Breaking News

যুদ্ধের ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম কী ভাবে মিথ্যাচারকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক যুদ্ধে বহু-প্রচারিত সংবাদমাধ্যম যাচাই না করা তথ্য এবং সম্পূর্ণ বানানো গল্প প্রকাশ করেছে।

প্রতিবেদনগুলিতে ভারতের অভূতপূর্ব সাফল্যের বর্ণনা দেওয়া হয়েছিল, যেমন ভারত পাকিস্তানের একটি পারমাণবিক ঘাঁটিতে আঘাত হেনেছে, দুটি পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়েছে এবং পাকিস্তানের তেল ও বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র করাচি বন্দরের একটি অংশ ধ্বংস হয়েছে। প্রতিটি তথ্যই অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট ছিল, কিন্তু এর একটিও সত্য ছিল না। সীমান্তের উভয় পাশেই মিথ্যা, অর্ধসত্য, মিম, বিভ্রান্তিকর ভিডিও ফুটেজ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে সম্পাদিত ভাষণের কারণে সত্যকে কাল্পনিক তথ্য থেকে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।

সমাজমাধ্যমের পাশাপাশি বহু-প্রচারিত সংবাদমাধ্যমেও এই মিথ্যার স্রোত প্রবেশ করেছিল। সংবাদমাধ্যমগুলোর এই পরিবর্তনকে যেসব বিশ্লেষক স্বাধীন সাংবাদিকতার বিবর্তন হিসেবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তাঁরাও এ ধরনের খবর দেখে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।

চার দিনের সংঘর্ষের সময় সংবাদ প্রকাশের প্রতিযোগিতা এবং প্রতিবেদনের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি চরমে পৌঁছেছিল। সংবাদ উপস্থাপক ও ভাষ্যকারদের অনেকেই যেন দুটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে যুদ্ধের জন্য চিয়ারলিডার হয়ে উঠেছিলেন।

জাতীয়তাবাদী উত্তেজনার মাঝে কিছু সুপরিচিত টেলিভিশন চ্যানেল যাচাই না করা তথ্য বা এমনকি সম্পূর্ণ মিথ্যা গল্পও প্রচার করেছিল।

সংবাদমাধমগুলোর একটি অংশ পাকিস্তানের একটি পারমাণবিক ঘাঁটিতে কথিত এক হামলার বিষয়ে রিপোর্ট করেছিল এবং এই হামলার ফলে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে বলেও গুজব রটানো হয়। তারা হামলাটি কোথায় হয়েছে তা দেখানোর জন্য এমনকি মানচিত্রও প্রকাশ করেছিল। কিন্তু এই দাবিগুলোর সমর্থনে তাদের কাছে কোনও প্রমাণ ছিল না। ভারতীয় নৌবাহিনী করাচিতে আক্রমণ করেছে– এই গল্পটিও ব্যাপকভাবে প্রচার পেয়েছিল।

দক্ষিণ এশিয়ায় ভুয়ো তথ্য নিয়ে গবেষণাকারী আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক সুমিত্রা বদ্রীনাথন বলেন– ‘‘আমরা যখন ভুল তথ্যের কথা ভাবি, তখন আমাদের মনে পড়ে ছদ্মনামে পরিচালিত অ্যাকাউন্ট, অনলাইন বট বা এমন কিছু, যার উৎস কেউ জানে না।’’

তিনি আরও বলেন, ভারতের ২০১৯ সালের পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষের সময়ও সামাজিক মাধ্যম ভুল তথ্যে ভরে গিয়েছিল, কিন্তু এবারে যা বিশেষভাবে লক্ষণীয়, তা হল–‘‘আগে যাঁরা বিশ্বাসযোগ্য সাংবাদিক ও বড় বড় সংবাদমাধ্যম হিসেবে বিবেচিত ছিলেন, তাঁরাই এবার সরাসরি বানানো গল্প প্রচার করেছেন। আগে যাঁদের উপর ভরসা করা হত, সেই উৎসগুলোই যখন ভুল তথ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়, তখন তা এক বিশাল সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।’’

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত নিয়ে মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোতে ছড়ানো ভুল তথ্য ভারতের একসময়ের বহু সুনামের অধিকারী সাংবাদিকতা জগতের ওপর একটি মারাত্মক আঘাত। যুদ্ধরত পক্ষগুলো ঘটনার শুরু থেকেই মিথ্যা ও প্রচারণামূলক তথ্য ছড়িয়ে এসেছে। মূলধারার সংবাদমাধ্যমও বহুবার তাদের দেশের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেছে, এমনকি বহুবার এমন তথ্য দ্রুত প্রকাশ করেছে, যা পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।

তবে সমাজমাধ্যম ভুল তথ্য ছড়ানোর সম্ভাবনাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারতে, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতায় আসার পর থেকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ধীরে ধীরে ক্ষয়িষ্ণু হয়েছে। অনেক সংবাদমাধ্যমকে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে এমন সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য চাপের মুখে পড়তে হয়েছে।

