(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ভোটে জিততে মরিয়া নরেন্দ্র মোদি প্রায় প্রতিদিন পশ্চিমবঙ্গ সফরে আসছেন। প্রতিটি সভাতেই তিনি ‘ডাবল ইঞ্জিন’ অর্থাৎ কেন্দ্র ও রাজ্যে একই দলের সরকার গড়ার ঢাক পেটাচ্ছেন। তাতে নাকি উন্নয়নের রথ বিপুল গতিতে চলবে, সমৃদ্ধির বান ডাকবে রাজ্যবাসীর জীবনে। উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ সহ আরও কয়েকটি রাজ্যে বেশ কিছুদিন ধরে ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি সরকার। প্রধানমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী, ডাবল ইঞ্জিনের জোরে কেমন চলছে সে সব রাজ্য? একবার দেখে নেওয়া যাক।
গুজরাট
বন্ধ কলকারখানা
- শিল্প কল-কারখানায় ব্যাপক সমৃদ্ধ, বিজেপির সুশাসনের ‘মডেল’ রাজ্য নাকি গুজরাট। ১৯৯৫ সাল থেকে একটানা সেখানে সরকারে রয়েছে বিজেপি। ২০১৪ সাল থেকে কেন্দ্রীয় সরকারও বিজেপির দখলে। শিল্পের বাড়বাড়ন্ত হওয়ার বদলে দেখা যাচ্ছে ডাবল ইঞ্জিনের ধাক্কায় গুজরাটে দ্রুত গতিতে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কল-কারখানা। বিধানসভায় খোদ গুজরাট সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ‘গুজরাট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন’-এর অধীনস্থ ২১টি জেলার বিভিন্ন এস্টেটে দেড় হাজারেরও বেশি শিল্পসংস্থা বন্ধ হয়ে গেছে (ইন্ডিয়ান এ’প্রেস, ৫ মার্চ, ২০২১)।
বেকারত্ব ও ছাঁটাই
- সিএমআইই-র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-র এপ্রিলে গুজরাটে বেকারত্বের হার মার্চের ৬.৭ শতাংশ থেকে লাফ দিয়ে বেড়ে ১৮.৭ শতাংশে পৌঁছায় (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ১২ মে, ‘২০)।
- ২০১৯-এর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে দেশের রাজ্যগুলির শহরাঞ্চলে বেকারত্বের হার বিপুল ভাবে বেড়ে গিয়েছিল। শীর্ষে ছিল গুজরাট (বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২০ অক্টোবর, ২০২০)।
- গুজরাটের বিজেপি সরকার নিজেই বিধানসভায় এক প্রশ্নোত্তরে জানায়, রাজ্যের এমপ্লয়মেন্ট এ’চেঞ্জগুলিতে ৪ লক্ষ ৫৮ হাজার শিক্ষিত বেকারের নাম নথিভুক্ত রয়েছে। কর্মহীনের সংখ্যায় সবচেয়ে এগিয়ে আহমেদাবাদ। এর পিছনে রয়েছে ভদোদরা, আনন্দ, রাজকোটের মতো জেলাগুলি। মন্ত্রী আরও জানিয়েছিলেন, এই বিপুল সংখ্যক কর্মহীনের মধ্যে গত দু’বছরে সরকারি কাজ পেয়েছেন মাত্র ২ হাজার ২৩০ জন (পিটিআই, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ‘২০)।
কল-কারখানায় দুর্ঘটনা
- ২০২০-র জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে গুজরাটে কলে-কারখানায় ৮৯টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। মারা গেছেন ১৩০ জনেরও বেশি শ্রমিক-কর্মচারী (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২২ আগস্ট, ‘২০)।
