খবরের কাগজ কিংবা টিভি বা সমাজমাধ্যম খুললেই ‘মোদি কি গ্যারান্টি’-র বিজ্ঞাপনের স্রোত। লোকসভার নির্বাচনী ইস্তাহারেও ‘মোদি কি গ্যারান্টি’-র ঘোষণা–আগে জনসেবার জন্য তারা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন–রামমন্দির, জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার এবং সিএএ চালু সবগুলোই করেছে। জনসেবার বাকি কাজগুলিও নাকি তারা অল্প দিনেই করে ফেলবেন! মানুষের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, ভোটের আগে সরকার যা প্রতিশ্রুতি দেয় তা পরিণত হয় ভাঁওতায়। আর তাদের শাসনে যা হয় সেটাই আসল গ্যারান্টি। এবার দেখা যাক মোদি সরকারের দশ বছরের শাসনের আলোকে ‘মোদি কি গ্যারান্টি’ বাস্তবে কী।
প্রধানমন্ত্রীর আসল গ্যারান্টি
বেকারত্ব বাড়বেই–গ্যারান্টি মোদি শাসনেঃ বেকারত্ব গত পাঁচ দশকের মধ্যে শীর্ষে। রয়টারের রিপোর্ট– ভয়াবহ বেকারির প্রতিফলন ভোটে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছে মোদি সরকার। বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি অতীত। নতুন চাকরি দূর অস্ত, চাকরি থেকে ছাঁটাই হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। ২০২২-২৩ এ বিশ্বে যত ছাঁটাই হয়েছে তার মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে ভারত। কেন্দ্রীয় সরকারের হিসাবেই ২০১৪ থেকে ২৩-এর মধ্যে স্থায়ী চাকরি থেকে ছাঁটাই হয়েছে ১ লক্ষ ২০ হাজার কর্মী। অস্থায়ী, ক্যাজুয়াল কাজের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। নিরুপায় যুবসমাজ কাজের খোঁজে এমনকি রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে ইউক্রেনে যুদ্ধ করে প্রাণ দিচ্ছে। সরকার বেকার যুবকদের যুদ্ধরত ইজরায়েলে পাঠাচ্ছে। রয়টারের ২৬ জন অর্থনীতিবিদের মধ্যে ১৫ জনই মনে করেন, বেকারির জন্য নির্বাচনে মোদি সরকারকে বেগ পেতে হবে। পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভের তথ্য বলছে, ২০১৩-১৪ সালে বেকারির হার ছিল ৩.৪ শতাংশ। এ বছর মার্চেই বেকারির হার ছিল ৭.৬ শতাংশ (সিএমআইই-র তথ্য)। যদিও এই তথ্য বাস্তবের অনেক নিচে। উত্তরপ্রদেশে ৩৬২টি পিওনের পদের জন্য আবেদন করেছিল ২৩ লক্ষ বেকার। সম্প্রতি ৬০ হাজার কনস্টেবল পদের জন্য ৪৮ লক্ষ যুবক আবেদন করেছিল। যদিও প্রশ্ন ফাঁস হওয়ায় পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে সরকার। ফলে বেকারি বাড়বেই। পাক্কা গ্যারান্টি।
গ্যারান্টি–মূল্যবৃদ্ধি কমবে নাঃ ২০১৪ সাল থেকে দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বাস্তবটা হাতে হাতে টের পাচ্ছেন দেশের মানুষ। খোদ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক পর্যন্ত জানিয়ে দিয়েছে দাম কমবে না (বর্তমান-২৫ এপ্রিল)। এই বছরের মার্চে মূল্যবৃদ্ধির হার প্রায় ৫ শতাংশ (৪.৮৫ শতাংশ)। জানা গেছে, সারা বছর মূল্যবৃদ্ধির গড় হার এটাই থাকবে। আবার বেশ কিছু অর্থনীতিবিদের মতে, মূল্যবৃদ্ধি আরও ঘটবে। মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে পুঁজিবাদী অর্থনীতির কারণে। নিশ্চিতভাবেই ঘটবে।
গ্যারান্টি– অনাহার বাড়বেইঃ ২০২৩-এ গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে ১২৫টি দেশের মধ্যে ভারতের লজ্জাজনক স্থান ১১১। ২০১৪-তে ভারত ছিল ৬৬-তে। ২০২২-এ ছিল ১০৭। কত নেমেছে হিসাব করুন। দেশে প্রতিদিন ৭ হাজার লোক অনাহারে মারা যায়, প্রতিদিন ২০ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন কাটায়। বিশ্বের ৭৯ কোটি মানুষের দু’বেলা নিয়মিত খাবার জোটে না (রাষ্ট্রপুঞ্জের সাম্প্রতিক রিপোর্ট)। এই শাসনে এর অন্যথা হবে না।
