মেয়েদের প্রথমে ঘরের ভেতরে ঢোকাবে, তারপর সিন্দুকের ভেতর ঢোকাবে, তারপর, হয়তো কোনও চেম্বারের ভেতর ঢুকিয়ে বলবে তোমরা মরো!– ছাত্রীদের উদ্দেশে বলেছিলেন হাওড়ার তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। মেয়েদের সুরক্ষার অজুহাতে তাদের নাইট ডিউটি থেকে বাদ দেওয়ার যে সুপারিশ করেছে সরকার, সেই প্রসঙ্গে রাজ্যবাসীর প্রতিবাদী মনের কথাটি ধরা পড়েছে শিক্ষিকার এই বক্তব্যে। আর জি কর কাণ্ডের পর সম্প্রতি নবান্নের তরফে ১৭ দফা এবং কলকাতা পুলিশের তরফে ১৫ দফা গাইডলাইন প্রকাশ করে বলা হয়েছে সমস্ত সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মহিলাদের নাইট ডিউটি যতটা সম্ভব কম দিতে হবে। যেখানে তা সম্ভব হবে না, সেখানে মেয়েদের দলবদ্ধভাবে থাকতে হবে।
কোনও দায়িত্বশীল সরকার, কোনও প্রশাসন কি এমন ফতোয়া দিতেপারে! এ তো মাথাব্যথা সারাতে মাথা কেটে ফেলার সামিল! এরকম নির্দেশ জারি করার মানে দাঁড়ায়, সমাজ জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে বর্বর অমানুষের দল, তাদের হাত থেকে বাঁচতে মেয়েদের থাকতে হবে লোহার খাঁচায়, ভয়ে ভয়ে, সাবধানে! শুধু হাসপাতালের নার্স কিংবা ডাক্তার অথবা স্কুলের শিক্ষিকা নয়, আইটি সেক্টর থেকে বিমান চালনা, অফিসের কাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য, হকারি, আশা কর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী সর্বত্রই মেয়েরা আজ যথেষ্ট যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। সরকারের এই ফরমান অনুযায়ী হাসপাতালে যদি রাতের শিফটে পুরুষ নার্সই রাখতে হয়, তা হলে রোগিনীরা কি দলবদ্ধভাবে বেডের ওপর বসে থাকবেন? মাঝরাতে কোনও গ্রামের মহিলার প্রসব বেদনা উঠলে দায়িত্বপ্রাপ্ত আশা দিদি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার বদলে দলবল ডাকতে ছুটবেন? রাতের শিফটে কাজ করা সাংবাদিক থেকে কারখানা কর্মী, স্টেশনে সবজি বিক্রি করে গভীর রাতে বাড়ি ফেরা মহিলারা দিনের আলো থাকতে থাকতেই ঘরের কোণে গিয়ে মুখ লুকোবেন? মুখ্যমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে চলা স্বরাষ্ট্র দপ্তর এবং পুলিশের শাসনে মহিলা পুলিশ কর্মীরাও কি এই নির্দেশিকা মেনে সন্ধ্যা নামলেই ঘরে সেঁধোবেন? তাতেই রাজ্যে নারী সুরক্ষার বান ডাকবে? এমনিতেই তো সরকারি মদতে মদ, মাদকের প্রসার, পাড়ায় পাড়ায় শাসক দল-পুষ্ট দুষ্কৃতী বাহিনীর যথেচ্ছ দাপট, অবাধে ব্লু-ফিল্ম, পর্নো-ব়্যাকেট চলতে দেওয়া, যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ সিনেমা ও বিজ্ঞাপনের ব্যাপক প্রসার– সব মিলিয়ে সমাজ পরিবেশে মেয়েদের নিরাপত্তা বিপন্ন করার ব্যবস্থা শাসকরা করেই রেখেছে।
তার উপর এমন অদ্ভুত ‘সুরক্ষাবিধি’ চালু করে প্রকারান্তরে সরকার এবং পুলিশের কর্তারা মেনেই নিচ্ছেন যে তাঁরা চরম অপদার্থ! তাঁরা এ-ও মানছেন, পশ্চিমবঙ্গে নারীর নিরাপত্তা একেবারে তলানিতে নেমেছে!
