এই নির্বাচনের সময়ে টিভির সান্ধ্য বৈঠকগুলিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যে সব নেতা বা প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকেন, তাঁরা কী নিয়ে আলোচনা করেন? কিংবা খবরের কাগজে এই দলগুলির নামকরা নেতাদের যে নির্বাচনী-বত্তৃতার রিপোর্ট ছাপা হয় তাতে কী থাকে? যে কেউ বলবেন, সাধারণ মানুষ যে সব সমস্যায় জ্বলে-পুড়ে খাক হচ্ছে, সে আলোচনা অন্তত সেগুলোয় থাকে না। অর্থাৎ এই সমস্যাগুলির কারণ কী, এর সমাধানের উপায়ই বা কী, কিংবা এই সমস্যাগুলি স্বাধীনতার প্রায় আট দশক পরেও কমার পরিবর্তে কেন ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, তা নিয়ে কোনও আলোচনা থাকে না। তা হলে থাকে কী? থাকে পরস্পরের চুরি-দুর্নীতি নিয়ে কাদা ছোঁড়াছুড়ি এবং কে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত আর কে কম, তারই ফিরিস্তি।
এই সব নেতারা কেউই বলেন না যে, আমি বা আমার দল জয়ী হলে বেকারি, মূল্যবৃদ্ধির মতো মূল সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য এই ভাবে চেষ্টা চালাব, ওই ভাবে নয়, এ সব সমস্যার সমাধান হবে এই পথে, ওই পদ্ধতিতে নয়– এ সব কোনও কিছু। বাস্তবে ব্যক্তিগত আক্রমণ, কুৎসা এবং কিছু মিথ্যা প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি ছাড়া এঁদের মুখে অন্য কোনও কথা কখনও শোনা যায় না। যে দল যেখানে সরকারে রয়েছে, বা অতীতে সরকারে থেকেছে, যে সব ব্যক্তি অতীতে এমএলএ-এমপি হয়েছেন, বা হওয়ার জন্য লালায়িত হয়ে পড়েছেন, তাঁরা কেউই কি সাধারণ মানুষের জীবনের এই সমস্যাগুলি সমাধানের কোনও চেষ্টা করেছেন বা এ কথা কি দেশের মানুষকে বলেছেন যে, এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এই সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, এই ব্যবস্থাকে বদলাতে হবে? না। তারা বরং জীবনের মূল সমস্যাগুলি থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে জাত-ধর্ম-বর্ণের বিভেদ উস্কে তুলে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় মানুষকে ফাঁসিয়ে দেয় আর পুঁজিপতি শ্রেণি নিশ্চিন্তে তাদের লুঠের রাজত্ব নির্ঝঞ্ঝাটে চালিয়ে যায়।
এই দলগুলির যে সব নেতা এক বা একাধিক বার সাংসদ হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন, পার্লামেন্টে কী করেছেন তাঁরা? দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত, দরিদ্র, নিপীড়িত মানুষের জীবনের সমস্যাগুলি সমাধানের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন? তা যদি হতেন তবে পুঁজিপতি শ্রেণি এমন নির্বিবাদে তাদের শোষণের স্টিম রোলার দেশের মানুষের জীবনের উপর চালিয়ে যেতে পারত না। বরং তাঁরা মালিকদের এই শোষণ-লুণ্ঠনকেই আইন-স্বীকৃত করতে নতুন নতুন আইন পাশ করিয়ে চলেছে। বিনিময়ে জনগণকে চরম দারিদ্রের মধ্যে ফেলে রেখে, বঞ্চনার মধ্যে ফেলে রেখে নিজেদের বেতন এবং সুযোগ-সুবিধা ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এই দলগুলি তাই নির্বাচনী প্রচারেও সুকৌশলে জনজীবনের সমস্যা এবং তার সমাধানের বিষয়টিকে এড়িয়ে চলে। এরা সবাই প্রায় কেন্দ্রে-রাজ্যে কোথাও না কোথাও কখনও না কখনও ক্ষমতায় থেকেছে এবং প্রমাণ করেছে, এরা যে রাজনীতির চর্চা করে তার দ্বারা জনজীবনের সমস্যাগুলির সমাধান সম্ভব নয়।
এরাই সব তথাকথিত বড় দল। এই দলগুলি সবাই পুঁজিপতিদের থেকে টাকা নিয়ে জনগণের উপর তাদের অবাধ লুণ্ঠনের ছাড়পত্র দিয়ে চলেছে। সাম্প্রতিক নির্বাচনী বন্ডের দুর্নীতি তা মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। তাই এই সব দলের নেতাদের সবারই আপ্রাণ চেষ্টা, অন্যদের নিজেদের থেকে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রমাণ করা।
