যারা বলে শ্রমিকরা রাজনীতি করবে না, তারা ধাপ্পাবাজ – শিবদাস ঘোষ

আমি ‘প্যাট’ (তোষামোদ) করা একেবারে পছন্দ করি না। সুড়সুড়ি দেওয়া একদম পছন্দ করি না। সত্য কথা বলছি, ভাল লাগে আপনারা ভাবুন। না বোঝেন, না ভাল লাগে মানবেন না। কিন্তু কথাটা সত্য। কী এ দেশে হয়? খুশি হলেই হাততালি। মাথা খাটানো হয় না। কিন্তু এ কথা সবাই বলে যে, শুধু পেশিতে কাজ হয় না, উত্তেজনায় কাজ হয় না– বুদ্ধি চাই, মগজ চাই। আর এই মগজ হচ্ছে নেতৃত্ব। তাই শ্রমিকসমাজকে ভাবতে হবে, পড়তে হবে, চিন্তা করতে হবে, কাজ করতে করতে দিনরাত রাজনীতির চর্চা করতে হবে। যারা বলে মজুররা রাজনীতি করবে না, মজুরদের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে রাজনীতি ঢোকানো উচিত নয় তারা জোচ্চোর, ধাপ্পাবাজ। তারাও একদল পরজীবী যারা মজুর ইউনিয়ন করে বাড়িঘর করে, মোড়লি করে বেড়ায়, অথবা কর্তৃত্ব করে বেড়ানোই যাদের পেশা এবং নেশা। তারা এই মিথ্যা কথাটা ছড়ায় যে, ট্রেড ইউনিয়নে রাজনীতি ঢুকিও না। কিন্তু ট্রেড ইউনিয়ন হচ্ছে স্কুল, রাজনীতি শিক্ষার শিবির, মার্ক্সের ভাষায়– যে মার্ক্স-এঙ্গেলস-এর ছবি শ্রমিকেরা টাঙান, সমস্ত লাল ঝান্ডাওয়ালারা টাঙায়। তিনি বলছেন, এই ট্রেড ইউনিয়নগুলো কী? একটা কথায় তিনি তাকে প্রকাশ করেছেন। লড়াই-টড়াই, হাতিয়ার-টাতিয়ার এত কথায় তিনি যানইনি। এ তো আছেই। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, ট্রেড ইউনিয়ন হচ্ছে ‘স্কুল অব কমিউনিজম’– কমিউনিজমে শিক্ষিত হবার, শিক্ষা গ্রহণ করবার একটা ‘ম্যাসিভ’ (বিরাট) রাজনৈতিক শিক্ষাশিবির। এই হল ট্রেড ইউনিয়ন। এই ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে যদি এই শিক্ষাশিবির হিসাবে না দেখা হয়, এগুলো রাজনীতি চর্চার একটা প্রাণকেন্দ্র হিসাবে গড়ে না ওঠে তা হলে এই ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনগুলো শেষ পর্যন্ত বুর্জোয়া ও পেটিবুর্জোয়াশ্রেণির হাতে বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনে বিভেদ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার অস্ত্রে পর্যবসিত হতে বাধ্য। এমতাবস্থায় শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী রাজনৈতিক চেতনাবৃদ্ধির বদলে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনগুলো শেষপর্যন্ত শ্রমিক আন্দোলনে অর্থনীতিবাদ বা সুবিধাবাদের জন্ম দিয়ে থাকে।