সরকার ‘সেফ জোন’ তৈরি এবং মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে নারীদের সুরক্ষার বাণী দিয়েছে। মেয়েরা কোন লোহার বেড়ার আড়াল পেলে তবে ‘সেফ’ থাকবেন? যেখানে একজন ডাক্তার তাঁর নিজের হাসপাতালে নিরাপদ থাকতে পারলেন না, সেখানে কোন সেফ জোনের গল্প শোনাচ্ছে সরকার? আর মোবাইল অ্যাপ? যে সবজি বিক্রেতা, পরিচারিকা, আয়ার কাজ করা মহিলারা গভীর রাতের ট্রেন ধরে বাড়ি ফেরেন তাঁরা দিনের রোজগারে দু’মুঠো চাল কেনার হিসাব কষতে কষতেই রাস্তা চলেন। কোথায় পাবেন তাঁরা স্মার্ট ফোন, অ্যাপ? যেখানে রাতের ট্রেন থেকে শুরু করে শহরের রাস্তায় এমনকি থানার ভেতরে পর্যন্ত পুলিশই ভক্ষক, সেখানে কোনটা সেফ জোন?
এর সাথে মিলেছে সমাজ মননে গেড়ে বসে থাকা বস্তাপচা ধর্মীয় কুসংস্কার, গোঁড়ামির পরিমণ্ডল এবং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার আধিপত্য। এর দ্বারা প্রভাবিত উচ্চপদস্থ আমলা থেকে বিচারব্যবস্থার বহু উচ্চ পদাধিকারীও। তা না হলে সরকারি আধিকারিক ও পুলিশ মিলে এমন উদ্ভট নির্দেশিকা জারির কথা কি ভাবতেও পারত! এ যেন সেই প্রাচীন কালের নিদান, মনুর বিধি মেনে যেখানে পথে নারী ছিলেন ‘বিবর্জিতা’। এর আশু ফল হিসাবে মেয়েদের কর্মসংস্থানের সুযোগটাই কমার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় কি! এমনিতেই এ দেশে কর্মর্ক্ষম মেয়েদের কাজের জগতে প্রবেশের হার পুরুষের তুলনায় অনেক কম। পুরুষ-নারীর মজুরির হারেও আছে চূড়ান্ত বৈষম্য। পুরুষের তুলনায় মেয়েদের গড় বেতন অনেকটাই কম। গার্হস্থ্য কাজ, বিনা বেতনে পারিবারিক কুটির শিল্প ইত্যাদি সামলানোতে মেয়েদের সংখ্যা এ দেশে অত্যধিক বাড়ছে। মাতৃত্বকালীন ছুটি, সন্তানের দেখাশোনার জন্য মায়েদের দায়িত্ব, এগুলিকে বহু কোম্পানি মালিকই বাড়তি ঝামেলা হিসাবে দেখে মেয়েদের কাজ থেকে বাতিল করতেই উন্মুখ। এ বার সুরক্ষার অজুহাতে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার যে সুপারিশ করছে তাতে এ রাজ্যের মেয়েদের কর্মহীনতা আরও বাড়বে না কি?
দিল্লির নির্ভয়ার ঘটনার পর ভার্মা কমিশনের সুপারিশে নির্ভয়া তহবিলের মাধ্যমে নারী সুরক্ষার জন্য অনেক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ছিল। কিছু বিজ্ঞাপন ছাড়া কেন্দ্র রাজ্য কোনও সরকারই বিশেষ কিছু করেনি। এই তহবিলের টাকায় এ রাজ্যে নারী ও শিশু নির্যাতনের দ্রুত বিচারের জন্য ১২৩টি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট, পকসো আদালত তৈরির সংস্থান ছিল। হয়েছে মাত্র ৬টি। অথচ রাজ্য সরকারের কর্তারা ‘কড়া আইনে’র জন্য গলা ফটাচ্ছেন! কর্মস্থলে মেয়েদের জন্য পৃথক বিশ্রামাগার, শৌচাগার, সুরক্ষিত রাত্রিনিবাস করার কোনও চেষ্টা রাজ্য সরকার করেছে? একজন মহিলা ডাক্তারও তাঁর কর্মস্থলে মেয়েদের জন্য পৃথক বিশ্রাম কক্ষ কিংবা শৌচাগার পাচ্ছেন কি? দায়টা তবু মেয়েদেরই নিতে হবে!
