প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে ভোট প্রচারে বেরিয়ে ভোটারদের উদ্দেশে আকুল আবেদন জানিয়ে বলেছেন– ‘হিন্দু ধর্ম বাঁচান। সনাতন হিন্দুধর্ম’। বলেছেন, সনাতন ধর্মের সুরক্ষা একমাত্র তাঁর আমলেই সম্ভব। তারপর তিনি স্বামী বিবেকানন্দের শরণ নিয়ে জানিয়েছেন–‘যে সনাতন ধর্মের প্রেরণায় স্বামী বিবেকানন্দ সমাজের অন্ধকার দূর করতে মানুষকে জাগ্রত করেছেন’– ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ মোদিজি বলতে চাইছেন, যে হিন্দুধর্মের জন্য বিবেকানন্দ প্রাণপাত করেছিলেন, সমাজ থেকে অন্ধকার দূর করতে চেয়েছিলেন, তাঁরা সেই হিন্দুধর্মের সুরক্ষায় ব্যস্ত।
বিবেকানন্দ কী ধরনের হিন্দুধর্ম চর্চা করেছিলেন, তা ব্যাখ্যা করার আগে আমরা একটু দেখে নিই কী ধরনের ধর্মচর্চা মোদিজি এবং তাঁর পূর্বসূরীরা এ দেশের বুকে চালু করেছেন। এ নিয়ে বিস্তৃত ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। কারণ, সেই ইতিহাস বর্তমানে কমবেশি সকলেরই জানা। তবুও মোদিজির দাবির প্রেক্ষিতে কয়েকটি কথা না বললেই নয়।
যে সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব মোদিজি করেন, সেই আরএসএস-বিজেপির ইতিহাস কী? দেশের ঐতিহ্য রক্ষার নামে সমস্ত বস্তাপচা পুরনো চিন্তা মানুষের মগজের মধ্যে গুঁজে দেওয়া, সতীদাহ প্রথার সমর্থন, বাল্যবিবাহের গৌরবগাথা প্রচার, বর্ণব্যবস্থার জয়গান, নবজাগরণের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের চিন্তার বিরোধিতা, ব্র্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালালি করে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করা, নেতাজি-ভগৎ সিং প্রমুখ মহান দেশপ্রেমিকদের বিশ্বাসঘাতক হিসাবে দেগে দেওয়া, ক্রমাগত মুসলিম বিদ্বেষ প্রচার করে এ দেশে সাম্প্রদায়িক মানসিকতার প্রচার প্রসার ঘটানো, মানুষের মধ্যে অন্ধ যুক্তিহীন মানসিকতার প্রসার ঘটিয়ে ফ্যাসিবাদের বুনিয়াদকে পাকাপোক্ত করা, মালিক পুঁজিপতি শ্রেণির সেবা– এই তাদের ইতিহাস।
ঘৃণার এই দুষ্ট রাজনীতির ফলিত প্রয়োগ হিসাবে আমরা বর্তমানে কী দেখতে পাচ্ছি? দেখতে পাচ্ছি, অদ্ভূত এক আঁধার যেন আমাদের সমগ্র মনোজগতকে গ্রাস করতে চাইছে। ভুলিয়ে দিতে চাইছে এ দেশের সুপ্রাচীন সভ্যতাকে। আমরা ভুলে যেতে বসেছি সেই ইতিহাস– এ দেশে এক সময় হিন্দু সমাজের গুরু প্রবীণ মণ্ডন মিশ্র, যুক্তির কাছে পরাভূত হয়ে নবীন শঙ্করাচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ভুলে যেতে বসেছি, এই ভূখণ্ডের বিজ্ঞান, সাহিত্য, কাব্য, দর্শনের অমূল্য ভাণ্ডারকে– যা একদিন দুনিয়াকে আলোকিত করেছিল। ভুলে যেতে বসেছি আর্যভট্ট, ভাস্করাচার্যদের মতো মহান বিজ্ঞান সাধকদের। মোদিজিদের রাজনীতি তা ভুলিয়ে দিচ্ছে। সৃষ্টি করছে একদল যুক্তি-বুদ্ধি-বিচারহীন অন্ধ মানুষের– যারা ফ্যাসিবাদী তামস রাজনীতির ঝান্ডা উড়িয়ে সভ্যতার উপর নির্বিচারে আক্রমণ হানছে।
এই ধরনের ধর্মান্ধ কিছু মানুষ, যারা করসেবক বলে পরিচিত, তাদের লেলিয়ে দিয়ে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছিল। স্লোগান উঠেছিল, ‘এক ধাক্কা আউর দো, বাবরি মসজিদ তোড় দো’। সে দিন বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়েছিল, সাথে সাথে ধ্বংস হয়েছিল ভারতের উদার অন্তরাত্মা। সে দিন বাবরি মসজিদের এক একটা ইট খসে পড়েছিল, সাথে সাথে খসে পড়েছিল যুগ যুগান্তরব্যাপী মহান মনীষার সাধনায় গড়ে তোলা সভ্যতার ইমারত। যে ভূখণ্ডে রামদাস, তুকারাম, কবির, দাদু, নানক, চৈতন্য মহামানবের মিলনের বাণী প্রচার করেছিলেন, সেই দেশে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখতে হল ঘৃণার রাজনীতির এই বর্বর প্রকাশ, বিংশ শতাব্দীতে! আর এই ঘৃণার রাজনীতির প্রচার প্রসার ঘটিয়ে, দাঙ্গায় দাঙ্গায় দেশটাকে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়ে, মুসলিম বিদ্বেষকে মহামন্ত্র করে মোদিজিদের ক্ষমতায় আরোহণ। এই রাজনীতির সাথে স্বামী বিবেকানন্দের মতো মহান মানুষের সম্পর্ক কোথায়?