অন্য দিকে, বড় বড় টেলিভিশন চ্যানেলসহ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম সরাসরি সরকারের নীতির প্রচারকে সমর্থন করে। যদিও কিছু ছোট স্বাধীন অনলাইন সংবাদমাধ্যম দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার চর্চা করছে, তবুও তাদের প্রভাব ও বিস্তার সীমিত।

ভারতের অন্যতম বিশিষ্ট সাংবাদিক ও ‘ইন্ডিয়া টুডে’ টেলিভিশনের উপস্থাপক রাজদীপ সরদেশাই এক দিনের সম্প্রচারে দর্শকদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়ার খবর প্রচার করার জন্য, যা সেই সময়ে ‘প্রমাণিত হয়নি,’ বলে তিনি স্বীকার করেন।

নিজের ইউটিউব ভিডিও ব্লগেও তিনি আবার ক্ষমা চান এবং বলেন, কিছু মিথ্যা তথ্য ছিল ‘‘জাতীয় স্বার্থের ছদ্মবেশে ডানপন্থী বিভ্রান্তিকর যন্ত্রের একটি পরিকল্পিত প্রচারণা।’’ তিনি আরও স্বীকার করেন, ২৪ ঘণ্টার সংবাদ চ্যানেলগুলো কখনও কখনও সেই ফাঁদে পড়ে যায়।

ড্যানিয়েল সিলভারম্যান, কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক, যিনি মিথ্যা তথ্য নিয়ে গবেষণা করেছেন, বলেন– ভুল তথ্য অর্থাৎ বিদ্বেষপূর্ণ উদ্দেশ্যে ছড়ানো তথ্য ‘‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে উসকে দেওয়ার জন্য তৈরি, কখনও কিছু গোপন রাখার জন্যও ব্যবহৃত হয়, তবে মূলত এমন আবেগতাড়িত উপাদান ছড়ানোর জন্য তৈরি যা মানুষের মনোযোগ খুব সহজেই আকর্ষণ করে।’’

ভারত ও পাকিস্তানের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুই দেশের ঐতিহাসিক বৈরিতার কারণে নাগরিকরা এমনিতেই যে কোনও মিথ্যা সহজে গ্রহণ করা এবং ছড়িয়ে দিতে প্রস্তুত থাকে। ভারতে একটি স্বাধীন ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইট ‘অল্ট নিউজ’ যা সামাজিক ও মূলধারার গণমাধ্যমে ছড়ানো ভুয়ো তথ্য খণ্ডনের কাজে নিয়োজিত, বহু বানানো খবর টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রচার করেছে তার প্রমাণ হাজির করেছে। এর মধ্যে ‘আজ তক’ ও ‘নিউজ ১৮’-এর মতো জাতীয় পর্যায়ের চ্যানেলও রয়েছে। ‘‘তথ্য সরবরাহের পরিবেশ ভেঙে পড়েছে,’’ বলেন অল্ট নিউজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা প্রতীক সিনহা। তাঁর মতে, ফ্যাক্ট চেকিং মিথ্যা তথ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, কিন্তু এর মূল্যও তাকে দিতে হয়েছে। অল্ট নিউজ একটি সংবাদমাধ্যমের দায়ের করা মানহানির মামলার মোকাবিলা করছে এবং তাদের সাংবাদিকদেরও হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স-এর তথ্য অনুযায়ী, ভারতে ২০ কোটিরও বেশি পরিবার টেলিভিশনের মালিক এবং প্রায় ৪৫০টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল শুধুমাত্র সংবাদ পরিবেশনের জন্য নিবেদিত, যা টেলিভিশনকে দেশের অন্যতম প্রধান তথ্যের উৎসে পরিণত করেছে।

গত সপ্তাহে বেশ কয়েকটি পরিচিত টেলিভিশন চ্যানেল ভারতীয় নৌবাহিনী করাচিতে হামলা চালিয়েছে এই প্রতিবেদন প্রচার করে। এই খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ‘করাচি’ ও ‘করাচি পোর্ট’ শব্দদ্বয় এক্স-হ্যান্ডেলে ট্রেন্ড করতে থাকে এবং সোশাল মিডিয়ায় বিস্ফোরণের ফলে শহরের আকাশে ঘন কালো মেঘের ছবি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তথ্য-পরীক্ষকরা পরবর্তীতে নিশ্চিত করেন যে, সেই দৃশ্যগুলো আসলে গাজা থেকে নেওয়া হয়েছিল। সংঘাত শেষ হওয়ার পর এক বিবৃতিতে ভারতীয় নৌবাহিনী জানায় যে, তারা করাচিতে আক্রমণ চালানোর জন্য প্রস্তুত ছিল, কিন্তু সেই হামলা বাস্তবে ঘটেনি।

সূত্রঃ এনওয়াইটাইমস.কম, ১৭ মে ’২৫

এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা  ১৩ – ১৯ জুন ২০২৫ এ প্রকাশিত