গ্যারান্টি– গরিবি বাড়বেইঃ মোদি শাসনে বৈষম্য আকাশ ছুঁয়েছে। দেশের মোট সম্পদের ৬০ শতাংশ ৫ শতাংশ ধনীর ভাণ্ডারে। নিচের ৫০ শতাংশ দেশবাসীর হাতে মাত্র ১ শতাংশ সম্পদ। বিশ্বে যত গরিব রয়েছে, তার তিন ভাগের এক ভাগ ভারতে। বিজেপি ঘোষিত ‘অমৃতকাল’-এ দেশের ৫৭ শতাংশ মানুষের প্রয়োজনীয় খাবার কেনার পয়সা নেই।
গ্যারান্টি– শিশুঅপুষ্টি ও মৃত্যু বাড়বেঃ হাঙ্গার ইনডে’ ২০২৩-এর রিপোর্ট সবচেয়ে কম ওজনের, রুগ্ন-অপুষ্ট শিশুর সংখ্যায় ভারত রয়েছে শীর্ষে–১৮.৭ শতাংশ। দেখা গেছে, ২০২৩-এ প্রতি ১০০০টি সদ্যোজাত শিশুর মধ্যে মারা যায় ২৬টিরও বেশি।
গ্যারান্টি–অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য, বিপন্ন মহিলাদের নিরাপত্তাঃ মোদি শাসনের গত ৫ বছরের পরিসংখ্যান, উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে পণজনিত বধূহত্যার হার যথাক্রমে দেশে সর্বোচ্চ ও দ্বিতীয়। তৃতীয় স্থানে মধ্যপ্রদেশ। নারী পাচার ও নারী ধর্ষণে প্রথম সারিতে। এনসিআরবি-র তথ্য অনুযায়ী মহিলাদের বিরুদ্ধে সার্বিক অপরাধের ঘটনা ২০২২ সালের তুলনায় ’২৩-এ ৪ শতাংশ বেড়েছে। বিলকিস বানোর ধর্ষণকারীদের মুক্তি, হাথরসের নির্যাতিতাকে পুড়িয়ে মেরে প্রমাণ লোপাটে অভিযুক্তদের বিচার না হওয়া, উন্নাওয়ে নির্যাতিতার সাক্ষী লোপাটের জন্য পরিবারের সদস্যদের হত্যা, কাঠুয়ায় বালিকা নির্যাতন ও খুনে অভিযুক্তদের শাস্তি না হওয়া ইত্যাদি। রামমন্দির বানানো উত্তরপ্রদেশেই ধর্ষণের সংখ্যা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
গ্যারান্টি–আরও বাড়বে কৃষকের আত্মহত্যাঃ ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইন পাশ করানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েও বিজেপি সরকার তা চালু করেনি। ফসলের দাম না পেয়ে ২০১৪ থেকে এক লক্ষের বেশি কৃষক আত্মহত্যা করেছে। ২০২২-এ ভারতে ১১ হাজার ২৯০ জন কৃষিক্ষেত্রে আত্মহত্যা করেছে (৫,২০৭ কৃষক ও ৬,০৮৩ কৃষি-শ্রমিক)। ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩-এর ‘দ্য ওয়্যার’ লিখছে, মোদি জমানায় প্রতিদিন ৩০ জন কৃষক আত্মহত্যা করে।
গ্যারান্টি–সাম্প্রদায়িক বিভেদ বৃদ্ধিঃ সমস্ত উন্নয়নের দাবি, গ্যারান্টিকে পিছনে ঠেলে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং নির্বাচনে বিদ্বেষ এবং বিভেদের রাজনীতিকেই বেছে নিয়েছেন। গুজরাট, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ সহ নানা স্থানে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিজেপির অন্য নেতা-কর্মীরাও লাগাতার উস্কানিমূলক বক্তব্য রেখে চলেছেন। তার পরিণামে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়েছে বহু জায়গায়। গো-রক্ষার নামে সংখ্যালঘু মানুষের উপর যথেচ্ছ আক্রমণ চলছে। শাসক দল বুলডোজার দিয়ে সংখ্যালঘুদের বাড়ি-দোকান গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। পরিণতিতে বহু মানুষ ঘরছাড়া, রুটি-রুজি হারিয়ে বিপর্যস্ত। আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন বহু জন। গরিব মানুষের আর্থিক কষ্টের সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ধর্ম-বর্ণ-জাতপাতের ভিত্তিতে তৈরি বিভেদ-রাজনীতির বিষময় ফল।