বিবেকানন্দ এ দেশের বুকে হিন্দু ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উদগাতা। তরুণদের প্রতি তাঁর আহ্বান ছিল– ভুলিও না, জন্ম হইতেই তুমি মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত। কতিপয় তরুণ তাঁর কাছে সন্ন্যাস গ্রহণের আবেদন নিয়ে গেলে তিনি তাঁদের তিরস্কার করে বলেছিলেন, এত বড় একটা দেশের পরাধীনতার জ্বালা কি তোমরা অনুভব করো না? যাও ইংরাজ তাড়াও গিয়ে। তাঁর ধর্মবোধে সাম্প্রদায়িকতার কোনও স্থান ছিল না। সাম্প্রদায়িকতাকে তিনি ধর্মের জঘন্য বিকৃতি বলে মনে করতেন। মনে করতেন সব ধর্মের মধ্যেই সত্য আছে। তাই ১৮৯৩ সালে তিনি শিকাগোর ধর্ম সম্মেলনে বলতে পেরেছিলেন– ‘যে ধর্ম জগৎকে চিরকাল পরমত সহিষ্ণুতা ও সর্ববিধ মত স্বীকার করার শিক্ষা দিয়া আসিতেছে, আমি সেই ধর্মভুক্ত বলিয়া নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমরা শুধু সকল ধর্মকে সহ্য করি না, সকল ধর্মকেই স্বীকার করি।’
তিনি আরও বলেছেন–‘এটা খুবই স্বাভাবিক যে একই সময়ে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে আমার ছেলে বৌদ্ধ ,আমার স্ত্রী খ্রিস্টান এবং আমি নিজে মুসলমান হতে পারি’ (বাণী ও রচনা, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১৭২)।
ধর্মান্ধ হিন্দুদের উপদেশ দিয়ে বিবেকানন্দ বলেছেন– ‘তোমরা যে নিজদিগকে ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখিয়া খাঁটি হিন্দু বলিয়া পরিচয় দিতে গর্ব অনুভব করিয়া থাকো, উহা ছাড়িয়া দাও’ (ঐ, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ২৭৩)।
তিনি আরও বলেছেন, ‘বেদান্তে কোনও সম্প্রদায়, ধর্ম বা জাতির বিচার নাই। কিভাবে এই ধর্ম ভারতের জাতীয় ধর্ম হতে পারে?’ (ঐ, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ২৮৬) হিন্দুধর্ম সম্পর্কে এই হল স্বামীজির ব্যাখ্যা ও মতামত।
উদার এই মানসিকতা থেকেই স্বামীজি বলতে পেরেছিলেন– ‘মুহাম্মদ সাম্যবাদের আচার্য। তিনি মানবজাতির ভ্রাতৃভাবের প্রচারক। তিনি ঈশ্বরপ্রেরিত পুরুষ’ (৩ এপ্রিল, ১৯০০, আমেরিকা)।
‘ইসলাম যেখানে গিয়েছে, সেখানেই আদিম নিবাসীদের রক্ষা করেছে’ (প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য)।
স্বামীজীর এই ধরনের অসংখ্য বক্তব্যের উদাহরণ তুলে ধরা যায়। তাঁর গুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবও একই কথা বলেছেন। মসজিদে গিয়ে তিনি নমাজ পড়েছেন। অর্থাৎ তাঁরা দেখিয়েছেন, সব ধর্মের মধ্যেই সত্য আছে এবং সেই শিক্ষা আমাদের গ্রহণ করতে হবে। তাঁরা বলেছেন অন্য ধর্মকে সহ্য করতে হবে, শুধু তাই নয়, অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীলও হতে হবে।
মোদিজিরা কি এই চিন্তার চর্চা করেছেন কখনও! তাদের গুরু গোলওয়ালকর কী শিক্ষা দিয়েছেন? তিনি বলেছেন, ‘মুসলমানদের কোনও বিশেষ সুযোগ সুবিধা পাওয়া দূরে থাক, তাদের এমনকি নাগরিক অধিকারও থাকবে না’ (উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড, পৃষ্ঠা ২৭)।
আরও বলেছেন, ‘মুসলমানরা এ দেশে জন্মেছে ঠিকই, কিন্তু বিশ্বাসের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই জাতির প্রতি তাদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা নষ্ট হয়ে গেছে।’ বলেছেন, ‘মুসলমানরা এখনও ভাবে তারা এ দেশ দখল করতে এসেছে।’
