এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির বিশিষ্ট সদস্য কমরেড সঞ্জিত বিশ্বাস দীর্ঘদিন ফুসফুসের রোগে অসুস্থ থাকার পর ১৮ নভেম্বর সকাল সাড়ে আটটায় টালা পার্টি সেন্টারে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷ মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর৷
এদিন সকালে হঠাৎই তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন৷ এই সংবাদ পেয়েই কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড ছায়া মুখার্জী, কমরেড স্বপন ঘোষ, কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য, কমরেড অমিতাভ চ্যাটার্জী এবং তরুণ কর্মীরা সেন্টারে ছুটে যান৷
আকস্মিক এই দুঃসংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই পার্টির সর্বস্তরে শোকের ছায়া নেমে আসে৷ রাজ্য, জেলা ও লোকাল অফিসগুলিতে পতাকা অর্ধনমিত করা হয়৷ নেতা–কর্মীরা কালো ব্যাজ ধারণ করেন৷ ওই দিন মরদেহ পিসওয়ার্ল্ডে সংরক্ষণ করা হয়৷ পরদিন ১৯ নভেম্বর প্রথমে মরদেহ অ্যাবেকা অফিসে নিয়ে আসা হয়৷ সেখানে কর্মী এবং শুভানুধ্যায়ীরা মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান৷ তারপর দলের নেতা–কর্মী–সমর্থক শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রক্তপতাকায় সজ্জিত তাঁর মরদেহ বেলা বারোটা থেকে দলের কেন্দ্রীয় অফিসে রাখা হয়৷
তাঁর মরদেহে মাল্যদান করেন সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ, পলিটবুরো সদস্য কমরেড মানিক মুখার্জী, কমরেড অসিত ভট্টাচার্য, কমরেড গোপাল কুণ্ডু, কমরেড সৌমেন বসু এবং রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য সহ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যবৃন্দ৷ ঝাড়খণ্ড রাজ্য সম্পাদক কমরেড রবীন সমাজপতির পক্ষেও মাল্যদান করা হয়৷ মাল্যদান করেন রাজ্য কমিটির সদস্যবৃন্দ, জেলা ও আঞ্চলিক কমিটির প্রতিনিধিরা৷ তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা ও যে সমস্ত সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন তার প্রতিনিধিরাও মাল্যদান করেন৷
কালীঘাটের ওরিয়েন্টাল অ্যাকাডেমিতে পড়াকালীন এআইডিএসও–র নেতা কমরেড ভবেশ গাঙ্গুলীর সাথে তাঁর পরিচয় হয় ছাত্র সংগঠক কমরেড মুকুন্দ ঘোষের মাধ্যমে৷ কালীঘাটের চন্দ্র মণ্ডল লেনের বস্তিতে এক দরিদ্র পরিবারে তিনি বড় হয়েছেন৷ খেলাধূলাতেও তাঁর প্রবল উৎসাহ ছিল৷ খুব ভাল ফুটবল খেলতেন৷ তখনকার ফার্স্ট ডিভিশন টিম ‘ভ্রাতৃসংঘ’–তে জুনিয়র ডিভিশনে নিয়মিত গোলকিপার ছিলেন তিনি৷
১৯৬২–তে আশুতোষ কলেজে প্রি–ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন কমরেড বিশ্বাস৷ আশুতোষ কলেজের ছাত্র সংসদ তখন পরিচালিত হত এআইডিএসও–র নেতৃত্বে৷ সে সময় ছাত্র আন্দোলনের নেতা কমরেড প্রভাস ঘোষ (বর্তমানে পার্টির সাধারণ সম্পাদক) দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন কলেজে ছাত্রের কাছে এআইডিএসও–র সদস্য হওয়ার যে আহ্বান রেখেছিলেন, তাতে সাড়া দিয়ে আরও অনেক ছাত্রদের সাথে কমরেড সঞ্জিত বিশ্বাস এগিয়ে আসেন৷ এ সময়েই মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের বৈপ্লবিক চিন্তাধারার সংস্পর্শে আসেন তিনি৷