- ২০১৪-২০১৯– এই পাঁচ বছরে গুজরাটে কল-কারখানায় দুর্ঘটনার কারণে প্রাণ হারিয়েছেন ৯৮৯ জন শ্রমিক (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২৫ জুলাই, ২০১৯)।
দারিদ্র্য ও অনাহার
- সরকারি তথ্য থেকেই দেখা যাচ্ছে, বিজেপির মডেল রাজ্য গুজরাটে দারিদ্র্যসীমার নিচে ৩১ লক্ষ ৪৬ হাজার ৪১৩টি পরিবার। ২০১৬ থেকে ‘১৮– এই দু’বছরে আরও ১৮ হাজার ৯৩২টি পরিবার নেমে গেছে গরিবি রেখার নিচে। পরিবারের সদস্যসংখ্যা গড়ে পাঁচজন হলে এই দু’বছরে দুর্দশার অতলে তলিয়ে গেছেন দেড় কোটি মানুষ (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ২৪ মার্চ, ২০১৮)। করোনা অতিমারি ও লকডাউনের ধাক্কায় এই সংখ্যা কতগুণ বেড়েছে, এখনও তার কোনও হিসাব নেই।
- ডিসেম্বর ২০১৯-এর সরকারি তথ্য বলছে, গুজরাটের প্রায় ১৭ শতাংশ মানুষ গরিবি রেখার নিচে দিন কাটান।
- অন্ন সুরক্ষা অধিকার অভিযান গুজরাটে ক্ষুধা ও অনাহারের পরিস্থিতি জানতে সমীক্ষা চালিয়েছিল। তাদের রিপোর্ট বলছে, রাজ্যের ২০.৬ শতাংশ পরিবারের সদস্যদের কোনও কোনও দিন দুপুর ও রাত– দু’বেলাই খাবার জোটে না। দিনের মধ্যে একবেলা সামান্য খাবার জোগাড় করতে পারেন রাজ্যের প্রায় ২২ শতাংশ পরিবার। সমীক্ষার রিপোর্টে আরও জানা গেছে, রাজ্যের বিজেপি সরকারের উদাসীনতা ও অবহেলায় পিছিয়ে-পড়া সম্প্রদায়গুলির বহু গরিব মানুষ রেশন কার্ডের অভাবে প্রাপ্য চাল-গম থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১১ ডিসেম্বর, ‘২০)।
আত্মহত্যা
- রাজ্য বিধানসভায় বিজেপি সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য বলছে, ২০১৮ থেকে ”২০– এই দু’বছরে সেখানে ১৪ হাজার ৭০২ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ২০ জন আত্মঘাতী হয়েছেন (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৩ মার্চ, ‘২০)।
- শুধু ২০১৮ সালেই দারিদ্র্যের কারণে ২৯৪ জন এবং বেকারত্বের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে ৩১৮ জন আত্মঘাতী হন গুজরাটে। আগের বছরের তুলনায় এই সংখ্যাদুটি যথাক্রমে ১৬২ শতাংশ ও ২১ শতাংশ বেশি (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ১১ জানুয়ারি, ‘২০)।
আইন-শৃঙ্খলা, ধর্ষণ ও মহিলাদের ওপর অপরাধ
- মডেল রাজ্য গুজরাটে ৩১ ডিসেম্বর ‘২০-র আগে পর্যন্ত দু’বছরে ১ হাজার ৯৪৪টি খুন, ১ হাজার ৮৫৩টি খুনের চেষ্টা, ৩ হাজার ৯৫টি ধর্ষণ, ৪ হাজার ৮২৯টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। খোদ রাজ্যের বিজেপি সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রিপোর্ট থেকে পাওয়া যাচ্ছে এই পরিসংখ্যান (এনডিটিভি ডট কম, ৪ মার্চ, ‘২১)।
- ২০১৮ থেকে ‘২০– এই দু’বছরে প্রতিদিন গড়ে ৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে গুজরাটে। ঘটেছে গণধর্ষণ ও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুকন্যা ধর্ষণের মতো পৈশাচিক ঘটনাও (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ১২ মার্চ, ‘২০) ।
- ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো-র ২০১৯-এর রিপোর্ট বলছে বিজেপিশাসিত গুজরাটে মহিলাদের ওপর ঘটা অত্যাচারের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ছে।
- মডেল রাজ্য গুজরাটে সাইবার অপরাধের রমরমা চলছে। ২০২০-র জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত মোট ১৬ হাজার ৫০৩টি সাইবার অপরাধের অভিযোগ জমা পড়েছে। এতে খোয়া গেছে ৬১ কোটি ৬৪ লক্ষ টাকা। এর মধ্যে উদ্ধার হয়েছে মাত্র ৬ কোটি ৩ লক্ষ টাকা। তথ্য বলছে, গুজরাটে সাইবার অপরাধ বেড়েছে ৪১৭ শতাংশ (ইন্ডিয়ান এ’প্রেস, ২৮ ডিসেম্বর, ‘২০)।
শহরগুলির চাকচিক্যের আড়ালে নোংরা বস্তির অন্ধকার
বিজেপির ‘মডেল’ গুজরাটে শহরগুলির আপাত ঔজ্জ্বল্যের নিচে চাপা পড়ে রয়েছে অসংখ্য বস্তির চাপ চাপ অন্ধকার। সে অন্ধকার দূর করার বিশেষ চেষ্টা না হলেও বিশেষ বিশেষ সময়ে তা কৌশলে ঢাকা দেওয়ার কাজে সফল হয়েছে সে রাজ্যের বিজেপি সরকার। ২০১৭-র জানুয়ারিতে গুজরাটের গান্ধীনগরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘গ্লোবাল সামিট’। সেখানে যোগ দিতে আসা নানা দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রীদের দৃষ্টি থেকে শহরের বস্তিবাসী মানুষকে আড়াল করতে বিশালাকার কাপড় টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল রাস্তার ধার বরাবর। ওই বছরেই সেপ্টেম্বরে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সস্ত্রীক আমেদাবাদ ও গান্ধীনগরে এসেছিলেন তিন দিনের সফরে। শিলান্যাস হয়েছিল ১ লক্ষ কোটি টাকার বুলেট ট্রেন প্রকল্পের। সেবারেও রাস্তার ধারঘেঁষা বস্তিগুলির বীভৎস দৃশ্য ঢাকতে সবুজ কাপড় টাঙিয়ে দিয়েছিল বিজেপি সরকার। গত বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তিন ঘন্টা গুজরাট সফরে খরচ হয়েছিল ১০০ কোটি টাকা। সেই সময়েও বিপুল সংখ্যক হতদরিদ্র মানুষের বাসস্থান আমেদাবাদ শহরের বস্তিগুলি আড়াল করতে দেওয়াল তৈরি করেছিল গুজরাটের বিজেপি সরকার।
অথচ বিশ্বের দীর্ঘতম মূর্তি গুজরাটেই
মডেল রাজ্যটি থেকে গরিবি, বেকারি, বস্তিতে বস্তিতে অমানুষের মতো জীবনধারণ দূর করতে না পারলেও বিজেপি সরকার বিশ্বের দীর্ঘতম মূর্তিটি সেখানে স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। খরচ হয়েছে জনগণের পকেট থেকে সংগ্রহ করা ২ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা (ইটি, ৩১ অক্টোবর, ‘১৮)। মূর্তি স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জমি জোগাড় করতে উচ্ছেদ হয়েছেন গুজরাটের নর্মদা জেলার ৭২টি গ্রামের ৭৫ হাজার মানুষ।
সম্প্রতি করোনা অতিমারিতে ভয়ঙ্কর বিপর্যস্ত গুজরাট। ব্যাপক সংখ্যক আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসার পরিকাঠামো নেই বিজেপি-র ‘মডেল’ এই রাজ্যটিতে। সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনা হল, কোভিডে মৃত মানুষের সংখ্যা বাস্তবের চেয়ে অনেক কম করে দেখাচ্ছে গুজরাটের বিজেপি সরকার (দ্য হিন্দু, ১৯ এপ্রিল, ‘২১) ।