এই ধরনের মুসলিমবিদ্বেষী চিন্তা দ্বারা আরএসএস তার কর্মীদের মননজগৎ গড়ে তুলেছে এবং সেই সাম্প্রদায়িকতার বিষ দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে। তার জঘন্য প্রকাশ দেখেছি গুজরাটের দাঙ্গায়। মোদিজি তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর আমলে, তাঁর নেতৃত্বে যে নৃশংস মুসলিমনিধন যজ্ঞ পরিচালিত হয়েছিল তার তুলনা মেলা ভার। সনাতন ধর্মের এই ধরনের বিকৃতির চর্চাই মোদিজি, তাঁর সংগঠন আরএসএস-বিজেপি নিরন্তর করে চলেছে। এর সাথে বিবেকানন্দের চিন্তার সম্পর্ক কোথায়? বরং বলতেই হবে ওরা প্রতিনিয়ত বিবেকানন্দের চিন্তাকে, তাঁর আদর্শের মর্মবস্তুকে হত্যা করছে। বলতেই হবে, বিবেকানন্দ যদি হিন্দু হন, তা হলে মোদিজি ও তার দলবল হিন্দু নন। হিন্দুধর্মের রক্ষক তো নয়ই। ওরা ধর্মের ব্যবসাদার। ওরা হিন্দুধর্মের প্রতি মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে ভোট বৈতরণী পার হতে চায়, মসনদ দখল করতে চায়।
এটাই সাম্প্রদায়িকতার বৈশিষ্ট্য। সাম্প্রদায়িক শক্তির কোনও ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা নেই, মমতা নেই, বিশ্বাসও নেই। তারা ধর্মের প্রতি মানুষের আবেগকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগায়। এটাই তাদের বৈশিষ্ট্য। হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিও কাজে লাগায়, মুসলিম সাম্প্রদায়িক শক্তিও কাজে লাগায়। বাইরের দিক থেকে মনে হয়, এদের মধ্যে খুব বিরোধ। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। একের শক্তিবৃদ্ধিতে অন্যেরও শক্তি বৃদ্ধি হয়। এদের চিন্তা ও কর্মপদ্ধতির মধ্যেও অদ্ভূত মিল। পরাধীন ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি ও মুসলিম সাম্প্রদায়িক শক্তি উভয়েই ছিল দ্বিজাতি তত্ত্বের সমর্থক, ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ ছিল উভয়েরই বন্ধু, উভয়েই স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে, ইংরেজি শিক্ষা ও আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত গণতান্ত্রিক চিন্তা যাতে এ দেশের বুকে প্রসারিত হতে না পারে সেজন্য এরা উভয়েই প্রাণপণ চেষ্টা করেছে, এরা উভয়েই মার্ক্সবাদ-সাম্যবাদের বিরোধী। এরা উভয়েই কাজ করে পুঁজিবাদের স্বার্থে। ফ্যাসিবাদী মননজগৎ গড়ে তোলাই এদের কাজ। তাই এরা হিটলারের ভীষণ অনুরাগী। এটাই ওদের আসল চরিত্র।
বিবেকানন্দের কথা মাথায় রাখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, সনাতন ধর্ম-টর্ম সব বাজে কথা। এই ধর্ম ওরা মানেও না, বিশ্বাসও করে না। ওদের আসল লক্ষ্য ভোট বাক্স। আসল লক্ষ্য গদি দখল করা। গদি দখল করে কর্পোরেট পুঁজিপতি প্রভুদের সেবা করা। ওদের গত দশ বছরের রাজত্বে দেশের মানুষের সর্বনাশ হয়েছে। শিক্ষা-সংস্কৃতি ধ্বংস হয়েছে, বেকারে দেশ ভর্তি, কোনও কর্মসংস্থান নেই, কলকারখানা বন্ধ, শ্রমিক ছাঁটাই চলছে অবাধে, ফসলের দাম না পেয়ে চাষি আত্মহত্যা করছে, নারীর ইজ্জত ভূলুণ্ঠিত, জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ নিয়ে হানাহানি বীভৎস রূপ ধারণ করেছে, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের কোনও অস্তিত্ব নেই– এই হল দেশের বাস্তব চিত্র। এ হল পুঁজিবাদী সর্বাত্মক সংকটের বাস্তব প্রতিফলন।
কমরেড শিবদাস ঘোষ আমাদের শিখিয়েছেন, পুঁজিবাদ যত সংকটগ্রস্ত হবে, ততই তার প্রয়োজন হবে ফ্যাসিবাদ। ততই তার প্রয়োজন হবে, যুক্তিবুদ্ধি বিচারহীন এক ধরনের উগ্র জনসমষ্টি। মোদিজি ও তাঁর দলবল এই কাজেই কায়মনোবাক্য সমর্পণ করেছেন। এদের স্বরূপ তাই চিনে নেওয়া খুব প্রয়োজন।