অর্থনীতিবাদ বা ‘ইকনমিজম’, যাকে মজুর আন্দোলনে আমরা এক কথায় সুবিধাবাদ বলে থাকি, মজুরদের এই সুবিধাবাদ মালিকদের পক্ষে আশীর্বাদ স্বরূপ আর মজুরের পক্ষে মৃত্যুর সামিল। মজুর খেতে পায় না বলে তার সুবিধাবাদটা ন্যায়সঙ্গত হয়ে যায় না– এ কথাটা মনে রাখা দরকার। মালিক লুট করে বলে তার সুবিধাবাদ তো আরও খারাপ। কিন্তু শ্রমিক খেতে পায় না বলে তার সুবিধাবাদটাও মানবিক বা যুক্তিসঙ্গত হয়ে যায় না। কাজেই মজুরকেও নিজ শ্রেণিস্বার্থেই তার এই অর্থনৈতিক সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। মজুরদের বেঁচে থাকতে হলে দাবি মেটানো চাই, তার দাবি আদায়ের জন্য লড়াই দরকার। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। এই যদি লড়াইয়ের মুখ্য উদ্দেশ্য হয়, আর এই উদ্দেশ্যের দ্বারা পরিচালিত হয়েই যদি ইউনিয়ন পরিচালনা করা হয় তা হলে সে সব ইউনিয়নগুলো শুধু সুবিধাবাদী শ্রমিকের জন্ম দেবে। সচেতন, সত্যিকারের দেশ-দরদি, সত্যিকারের বিপ্লবী ভাবনায় উদ্বুদ্ধ, মুক্তিআন্দোলন পরিচালনা করবার যোগ্য শ্রমিকের জন্ম তারা দিতে পারে না। কাজেই শ্রমিক সম্মেলনগুলোকে সেই দিকে নিয়ে যাওয়ার দরকার আছে, শ্রমিক আন্দোলনকে সেই ভাবে পরিচালনা করার দরকার আছে, শ্রমিক ইউনিয়নগুলিকে সেইদিকে পরিচালিত করার দরকার আছে।

অথচ দেখা যায়, ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকর্তাদের প্রাত্যহিক ট্রেড ইউনিয়ন কাজকর্ম কী? মজুররা রোজ ‘ইয়ে মাংগ ক্যা হ্যায়, উয়ো মাংগ ক্যা হ্যায়, ইয়ে রূপেয়া মিলেগা ইয়া নহি, আপ কুছ বন্দোবস্ত কিজিয়ে’– এ রকম বলে। অর্থাৎ ট্রেড ইউনিয়ন কর্তাদের অমুককে ধরে একটা বন্দোবস্ত করে দেবার কথা বলে। মানে তেল দেবার কথা বলে। সোজা কথায় বলে আপনি নাম করা লোক, আপনার প্রভাব আছে, আপনি একটু অমুককে ধরে বন্দোবস্ত করে দিন। এই কথা নেতাকে বলে। আর নেতারাও তাই করে। কারণ নেতারা হচ্ছে, যে যত তেল দিয়ে এ রকম ম্যানেজ করে দিতে পারে সেই সবচাইতে বড় নেতা।

শ্রমিকদের মধ্যে এ রকম ধারণা হয়ে গেছে যে, অমুকের কাছে গিয়ে লাভ নেই। কারণ অমুকের থেকে অমুকের তেল দেওয়ার ক্ষমতা বেশি। ওর সঙ্গে সম্পর্ক ভাল, ওর ধরাধরির ক্ষমতা বেশি– এ কথার মানে হল ওর তেল দেওয়ার ক্ষমতা বেশি। কাজেই ওর কাছে গেলে তাদের দাবি মিটে যাবে। এ সব মনোভাব কী? এ সুবিধাবাদ নয়? এতে মজুরের নৈতিকতা থাকে? এখানে শ্রমের মর্যাদাবোধ কোথায়? তা হলে বড় বড় কথা, হাততালি, লড়াই, এতসব কথার দরকার কী? যে মজুর শ্রমের মর্যাদাবোধ হারিয়ে ফেলে এইরূপ সুবিধাবাদের খপ্পরে পড়েছে, সে মজুর কী করবে? সে মজুর তো মার খাবেই। সে মজুর কি মানুষ? আমি সেই মজুরের পক্ষে যে মজুরের সম্ভ্রমবোধ আছে, যে মজুরের ইজ্জতবোধ আছে, যে মরবে তবু ইজ্জত দেবে না, যে লড়াই করে আদায় করবে, যে সচেতন মজুর। যে দালাল মজুর সে মজুর বলেই তার প্রতি আমার মমতা নেই। এ কথাটা মনে রাখা দরকার এবং এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়া দরকার। তবেই ব্যক্তিগত সুবিধাবাদের ঊর্ধ্বে শ্রমিকরা উঠতে পারবেন। তবেই শ্রমিকরা এই শ্রমনীতির যথার্থ তাৎপর্য বুঝতে পারবেন। এই শ্রমনীতির তাৎপর্য হচ্ছে, এ একদিকে যেমন শ্রমিকদের দৈনন্দিন দাবিদাওয়ার আন্দোলন গড়ে তুলতে সহায়তা করবে, অন্য দিকে এর চেয়ে বড় তাৎপর্য হচ্ছে যে, এই সুযোগে শ্রমিকরা তাদের মনোমতো রাজনৈতিক চর্চার দ্বারা, আন্দোলনের দ্বারা একটা সঠিক রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার সুযোগ পাবেন। ফলে সেইটা নিতে হবে, সেই দিকে অনতিবিলম্বে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ করতে হবে।