আশুতোষ কলেজ তখন এ রাজ্যের ছাত্র আন্দোলনের প্রবাহে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল৷ অন্যান্য কলেজেও এর প্রভাব পড়েছিল৷ আশুতোষ কলেজে কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন দুর্নীতি ও হঠাৎ করে ফি–বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কমরেড ভবেশ গাঙ্গুলীর নেতৃত্বে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে ও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়৷ এই আন্দোলনে জুনিয়র ছাত্রদের মধ্যে কমরেড সঞ্জিত বিশ্বাস ছিলেন অগ্রণী৷ আন্দোলনে ক্ষিপ্ত হয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতিক্রমে বেছে বেছে সাতজন সংগঠককে বহিষ্কার করে, যাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কমরেড সঞ্জিত বিশ্বাস৷ ওই সময়ে ডিএসও সংগঠক কমরেড মুকুন্দ ঘোষ চারুচন্দ্র কলেজে একটি ডিএসও ইউনিট গঠন করেন৷ ১৯৬৪–’৬৫ নাগাদ তাঁর প্রচেষ্টায় চারুচন্দ্র কলেজে স্নাতক স্তরে কমরেড সঞ্জিত বিশ্বাস ভর্তি হন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই ছাত্র–শিক্ষকদের মধ্যে তিনি জনপ্রিয়তা লাভ করেন৷ ’৬৫–’৬৬ সাল নাগাদ তিনি ওই কলেজের ডিএসও পরিচালিত ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক হন৷ বহু সময়ে একাই সেখানে নানারকম বাধা বিপত্তির বিরুদ্ধে তাঁকে লড়তে হয়েছে৷ বহুবার প্রতিপক্ষের হাতে মারও খেয়েছেন, কিন্তু কিছুই তাঁকে দমাতে পারেনি৷ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কলেজ গেটে থেকে ছাত্রদের সাথে যোগাযোগ করতেন৷ তাদের সুখ–দুঃখের খোঁজ রাখতেন৷ চারুচন্দ্র কলেজের পাশে লেক প্লেসের একটি তিনতলার চিলেকোঠা ঘরে যেতেন কমরেড প্রভাস ঘোষ৷ কমরেড সঞ্জিত বিশ্বাস ছাত্রদের সেখানে নিয়ে যেতেন, ছাত্রদের কমরেড প্রভাস ঘোষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেন৷ সেখানে নানা বিষয়ে আলোচনা হত৷ আশুতোষ কলেজ হস্টেলেও কমরেড প্রভাস ঘোষ ছাত্রদের নিয়ে প্রশ্নোত্তর ভিত্তিক ক্লাস করতেন৷ কমরেড সঞ্জিত বিশ্বাস ছাত্রদের সেখানে পাঠাতেন৷
পরবর্তীকালে কলকাতার ছাত্রদের মধ্যে অধিকতর দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে কাজ করতে থাকেন তিনি৷ তিনি ডিএসও–র উত্তর কলকাতা কমিটির সম্পাদক ছিলেন৷ ১৯৭৩ সালে বহরমপুর ও ১৯৭৮ সালে মেদিনীপুরে অনুষ্ঠিত রাজ্য সম্মেলনে দু’বার তিনি এআইডিএসও–র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন৷ শুধু ছাত্র সংগঠন নয়, পার্টির নানা সাংগঠনিক দায়িত্বও তিনি রাজ্য স্তরে ও নানা জেলায় পালন করেছেন৷ পার্টি যখন যে দায়িত্ব দিয়েছে শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও কখনও তা পালনে দ্বিধা করেননি৷ ১৯৭৪ সালে কটকে ডিএসও–র সর্বভারতীয় ছাত্র সম্মেলনের প্রস্তুতির জন্য যে টিম পশ্চিমবঙ্গ থেকে ওখানে গিয়ে কাজ করেছিল, তার নেতৃত্বে ছিলেন কমরেড সঞ্জিত বিশ্বাস৷ পার্টি পরিচালিত সকল গণআন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন৷
নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যুৎচালিত লেদ, ধানকল, গমকল সহ সমস্ত ক্ষুদ্রশিল্পে বিদ্যুতের দাম এক ধাক্কায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়৷ রাজ্য জুড়ে এর বিরুদ্ধে প্রবল অসন্তোষ, ক্ষোভ, বিক্ষোভ দেখা দেয়৷ কমরেড সঞ্জিত বিশ্বাসকে পার্টি এই নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্ব দেয়৷ এর ভিত্তিতে ১৯৯২ সালের ৭ এপ্রিল কলকাতার মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে কমরেড ভবেশ গাঙ্গুলীকে সভাপতি ও কমরেড সঞ্জিত বিশ্বাসকে সম্পাদক করে অল বেঙ্গল ইলেকট্রিসিটি কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন (অ্যাবেকা) গঠিত হয়৷ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন ওয়েস্ট বেঙ্গল ইলেকট্রিসিটি রেগুলেটারি কমিশনের অ্যাডভাইসারি বোর্ডের সদস্য এবং অ্যাবেকার সভাপতি৷ বিদ্যুৎ মাশুল এবং গ্রাহকদের সমস্যা সঠিকভাবে বোঝা ও আইনি নানা বিষয়ে সঠিক রাস্তা দেখানোর ক্ষেত্রে বহু পরিশ্রম করে তিনি দক্ষতা অর্জন করেছিলেন৷ তাঁর নেতৃত্বেই এ রাজ্যে বিদ্যুৎ গ্রাহক আন্দোলন গড়ে ওঠে৷ বহু দাবি আদায় হয়৷ এর মধ্য দিয়েই তিনি বিদ্যুৎ গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করেন, নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন৷
২০০৯ সালে শ্রমিক সংগঠন এআইইউটিইউসি–র রাজ্য কমিটির সদস্য হন তিনি এবং রাজ্য সাব কমিটির কনভেনরও ছিলেন৷ কমরেড সঞ্জিত বিশ্বাস স্বভাবগত ভাবে অত্যন্ত সৎ, পরিশ্রমী, সাহসী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, দায়িত্বশীল ছিলেন৷ জুনিয়র কর্মীদের স্নেহ করতেন, তাদের সঙ্গে কথা বলতে ভালবাসতেন, তাদের খোঁজখবর নিতেন৷ তত্ত্বগত বিষয়েও তাঁর উৎসাহ ছিল৷ পার্টির পত্র–পত্রিকা, বই খুঁটিয়ে পড়তেন৷ দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি পরিবারের জন্য চাকরি করার পথ গ্রহণ না করে কমরেড শিবদাস ঘোষের প্রেরণায় সর্বক্ষণের কর্মীর জীবন গ্রহণ করেন৷
কমরেড সঞ্জিত বিশ্বাস দীর্ঘদিন ফুসফুসের সংক্রমণে আক্রান্ত ছিলেন৷ ২০১৪ সালে গুরুতর অসুস্থ হলে তাঁকে হার্ট ক্লিনিক অ্যান্ড হসপিটালে ভর্তি করতে হয়৷ এরপর কয়েকবার তিনি অত্যন্ত সংকটাপন্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছেন৷ চিকিৎসকদের অক্লান্ত চেষ্টা ও নিজের অদম্য মনোবলে তিনি বেঁচে উঠেছেন৷ এক দফায় টানা তিন মাস তাঁকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল৷ শ্বাসকষ্ট লাঘবের জন্য দীর্ঘ সময় অক্সিজেন কনসেনট্রেটর মেশিনের সাহায্য নিতে হত তাঁকে৷ অসুস্থতার নানা উপসর্গ বাড়ছিলই৷ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মতোই তাঁকে চলতে হত৷ ১৭ নভেম্বর রাতে তাঁর জ্বর হয়, শ্বাসকষ্ট বাড়ে৷ পরদিন সকালে তাঁর অবস্থার অবনতি হয়৷ তাঁকে হার্ট ক্লিনিক অ্যান্ড হসপিটালে ভর্তি করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়৷ ইতিমধ্যেই তিনি সংজ্ঞা হারান৷ সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় ডাক্তার ডেকে আনলে তিনি জানান কমরেড সঞ্জিত বিশ্বাস আর বেঁচে নেই৷ হার্ট ক্লিনিক অ্যান্ড হসপিটাল থেকে ডাক্তার এসেও একই কথা জানান৷
মৃত্যুর পূর্বেই দেহদানের ইচ্ছাপত্রে স্বাক্ষর করে রেখেছিলেন তিনি৷ কেন্দ্রীয় অফিসে উপস্থিত নেতা–কর্মী–সমর্থক অর্ধনমিত রক্তপতাকা হাতে নিয়ে শববাহী গাড়িকে সামনে রেখে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হসপিটালে যান৷ তাঁর ইচ্ছারপ্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হসপিটালে অ্যানাটমি বিভাগের কর্তৃপক্ষের হাতে তাঁর মরদেহ তুলে দেওয়া হয়৷ দলের নেতা–কর্মী–সমর্থক শুভানুধ্যায়ীরা চোখের জলে তাঁকে লাল সেলাম দিয়ে বিদায় জানান৷ কমরেড সঞ্জিত বিশ্বাসের মৃত্যুতে দল একজন সৎ, পরিশ্রমী ও অত্যন্ত দায়িত্বশীল নেতাকে হারাল৷ গণতান্ত্রিক আন্দোলন হারাল একজন জনদরদি দক্ষ সংগঠককে৷ ৪ ডিসেম্বর বিকাল ৪ টায় ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে তাঁর স্মরণসভা৷
কমরেড সঞ্জিত বিশ্বাস লাল সেলাম