খাদ্যপণ্যের বাজারে আগুন লেগেছে। সর্ষের তেলের দাম আড়াইশো ছাড়িয়েছে। সাদা তেলও দ্রুতগতিতে সেদিকে ছুটছে। চাল-ডাল-গম-আটা কিংবা মাছ-মাংসের কথা নতুন করে না বলাই ভাল। ৫০-৬০ টাকার নিচে সবজির কিলো নেই। পেঁয়াজ ৫০ টাকা, আলু ২২ টাকা কিলো– দাম নাকি আরও বাড়তে চলেছে। গরিবি-বেকারিতে বিপর্যস্ত জীবনে এখন অতিমারি ও লকডাউনের গাঢ় অন্ধকার– চাকরি নেই, থাকলেও মাইনে অর্ধেক। তার ওপর এই ভয়ানক মূল্যবৃদ্ধিতে বাস্তবিকই দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না মানুষ। বাজার করতে গিয়ে এ-মাথা থেকে ও-মাথা পাক খাওয়াই সার হচ্ছে। পকেটের সবটুকু ঢেলে দিয়েও থলে ভরছে না, কেনা জিনিসটুকু তলানিতেই পড়ে থাকছে।
মূল্যবৃদ্ধির এই চড়া আঁচে স্বাভাবিক ভাবেই ঝলসে যাচ্ছে মানুষ। এ বছরের বিশ্ব ক্ষুধা সূচক বা গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। এই সূচক অনুযায়ী ক্ষুধার্ত ও অপুষ্ট মানুষের সংখ্যায় পৃথিবীর ১১৬টি দেশের মধ্যে ভারত দাঁড়িয়ে আছে ১০১-এ। উৎপাদন কম, এমন তো নয়! কিন্তু দাম এতটাই চড়া যে তা মানুষের নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। টাকা ও অস্তে্রর জোরে এশিয়ার মধ্যে শক্তিধর দেশ হিসাবে পেশি ফোলায় যে ভারতের শাসক শ্রেণি, লজ্জার হলেও সত্য, অপুষ্টি ও ক্ষুধার নিরিখে তার স্থান এখন বাংলাদেশ, পাকিস্তানেরও নিচে!
দেশের মানুষের এই বেহাল দশা কি কেন্দ্রীয় কিংবা রাজ্য সরকারগুলির অজানা? গত কয়েক বছর ধরেই একের পর এক সমীক্ষা রিপোর্টে দেশের রুগ্ন ও ক্ষুধাতুর চেহারা তো বারবারই প্রকট হয়েছে! পঞ্চম জাতীয় স্বাস্থ্য সমীক্ষা দেখিয়েছে, গত পাঁচ বছরে শিশু-অপুষ্টি ক্রমাগত বেড়েছে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষায় দেখা গেছে, নিত্যদিনের ব্যবহার্য পণ্যের জন্য আগের চেয়ে অনেকটাই কম খরচ করছেন মানুষ। করোনা অতিমারি কয়েক কোটি মানুষের কাজ কেড়ে নিয়েছে। অর্ধেক বেতনে, কিংবা নিতান্ত সামান্য টাকার বিনিময়ে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন অগণিত মানুষ। মহিলাদের কর্মহীনতা বিরাট আকার নিয়েছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন আরও কয়েক কোটি মানুষ।
এই অবস্থায় যখন কেনার ক্ষমতা তলানিতে ঠেকে না-খেয়ে মরতে বসেছে দেশের অধিকাংশ মানুষ, তখন এই ভয়ঙ্কর মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে সরকার কী করেছে? এক কথায় বলা যায়, কিছুই করেনি। শুধু তাই নয়, এই ভয়ঙ্কর মূল্যবৃদ্ধির জন্য আসলে দায়ী বৃহৎ পুঁজিপতিদের মুনাফা অটুট রাখার একমাত্র কাজে নিবেদিতপ্রাণ সরকারই।
কেন এ কথা বলা, তা ব্যাখ্যার আগে দেখে নেওয়া যাক, সাম্প্রতিক খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পিছনে কারণগুলি কী কী। প্রথমত, পেট্রল, বিশেষত ডিজেলের আকাশছোঁয়া দাম। এর় দরুন পরিবহণ খরচ বেড়েছে। ফলে বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। অসময়ের বৃষ্টিতে অনেক ফসল, বিশেষত শাক-সবজি নষ্ট হয়েছে। পণ্যের জোগান কমেছে বাজারে। ফলে দাম চড়েছে। দাম বৃদ্ধির আর একটি কারণ, লকডাউন ও অতিমারির কারণে বিক্রি কমে যাওয়ায় মুনাফা বজায় রাখতে ব্যবসায়ীদের যেমন খুশি দাম নেওয়া। ফলে চাষিরা দাম না পেলেও বাজারে দাম চড়ছে।
এছাড়া বিজেপি সরকারের রাতারাতি নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিশেষত ছোট ব্যবসায়ীরা প্রবল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। পরিণামে বাজারে খাদ্যপণ্য জোগান দেওয়ার প্রক্রিয়ায় যুক্ত বহু মানুষের ব্যবসা লাটে উঠেছে। এর ওপর অতিমারি ও আচমকা জারি করা লকডাউনের কারণে খাদ্যপণ্য জোগানের গোটা শৃঙ্খলটাই লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। এই গোটা বিষয়টির সম্পূর্ণ দায়ভার কেন্দে্রর বিজেপি সরকার ছাড়া আর কারও নয়।
