলকে জয়ী করেছেন। কিন্তু সেই বিশ্বাসের মর্যাদা কি আপনার দল ও সরকার দিয়েছে? এখন আপনার সরকারের বিরুদ্ধে চুরি-দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের যে ভুরি ভুরি অভিযোগ উঠেছে, তার প্রতিবিধান আপনি করেননি কেন? দলত্যাগী এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আপনি নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন। এতদিন তিনি যখন আপনার মন্ত্রী ছিলেন, তখন ব্যবস্থা নেননি কেন? এ কথা ঠিক, আপনার সরকারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠছে, এ রাজ্যে সিপিএম শাসনে তার সবই হয়েছে। বিজেপির মতো দল তো আগাগোড়াই দুর্নীতিগ্রস্ত, ওদের রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে আচার-আচরণ– কোনও কিছুতেই সুনীতির লেশমাত্র নেই। কেন্দ্রের সরকারে বসে জনগণকে বলি দেওয়ার যে হীন রাজনীতি ওরা চালাচ্ছে, তার তুলনা নেই। কিন্তু বিরোধীরাও দুর্নীতিগ্রস্ত, অসৎ এই যুক্তিতে শাসকের দুর্নীতি ও মিথ্যাচার গ্রহণীয় হতে পারে না। রাজ্যের বাজেট নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, এত নতুন নতুন প্রকল্প ও অর্থদানের ঘোষণা–কিন্তু এত অর্থসংস্থানের সূত্র কোথাও বলা নেই। তা হলে সবটাই কি বিজেপির ২ কোটি চাকরি দেওয়ার মতো ভোটের জুমলা!