গ্যারান্টি– দুর্নীতিচক্রের রমরমাঃ নোটবাতিল করে কালো টাকার মালিকদের শায়েস্তা করা হবে–প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। পরিবর্তে এই প্রক্রিয়ায় পুঁজিপতিরা তাদের বিপুল কালো টাকাকে সাদা করে নেওয়ার সুযোগ পেল। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নাগরত্ন স্বয়ং বলেছিলেন, কালো টাকা সাদা করার ভালো উপায় নোটবাতিল। নীরব মোদি, মেহুল চোক্সী, ললিত মোদি, বিজয় মালিয়া সহ বৃহৎ পুঁজিপতিদের হাজার হাজার কোটি টাকার দুন¹তিতে প্রশ্রয় দিয়েছে মোদি সরকার। এমনকি তাদের মধ্যে অনেকই বিদেশে পালিয়ে যেতে পেরেছে বিজেপি নেতাদের সাহায্যে। মার্কিন সংস্থা হিন্ডেনবার্গ আদানিদের উত্থানের পিছনে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ তুললেও মোদি সরকার অভিযোগের তদন্ত না করে হাত গুটিয়ে বসে থেকেছে। নির্বাচনেও জনার্দন রেড্ডি, অশোক চহ্বান, নবীন জিন্দাল, চন্দ্রবাবু নায়ডুদের বিরুদ্ধে এক সময় দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সোচ্চার ছিলেন বিজেপি নেতারা। আজ তাঁরা সবাই বিজেপির নেতা, নায়ডু জোটসঙ্গী। বিগত ১০ বছরে পুঁজিপতিদের ৫৫ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মকুব ও ছাড় দিয়েছে মোদি সরকার।
নির্বাচনী বন্ড দুর্নীতিতে সবচেয়ে বেশি টাকা পেয়েছে বিজেপি। ঘুষের বিনিময়ে অযোগ্য সংস্থাও কাজের বরাত পেয়েছে। ৩৮টি কর্পোরেট গোষ্ঠী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপিকে অনুদান দিয়ে ১৭৯টি বড় কাজের বরাত পেয়েছে। সেই কাজের অর্থমূল্য ৩.৮ লক্ষ কোটি টাকা।
গ্যারান্টি–ভেজাল ওষুধ বাড়বে, দামও হবে আকাশছোঁয়াঃ নির্বাচন কমিশনের ১৪ মার্চ প্রকাশিত তথ্যে জানা যাচ্ছে, নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ৩৫টি ওষুধ উৎপাদনকারী সংস্থা বিজেপি সহ কিছু রাজনৈতিক দলের তহবিলে অনুদান দিয়েছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭টি বড় কোম্পানি তাদের ওষুধের গুণমান পরীক্ষায় ফেল করার পরই ওই বন্ড কিনে টাকা দিয়েছে এবং ফেল করা ওষুধগুলোও বাজারে রমরমিয়ে চলছে।
গ্যারান্টি–চিকিৎসার দশা আরও বেহাল হবেঃ ২০১৭-র ল্যানসেটের তথ্য বলছে, ১৯৫টি দেশের মধ্যে স্বাস্থ্য পরিষেবায় ভারত রয়েছে ১৫৪তে। টিবি, ডায়াবেটিস, কিডনি, হার্টের রোগীরা পর্যন্ত চিকিৎসা পাচ্ছেন না ঠিকমতো। জরুরি ওষুধের দামও আকাশছোঁয়া। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবসার রমরমা। দেশে প্রতিদিন ১০ হাজার মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যায়।
গ্যারান্টি–শ্রমিকের জীবন আরও দুর্বিষহ হবেঃ শ্রমিক উন্নয়নের জন্য গালভরা ‘বিশ্বকর্মা যোজনা’র ঘোষণা করেছে সরকার। অথচ শ্রমিকদের জীবন অন্ধকারময়। সংগঠিত ও অসংগঠিত শ্রমিকদের দুর্দশা ভয়াবহ। বেপরোয়া ছাঁটাই চলছে। শুধু ২০২২ সালেই ৭ লক্ষ ২৪ হাজার ছোট-বড় কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। নামমাত্র আয়ের জন্য বেকার যুবকদের দাস শ্রমিকের মতো খাটতে বাধ্য করছে মালিকরা। ঘণ্টার হিসাব নেই, স্থায়ী শ্রমিক প্রায় নেই, বেশিরভাগ চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক। শ্রমিকদের অধিকার বলে কিছু নেই, এমনকি দাবি জানানোর জন্য প্রয়োজনীয় ট্রেড ইউনিয়ন করারও অধিকার নেই। বিজেপি সরকার ৪৪টি শ্রম আইনকে ছেঁটে ফেলে ৪টি শ্রমকোডে পরিণত করেছে। এর সবগুলিই মালিকদের স্বার্থে তৈরি।
গ্যারান্টি–শিক্ষা আরও দুর্মূল্য হবেঃ নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি শিক্ষার বেসরকারি এবং ব্যয়বহুল করে তুলবে। শিক্ষার সিলেবাসে বিজ্ঞান, যুক্তি, প্রমাণের পরিবর্তে অন্ধবিশ্বাসকে বাড়িয়ে তোলার ষড়যন্ত্র চলছে। লক্ষ লক্ষ শিক্ষক পদ শূন্য, অন্যান্য পরিকাঠামোর চূড়ান্ত অভাব। সরকারের দায় ঝেড়ে ফেলার কারণে শিক্ষার ভগ্নদশা। বেসরকারি স্কুলে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তদের ঘরের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার সুযোগ পেলেও গরিব ঘরের ছাত্রদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দরজা হয়ে যাচ্ছে সম্পূর্ণ বন্ধ।
সাধারণ মানুষকে ভেবে দেখতে হবে, এই সর্বনাশা গ্যারান্টি কি চান তারা?