মূল্যবৃদ্ধির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, কৃষিপণ্য ক্ষেত্রটিতে যত বেশি করে কর্পোরেট পুঁজিপতিরা প্রবেশ করছে, ততই বাড়ছে দাম। ডাল, ভোজ্য তেলের অস্বাভাবিক দামবৃদ্ধি লক্ষ করলেই এ কথার সত্যতা বোঝা যায়। কয়েক মাসের মধ্যে ভোজ্য তেলের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। অথচ খাদ্যপণ্যের ওপর কর্পোরেট পুঁজিপতিদের কব্জা নিয়ন্ত্রণ করা দূরে থাক, তা আরও শক্তিশালী করতে নরেন্দ্র মোদির কেন্দ্রীয় সরকার অত্যাবশ্যক পণ্য আইন সংশোধন করেছে। খাদ্যপণ্য মজুত করার ঢালাও সুযোগ তুলে দিয়েছে বিপুল পুঁজির মালিকদের হাতে। খাদ্যপণ্য মজুত করে রেখে কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে এই বড় ব্যবসায়ীরা দেদার বাড়িয়ে চলেছে সেগুলির দাম।
মূল্যবৃদ্ধির যন্ত্রণায় জেরবার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতি সরকারের যদি এতটুকু দরদ থাকত, তাহলে পেট্রল ও ডিজেলের আকাশছোঁয়া দাম ঠেকাতে তারা কি শুল্ক ও সেসের বিরাট অঙ্কের চেহারা খানিকটা হলেও ছোট করত না? আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির এই দুর্দিনে একটা নির্বাচিত সরকারের কাছে মানুষ তো এটুকু আশা করতেই পারে। কারণ, এ কথা আজ সর্বজনবিদিত যে, পেট্রল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির জন্য মূল দায়ী কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের চাপানো শুল্ক ও সেস। তেলের দাম বাড়লে সরকারের রাজকোষের পাশাপাশি ফুলে ফেঁপে ওঠে তেল-কোম্পানিগুলির মুনাফা। আর মূল্যবৃদ্ধির বোঝায় আরও খানিকটা ঝুঁকে পড়ে সাধারণ মানুষের নুয়ে-পড়া পিঠ।
এই ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধি রুখতে সরকার কি পারত না মজুতদারি নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে? পারত না কি নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যগুলির দামের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দিতে? তাদের কি উচিত ছিল না মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে জারি করা বিধিনিষেধ পালিত হচ্ছে কি না, তা নিয়ে কঠোর নজরদারি চালানো? এই ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি রাজ্য সরকারেরও দায় কিছু কম নয়। কয়েক বছর আগে রাজ্যে তৃণমূল সরকার মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে বিরাট ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ‘টাস্কফোর্স তৈরি করেছিল। কয়েকবার বাজারে বাজারে ঢুঁ মেরে টাস্কফোর্স সেই সময় নিজের অস্তিত্ব জাহিরও করেছিল। মানুষ প্রশ্ন তুলছে, আজকে এই ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধির দুর্দিনে কোথায় তাঁরা? কোথায় গেল রাজ্যের মানুষকে ভালো রাখার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি? কোথায় কেন্দ্রীয় সরকারের তথাকথিত আচ্ছে দিন?
আসলে খেটে-খাওয়া মানুষ, দেশের জনসংখ্যার সবচেয়ে বড় অংশটি দখল করে রয়েছেন যাঁরা, তাঁদের ভাল-মন্দ, জীবন-মরণের প্রতি কি কেন্দ্র কি রাজ্য– কোনও সরকারেরই কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। পুঁজিবাদী এই রাষ্ট্রে, দেশের আসল মালিক পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফার সেবায় নিবেদিতপ্রাণ তারা। তাই মানুষ মরছে মরুক, সরকারের কিছু যায় আসে না। তারা ব্যস্ত খাদ্যপণ্যের ব্যবসায় বৃহৎ পুঁজির মালিকদের প্রবেশের ঢালাও সুযোগ করে দিতে। তার জন্য আইন পাল্টেফেলতেও দু’বার ভাবেনি তারা।
এই অসহনীয় পরিস্থিতির অবসানের দাবিতে খেটে-খাওয়া মানুষের জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া বাঁচার রাস্তা নেই। সঠিক নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে জনস্বার্থবিরোধী সরকারগুলির বিরুদ্ধে দাবি তুলতে হবে– ‘খাদ্যপণ্যের দাম কমাতে অবিলম্বে ব্যবস্থা নাও’, ‘বড় পুঁজিপতিদের মুনাফার স্বার্থে খেটে-খাওয়া মানুষের ঘাড়ে কোপ বসানো চলবে না’। আন্দোলনের প্রবল চাপই একমাত্র পারে এই নির্লজ্জ সরকারগুলিকে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে বাধ্য করতে।