রাজনীতি জিনিসটা কী? একশো জনকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো আশি জনই ক্ষমতায় থাকা দলগুলোর চুরি, দুর্নীতি, জোচ্চুরির কথা বলবেন। বাস্তবে বড় বড় দলগুলোর লাগামছাড়া দুর্নীতি, নেতাদের মিথ্যাভাষণ, পরস্পরের দিকে কাদা ছোড়াছুডি, ভোটের আগে দল বদলের হিড়িক দেখে দেখে ক্লান্ত, বীতশ্রদ্ধ সাধারণ মানুষ ভুলতেই বসেছেন যে, এ দেশের মাটিতে নেতাজি, ভগৎ সিং, চিত্তরঞ্জন দাশ, মাস্টারদা সূর্য সেনের মতো মানুষেরা যে মহান কাজটি করতেন, তার নাম ‘রাজনীতি’। সেই মহান হৃদয়বৃত্তি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে রাজনীতির নামে আখের গোছানো, নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ক্ষমতার কাছ ঘেঁষে থাকা আজ স্বাভাবিকতায় পর্যবসিত হয়েছে। এ রকম একটা সময়ে দাঁড়িয়ে ২৪ এপ্রিল এসইউসিআই(কমিউনিস্ট)-এর প্রতিষ্ঠা-দিবসের সমাবেশে আসা এক মা যখন গভীর প্রত্যয়ে বলেন, ‘‘আমার সন্তানদের নিয়ে এসেছি, কারণ এখানে না এলে ওরা মানুষ হবে না’’– তখন বোঝা যায়, এ এক অন্য ধারার রাজনীতি, অন্য ধরনের সমাবেশ।
ভয়ঙ্কর গরমে শরীর প্রায় ঝলসে যাচ্ছে। কিন্তু খোলা আকাশের তলায় দলে দলে জড়ো হতে থাকা হাজার হাজার মানুষকে দেখে সে কথা বোঝার উপায় ছিল না। ওই প্রবল রোদেই ছাতা মাথায় অথবা এক টুকরো কাপড়ে মাথা ঢেকে তাঁরা মাঠে সাজানো চেয়ারে বসে পড়ছিলেন। মাটিতেও বসেছিলেন অসংখ্য মানুষ– একেবারে ছোট্ট শিশু কোলে মহিলা, ছাত্র-যুবক, আশি বৃদ্ধ-বৃদ্ধা।
বছর দুয়েকের ছেলে আর চার-পাঁচ বছরের মেয়েকে দু-পাশে নিয়ে বসেছিলেন নরেন্দ্রপুরের শ্যামলী সর্দার। এই গরমের মধ্যে ওদের নিয়ে এলেন? শ্যামলী হেসে বললেন, ‘‘প্রতিবারই আমি আসি। আর ছেলেমেয়েদের এনেছি, যাতে ওরা এখন থেকেই অভ্যস্ত হয়, বড় হয়ে এই দলটাকে চেনে, এখানে যুক্ত হয়। আসলে এখানে না এলে ওদের ভাল মানুষ করতে পারব না।’’ গোটা সমাজে যখন রাজনীতিবিমুখতা বাড়ছে, এমনকি তথাকথিত মূলধারার বামপন্থী দলগুলোর কর্মী-সমর্থকরাও অনেকেই নিজে রাজনীতি করলেও সন্তানকে এ সব থেকে দূরে রাখতে চাইছেন, সেখানে এক তরুণী মা বলছেন, সন্তানদের মানুষ করতে হলে এই দলে আনতে হবে। আর এক মা, পুরুলিয়ার সুস্মিতা মাহাতো সমাবেশে এসেছেন ভোরের ট্রেন ধরে। কিন্তু তাঁর বছর দশেকের সন্তান একদিন আগেই ট্রেনে চেপেছে তারই বয়সি আরও অনেকের সাথে। দলের কিশোর বাহিনী কমসোমলের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠাতা কমরেড শিবদাস ঘোষের ছবির সামনে প্যারেড করে গার্ড অব অনার দেবে তারা।
এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) দলের এ আর এক অভিনব উদ্যোগ। রাশিয়ার মাটিতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের রূপকার লেনিন গড়ে তুলেছিলেন কিশোরদের সংগঠন ‘কমসোমল’– বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত কিশোর সাম্যবাদী বাহিনী। তার অনুসরণে এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) দলেও প্রথম থেকেই গড়ে উঠেছে এই সংগঠন– যেখানে ছোটরা মানবিক মূল্যবোধের পাঠ নেয়, মনীষী চর্চা করে, তাদের মধ্যে ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিতের ধারণা তৈরি হয়। সমাজে যখন স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা বাড়ছে, সোশাল মিডিয়ার কুপ্রভাব শিশুমনকে বিষিয়ে দিচ্ছে, কৈশোরেই মারাত্মক অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে অনেকে, তখন সুস্মিতা, শ্যামলীর মতো মায়েরা গভীর আস্থায় সন্তানকে নিয়ে এসেছেন এই দলের সংস্পর্শে, যাতে তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করার শিক্ষা পায়, ভাল মানুষ হয়ে উঠতে পারে।