নির্বাচনী বন্ড কেলেঙ্কারির প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশের শিল্পসংস্থাগুলি ২০১৯-’২৪ পর্যন্ত নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলিকে যে টাকা দিয়েছে সেই ১২,৭৬৯ কোটি টাকার মধ্যে ৬০৬০ কোটি পেয়েছে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি, ১৬১০ কোটি পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল, কংগ্রেস পেয়েছে ১৪২২ কোটি টাকা। বাকি শাসক দলগুলিও পুঁজিপতিদের থেকে দেদার টাকা নিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই এই সব শিল্পসংস্থা, পুঁজিমালিকদের কোম্পানিগুলি দেশের এবং জনগণের সম্পদের উপর যে নির্মম লুঠ চালাচ্ছে তার বিরোধিতা করা এ সব দলের পক্ষে সম্ভবই না।
এ রাজ্যে সিইএসসি তৃণমূলকে দিয়েছে ৪৪৪ কোটি টাকা, বিজেপিকে দিয়েছে ৮১ কোটি টাকা। বিনিময়ে আদায় করেছে বিদ্যুতের দাম যথেচ্ছ বাড়ানোর এবং সেই দাম জনগণের ঘাড় ধরে আদায়ের ছাড়পত্র। ওষুধ কোম্পানিগুলি যে এক হাজার কোটি টাকা বন্ডের মাধ্যমে ঘুষ দিয়েছে, যার বেশির ভাগটাই পেয়েছে বিজেপি, তাতেই ওষুধের দাম অবাধে বাড়ানোর, নিম্নমানের ওষুধ বাজারে বিক্রির সুযোগ তারা পেয়ে গিয়েছে। যার ফল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
তা হলে এই চুরি-দুর্নীতির ছাড়পত্র দিয়ে তাদের টাকায় যারা মহা আড়ম্বরে ভোটের প্রচারে বিপুল খরচ করছে, টাকা দিয়ে লোক এনে বড় বড় মিছিল করছে, তারা শুধু বড় দল বলেই তাদের সমর্থন করা যায় কি? এই সব নীতিহীন, দুর্নীতিগ্রস্ত দল এবং প্রার্থীরা নির্বাচনে জিতলে সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষা পেতে পারে কি? বরং জিতে তারা জনগণের উপর আরও বেশি করে ি¦†ম রোলার চালাবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির আরও বেসরকারিকরণ করবে, আরও জিনিসের দাম বাড়াবে, মালিকদের আরও বেশি ছাঁটাইয়ের অধিকার দেবে, শ্রমিকদের যত কম মাইনে দিয়ে যত বেশি সময় খাটানো যায় তার ব্যবস্থা করবে।
অথচ এমন নয় যে, এই সব দুর্নীতিগ্রস্ত, নীতিহীন দলগুলির বাইরে আর কোনও দল নির্বাচনে নেই। এমন দলও আছে যারা এই সব দলগুলির দুর্নীতি এবং প্রতারণার রাজনীতির বিরুদ্ধে জনজীবনের সমস্যাগুলি নিয়ে লড়াই করছে, লাগাতার আন্দোলন গড়ে তুলছে, দাবি আদায় করছে। মানুষ জানে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-ই সেই দল যারা মানুষের সর্বাঙ্গীণ মুক্তির জন্য লড়াই করছে। নির্বাচনে তেমন দলকে সমর্থন করা মানে তার শক্তিবৃদ্ধি করা, যার অর্থ এই প্রতিবাদের, প্রতিরোধের শক্তিটাকেই শক্তিশালী করা। মালিক শ্রেণির স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে কিছুটা লাগাম পরাতে হলে, নীতিহীন দলগুলি এবং তার নেতাদের জনস্বার্থ বিরোধী আচরণকে পরাস্ত করতে হলে এই শক্তিকেই আরও মজবুত করতে হবে। তাতেই একমাত্র সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষা পেতে পারে।
কিন্তু এই মূল প্রশ্নটাকেই ক্রমাগত প্রচারের দ্বারা গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। টিভিতে, খবরের কাগজে, বড় বড় দলগুলির নেতা-মন্ত্রী, কর্মীদের বত্তৃতায়, আলোচনায় বার বার সাধারণ মানুষকে বোঝানো হচ্ছে নীতি নয়, আদর্শ নয়, জনস্বার্থ নয়, আমরা যেহেতু বড় দল, তাই আমাদেরই সমর্থন করুন, কারণ আমরাই জিতব। কারণ আমাদের নাম করা নেতা আছে, বিপুল অর্থ আছে, সংবাদমাধ্যমে প্রচার আছে এবং পেশি শক্তির জোর আছে।
তাই নির্বাচনের আগে জনগণকে নিজের স্বার্থেই বুর্জোয়া মিডিয়ার এইসব প্রচারের পিছনে না ছুটে, বড় দলের পিছনে, তাদের জাঁকজমকপূর্ণ প্রচারের পিছনে না ছুটে বিচার করতে হবে– কোন দল জয়ী হবে নয়, কোন দলের জয়ী হওয়া তার নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্যই উচিত।
প্রচারের জৌলুসে ভুলে নীতি-আদর্শহীন পেশিশক্তির রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত, নাকি এস ইউ সি আই (সি)-র মতো যে দল গণআন্দোলনের ময়দানে থেকে জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য লড়ছে এবং আগামী দিনেও মানুষের দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনকেই শক্তিশালী করার কথা বলছে, সেই উন্নত আদর্শের রাজনীতিকে সমর্থন জোগানো উচিত? বারবার ঠকতে না চাইলে, বিরামহীন শোষণ-যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাইলে, একজন সাধারণ মানুষ তথা শোষিত, শ্রমজীবী মানুষকে নিজের বিবেকের কাছে এই প্রশ্নই তুলতে হবে।