‘মদের ভাঁড়ার, অস্ত্রশালা আর মন্দির’– শাসন শোষণের এই তিন মোক্ষম হাতিয়ারের আভাস রক্তকরবীতে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ৷
পঁচাত্তর বছরের স্বাধীন দেশে সরকারগুলো সেই আভাসের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে৷ কেন্দ্র এবং রাজ্যে রাজ্যে নানা দলের যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, সরাসরি হোক কিংবা ঘুরপথে মদের প্রসারে তারা কেউ কম যায় না৷ বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে বর্তমান সরকার এবং তাদের পূর্বসূরিরা কেউই এই ব্যাপারে পিছিয়ে নেই৷
কয়েকদিন আগেই এর ফল ভোগ করেছে হাওড়ার শ্যামপুরে এক কিশোরী কন্যার পরিবার৷ ২২ জানুয়ারি মেয়ের শ্লীলতাহানি রুখতে গিয়ে মদ্যপদের নির্মম প্রহারে প্রাণ হারিয়েছেন তার বাবা৷ ছাত্রীটি কোচিং থেকে ফিরছিল৷ বাড়ির কাছের মাঠে মদ্যপদের হাতে পড়ে সে৷ চিৎকার শুনে ছুটে যান ছাত্রীটির বাবা৷ মদ্যপরা তাঁকে বেধড়ক মারধর করে ফেলে রেখে পালায়৷ গুরুতর জখম অবস্থায় গ্রামীণ হাসপাতাল ঘুরে ডলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়৷ এরপর যথারীতি চলে পুলিশের টালবাহানা এবং ঘটনা ম্যানেজ করার জন্য শাসক দলের চেষ্টা৷ এই ঘটনার কয়েকদিন পরেই সেই হাওড়া জেলাতেই নাজিরগঞ্জের নেপালি পাড়ায় বাড়ির সামনে মদ বিক্রি এবং মদের আসর বসানোর প্রতিবাদ করতে গিয়ে খুন হলেন রবি রাই নামে এক যুবক৷ এই দুটি মৃত্যু যা দুটি পরিবারকে অসহায় অবস্থায় ঠেলে দিল, তার জন্য দায়ী কে? শুধু হাওড়া নয়, রাজধানী কলকাতা সহ রাজ্যের নানা প্রান্তে এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার কার্যত কোনও সীমা পরিসীমা নেই৷ মদ্যপদের হাতে একের পর এক ঘটেই চলেছে শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ, ধর্ষণ করে খুনের মতো পাশবিক ঘটনা৷ একেবারে সাম্প্রতিক না হলেও আরও কিছু ঘটনা মানুষের মনে পড়বে নিশ্চয়ই– দিদির শ্লীলতাহানি রুখতে গিয়ে মদ্যপদের হাতে নিহত বারাসাতের রাজীব, কামদুনির নির্যাতিতা নিহত মেয়েটি, মধ্যমগ্রামের ধর্ষিতা এবং খুন হওয়া কিশোরী, জলপাইগুড়ি, ধূপগুড়ির নির্যাতিতা — সবকটি মর্মান্তিক ঘটনার পেছনে আছে মদ্যপদের হাত৷
সরকার কি এসব ঘটনা জানে! জেনেও কি তারা মদের প্রসার ঘটিয়ে তার ভিত্তিতেই রাজস্ব বাড়ানোর সর্বনাশা পথে চলছে! নাকি সমাজে মদের সাংঘাতিক কুপ্রভাব নিয়ে সরকারের সামান্যতম কোনও মাথাব্যথা নেই শুধু কি নারীদের ওপর অত্যাচার! দরিদ্র পরিবারে কেড মদ্যপ হয়ে ডঠলে সেই পরিবারের আর্থিক অবস্থা কী ভাবে ভেঙে পড়ে, শিশুদের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হয় তা জানতে সমাজবিদ হতে হয় না৷ কিন্তু সব সর্বনাশের কথা জেনেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার অনড়-আচল৷ কিছু দিন আগের একটি সমীক্ষা জানিয়েছে, দেশে মদ্যপানের নিরিখে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ৷ রাজ্যের রাজস্বের একটি বড় অংশই আবগারি আয় থেকে রাজ্যের কোষাগারে আসে৷ এর ওপর বিক্রি বাড়ানোর জন্য গত ১৬ নভেম্বর থেকে রাজ্যে বিলিতি মদের দাম কমিয়েছে সরকার৷ পাশাপাশি, একাধিক দেশি মদকেও আকর্ষণীয় ভাবে ব্র্যান্ডিং করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে৷ এতে রাজ্যে মদের বিক্রি বাড়বে৷ যার জেরে রাজস্ব আদায়ও বেশি হবে৷ এর সাথে যুক্ত করে ধরতে হবে পুলিশ এবং শাসকদলের স্থানীয় বা ওপরতলার নেতাদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদতে চলা অসংখ্য বেআইনি মদের ঠেক, ভাটিখানার বিপুল সংখ্যাকে৷ এ ব্যাপারে অবশ্য তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার আগের সিপিএম সরকারের পথ অনুসরণ করে চলেছে৷ সিপিএম সরকার জনে জনে মদ পৌঁছে দিতে এমনকি রেডি টু ড্রিঙ্ক রূপে সফট অ্যালকোহল চালু করেছিল৷ কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারও সারা দেশে আবগারি আয় বাড়ানোর জন্য মদের প্রসার চাইছে৷ ফলে এই দলগুলি যখন নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলে, নির্যাতিতার বাড়ি গিয়ে চোখের জল ফেলে, মানুষ বোঝে এ সব ভোটের চমক৷ অসহায় পরিবারের প্রতি তাদের কোনও সহমর্মিতাই নেই৷
শ্যামপুরের ঘটনার পর রাজ্যের তৃণমূল সরকারের পরিবহণ মন্ত্রী তথা শাসকদলের শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেছেন, আমরা এর শেষ দেখে ছাড়ব৷ প্রশ্ন হল তিনি বা তার সরকার কিসের শেষ দেখবেন! সিপিএমের ধারাবাহিকতায় তাঁরা গোটা রাজ্যটাকে কার্যত মদের ঠেক বানানোর দিকে যাচ্ছেন৷ এই পথে চলে, সমাজে যতটুকু সুস্থতা অবশিষ্ট আছে তার শেষই কি দেখতে চাইছেন তাঁরা! মাঝে মাঝে কোনও একটা হত্যাকাণ্ড হলে সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে চাপা দিতে নেতা-মন্ত্রীরা বিবৃতি দেন৷ আর কর্পোরেট সংবাদমাধ্যম দেখানোর চেষ্টা করে বেআইনির বদলে আইনি মদের জোয়ার বইলেই এর সমাধান হবে৷ সাধারণ মানুষ যাঁরা প্রতিদিন মদ্যপদের দাপাদাপি দেখে আতঙ্কিত তাঁদের মনের কথাকেই দাবি আকারে তুলে ধরেছে এস ইউ সি আই (সি)– পশ্চিমবঙ্গে মদ নিষিদ্ধ করতে হবে৷ এই দাবিতেই সারা রাজ্যে আন্দোলনের ঝড় তুলতে পারলে অসহায় এই নির্যাতিতা কন্যা, নিহত পিতার রক্তের ঋণ আমরা শোধ করতে পারি৷