দত্তপুকুরের মহাদেব নাথ এসেছিলেন সমাবেশে। ষাটোর্ধ্ব মানুষটির পরনে মলিন লুঙ্গি আর ছেঁড়া গেঞ্জি। জিজ্ঞেস করে জানা গেল, তিনি বনজঙ্গল পরিষ্কারের কাজ করেন। সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের বক্তব্য শুনতে এ বারের মতো আগেও এসেছেন। বয়স এবং শারীরিক অসুবিধাকে উপেক্ষা করে এসেছেন ক্যানিংয়ের কালীপদ ঢালি আর কমলা ঢালি, দু-জনেই প্রবীণ। কথায় কথায় জানা গেল, ওঁদের বড় ছেলে কলেজে অধ্যাপনার কাজ ছেড়ে দিয়ে এখন দলের সর্বক্ষণের কর্মী। আপনারা আপত্তি করেননি? কালীপদ বাবু হেসে বললেন, ‘আমি নিজে তো পঁয়ষট্টি বছর ধরে আছি এই দলটার সাথে, আমাদের পুরো পরিবারই এখানে যুক্ত’। সমাজের প্রচলিত মানসিকতায় এখন মানুষ রাজনীতি করতে আসে টাকাপয়সা, সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য। অথচ এ দলের অসংখ্য কর্মী এ ভাবে দলের কাজের সাথে জীবনকে একাত্ম করেছেন জীবনে একটা মহৎ আদর্শ নিয়ে বাঁচবেন বলে। সবার ক্ষেত্রে যে পরিবারের সমর্থন থাকে, তা নয়। যেমন কলকাতার কলেজ-ছাত্র আদিত্য মিশ্র বলছিলেন, রাজনীতি করা নিয়ে তাঁর বাড়িতে অশান্তি, আপত্তি আছেই। তিনি এখন সেটাকে জীবনের অংশ ধরে নিয়েই লড়ছেন, চেষ্টা করছেন দলের ছাত্র সংগঠনের আরও বেশি দায়িত্ব পালন করার। আদিত্যর মতো দেশ জুড়ে হাজার হাজার ছাত্র-যুব কর্মী, সংগঠক এই প্রেরণা এই শক্তি পাচ্ছেন কোথা থেকে? এই শক্তি আসলে দলের আদর্শভিত্তিক রাজনীতির শক্তি, সঠিক শ্রেণিচেতনার শক্তি।
এ দেশে কমিউনিস্ট নামধারী কয়েকটি দল থাকা সত্ত্বেও মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষ এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) দলটি গড়ে তুলেছিলেন একটি অন্য জাতের দল হিসেবে। যে দলে কমিউনিজম শুধু নামে আর বক্তৃতায় থাকবে না, যে দলের কর্মীরা দেহে-মনে সমাজ বদলানোর উপযুক্ত হওয়ার সংগ্রাম করবেন, কমিউনিজমকে গ্রহণ করবেন জীবনদর্শন হিসাবে। সেই শিক্ষা নিয়েই বিগত সাতাত্তর বছর ধরে এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) দলের পথ চলা। তাই রাজনীতির চর্চা জিনিসটা যখন এমনকি বামপন্থী বলে পরিচিত দলগুলোর মধ্যে থেকেও উঠে যেতে বসেছে, তখন এ দিনের সমাবেশে সাধারণ সম্পাদক প্রভাস ঘোষ সেই রাজনীতি বুঝে নেওয়ারই আহ্বান রাখলেন জনসমুদ্রের সামনে। বললেন, আমাদের জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ করছে রাজনীতি। তাই সাধারণ মানুষ যদি রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চান, রাজনীতি বুঝে সঠিক দলকে শক্তিশালী না করেন, তা হলে ভোট দিয়ে ক্ষমতা পাল্টে কোনও দিন সমস্যার সমাধান হবে না। সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন। শ্রোতারা সেই শ্রেণি-রাজনীতির পাঠ নিয়ে গেলেন একাগ্র মনে।
কাশ্মীরের ঘটনা নিয়ে ভোট-রাজনীতির স্বার্থে যখন সাম্প্রদায়িক বিভেদ উস্কে তোলার চেষ্টা করছে ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলগুলি, তখন কমল পাল আর কলিমুদ্দিন শেখরা শহিদ মিনার ময়দানে পাশাপাশি বসে বুঝে নিলেন, আসল শত্রু এই মালিকি ব্যবস্থা– লড়তে হবে তার বিরুদ্ধেই। সমাবেশের শেষে মাঠ ছেড়ে যাওয়ার আগে অনেকেই এসে দাঁড়াচ্ছিলেন কমরেড শিবদাস ঘোষের উদ্ধৃতি প্রদর্শনীর সামনে, যেখানে শেষ বিকেলের আলো এসে পড়েছে মহান নেতার সেই স্মরণীয় উক্তির ওপর– ‘রাজনীতি একটা উচ্চ হৃদয়বৃত্তি। বিপ্লবী রাজনীতি তো অনেক উচ্চতর হৃদয়বৃত্তি।’ এই উন্নত হৃদয়বৃত্তির চর্চা, শোষিত মানুষের দুঃখ-ব্যথাকে অন্তরে অনুভব করা এবং শোষণমুক্তির আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করার আহ্বান রেখে গেল ২৪ এপ্রিলের সমাবেশ।