তা ছাড়া, মেয়েরা কি বাইরে কাজ করে বলে অসুরক্ষিত? ঘরে তাঁরা আক্রান্ত হন না? পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে ঘরে মেয়েদের ওপর আক্রমণের ঘটনা কোনওমতেই কম নয়। বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা এঙ্গেলস দেখিয়েছেন, ‘‘নারীকে যদি মুক্ত করতে হয়, তাকে যদি পুরুষের সমান করতে হয়, তবে সামাজিক উৎপাদনী শ্রম থেকে সরিয়ে রেখে ব্যক্তিগত ঘর-গৃহস্থালীর কাজে তাদের আটকে রেখে তা কখনওই করা যাবে না। নারীর মুক্তি একমাত্র তখনই সম্ভব হবে যখন নারী বৃহদায়তন উৎপাদনের সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং ঘর-গৃহস্থালীর কাজে তাকে খুব সামান্য সময় ব্যয় করতে হবে’’ (পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি)। আজকের দিনের পরিস্থিতি এর ঠিক বিপরীত। একদিন বুর্জোয়া বিপ্লবই ব্যক্তির মুক্তির সাথে সাথে নারীমুক্তির স্লোগান তুলেছিল। আর আজ ক্ষয়িষ্ণু, মুমূর্ষু পুঁজিবাদ ব্যক্তির অধিকারকে যেমন সর্বত্র গলা টিপে মারতে চাইছে, একই ভাবে নারীকেও সে ঘরে ঢোকাতে চাইছে, পুরুষের ভোগের বস্তু করে রাখতে চাইছে। সে জন্য একচেটিয়া পুঁজি তথা সাম্রাজ্যবাদের সংকট মোচনের জন্য উদ্ভূত ফ্যাসিবাদী চিন্তার অন্যতম উদগাতা হিটলারের স্লোগান ছিল ‘উইমেন ব্যাক টু কিচেন’।
এই ভারতে দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের পর ওই হিটলারের অন্যতম অনুগামী হিসাবে পরিচিত সংগঠন আরএসএস-এর সরসংঘচালক মোহন ভাগবত ধর্ষণের জন্য মেয়েদের বাইরে বেরনোকেই দায়ী করেছিলেন। উত্তরপ্রদেশে হাথরসের ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার পর তাঁর শিষ্য বিজেপি নেতাদের গলাতেও ছিল একই সুর। পচা-গলা পুঁজিবাদী সংস্কৃতিই যে ধর্ষকের জন্ম দিচ্ছে, এই সত্যকে আড়াল করতে পুঁজিবাদের সেবাদাস দলগুলো কখনও নারী নিরাপত্তার অভাবের জন্য মেয়েদেরই দায়ী করে, কখনও ‘নির্দেশিকা’র নামে মেয়েদের এক সদা-সাবধানী ভীত-সন্ত্রস্ত জীবন কাটানোর বিধান দেয়। তৃণমূল কংগ্রেসের এই ফতোয়াও তার ব্যতিক্রম নয়।
মহান মানবতাবাদী সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘সমাজে নারীর স্থান নামিয়া আসিলে নর-নারী উভয়ের়ই অনিষ্ট ঘটে, সে-সম্বন্ধে বোধকরি মতভেদ থাকিতে পারে না’’ (নারীর মূল্য)। আজ চরম সামাজিক অবক্ষয় যা নারী নিরাপত্তাকে শোচনীয় পরিস্থিতিতে নিয়ে যাচ্ছে, সেই অবক্ষয় একই সাথে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের প্রতিটি মানুষের জীবনেই বিপর্যয় ডেকে আনছে। বহু পরিবারে শিশুরা পর্যন্ত যৌন বিকৃতির শিকার হয়ে পড়ছে। পারিবারিক জীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে।
নারীকে ঘরের কোণে ঢুকিয়ে দিলে তা সমাজের অর্ধেক নয়, পুরো আকাশেই দুর্যোগের ঘন কালো মেঘ ডেকে আনবে। তাই নির্যাতিতার খুন ধর্ষণের বিচার চেয়ে যে আন্দোলনে নারী-পুরুষ একত্রে নিরাপদেই বিনিদ্র রাত কাটিয়েছে রাস্তায় – সেই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এই অসুস্থ সমাজটাকেই বদল করার লক্ষ্যে। নিজেদের আখের গোছানো এবং সরকারি গদিলাভের সংকীর্ণ স্বার্থে কেউ যাতে আন্দোলনকে বিপথগামী করতে না পারে খেয়াল রাখতে হবে সে দিকেও।