জীবনধারণের প্রাত্যহিক প্রয়োজনে দাবিদাওয়া নিয়ে লড়াই এগুলো তো আছেই– যেমন মলমূত্র ত্যাগ করা আছে, বাজার করা আছে, যেমন ছেলের অসুখ হলে ওষুধের দোকানে দৌড়ানো আছে। অর্থাৎ দাবির প্রশ্ন আছে এবং তা না পেলে লড়াই আছে। কিন্তু তা রাজনীতিকে দূরে ঠেলবে কেন? মূল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে শ্রমিকদের অনীহা থাকবে কেন? অনিচ্ছা, ঔদাসীন্য থাকবে কেন? একটা জিনিস প্রায়ই দেখা যায়, রাজনীতির কথা এলেই ঝিমুনি পায়। দেশের কথা, আন্তর্জাতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা হলেই ঝিমুনি পায়। কিন্তু ‘অমুক দাবির কী হবে’, ‘তার তদবিরটা ঠিকমতো হচ্ছে কি না’, এ সব কথা উঠলেই মজুররা খুব চঞ্চল হয়ে ওঠে। আপনারাই বলুন, আমি ঠিক বলছি কি না।

অথচ এই মনোভাবকে যদি আপনারা দূর না করতে পারেন তা হলে আজ যে মজুর, কাল তার ছেলে আরও খারাপ মজুর, তার ছেলে অর্থাৎ তস্য নাতিটা একেবারে বেকার মজুর, হদ্দ মজুর। জীবনেও সে মুক্তি পাবে না। একবারও কি ভেবেছেন, কী জবাব আপনারা আপনাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে দেবেন? আপনি মজুর, আপনি ‘সিভিলাইজেশন’-এর স্রষ্টা, এ সভ্যতার স্রষ্টা। আর এই সভ্যতা মুক্তিবেদনায় কাঁপছে, সে আপনাদের কাছে মুক্তি চাইছে। শুধু আপনাদের মুক্তি নয়, গোটা মানবসভ্যতার মুক্তি আপনাদের হাতে। তার দায়িত্ব শ্রমিকের হাতে। অথচ আপনাদের, শ্রমিকদের সে সম্বন্ধে আজও এতটুকু চেতনা নেই। সেই চেতনা যদি শ্রমিকদের মধ্যে না আসে, সেই চেতনায় শ্রমিকরা যদি উদ্বুদ্ধ না হতে পারেন তা হলে সব ব্যর্থ। তা হলে এর কোনও মানে নেই। কাগজেপত্রে কোনও প্রস্তাব গ্রহণ করার কোনও মানে নেই।

(শ্রমিক আন্দোলনে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে)

এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা  ২০ – ২৬ জুন ২০২৫ এ প্রকাশিত