মালেগাঁও বিস্ফোরণ কাণ্ডে অভিযুক্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল শ্রীকান্ত পুরোহিত ও সাধ্বী প্রজ্ঞা সহ চার জনকে মহারাষ্ট্র সংগঠিত অপরাধ আইন (মকোকা) থেকে রেহাই দিল বিশেষ আদালত৷ ২৮ ডিসেম্বর এনআইএ আদালত জানিয়েছে, কেবল সন্ত্রাস দমন আইন ইউএপিএ–তে ওই অভিযুক্তদের বিচার হবে৷ শুধু তাই নয়, অন্য তিন অভিযুক্ত শিবনারায়ণ কালসাঙ্গরা, শ্যাম সাহু ও প্রবীণ তক্কালকিকে মামলা থেকে পুরোপুরি রেহাই দেওয়া হয়েছে৷
২০০৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মহারাষ্ট্রের মালেগাঁওয়ে একটি বাইকের মধ্যে রাখা আরডিএক্স–এর মতো শক্তিশালী বিস্ফোরক ফেটে সাত জনের মৃত্যু হয়েছিল৷ আহত হয়েছিলেন শতাধিক মানুষ৷ এই ধরনের বিস্ফোরক নিয়ে কোনও সাধারণ মানুষ ঘোরাফেরা করেন না৷ স্বভাবতই, অভিযোগের আঙুল উঠেছিল প্রভাবশালী মহলের দিকে৷ মালেগাঁও মুসলিম অধ্যুষিত৷ এর আগে ২০০৬ সালে সেখানে এক বিস্ফোরণে ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল৷ ২০০৬ সালেই বিস্ফোরণে জড়িত থাকার অভিযোগে ‘অভিনব ভারত’ সংগঠনের সদস্য সাধ্বী প্রজ্ঞা ও পুরোহিত সহ ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল৷ অভিনব ভারত সংগঠনটি বকলমে বিজেপির ছত্রছায়ায় লালিত–পালিত, এমন অভিযোগ পূর্বেই উঠেছে৷
মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলার দায়িত্ব ছিল প্রথমে মহারাষ্ট্র পুলিশের সন্ত্রাস দমন শাখার হাতে, এরপর দায়িত্ব পায় এনআইএ৷ বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদি কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন হয়ে এই মামলায় অভিযুক্তদের ছাড়ানোর চেষ্টা শুরু করেন৷ প্রাক্তন সরকারি আইনজীবী অভিযোগ করেন, সরকার বদলের পরেই এনআইএ তাঁকে এই মামলা থেকে সরিয়ে দিয়েছে৷
১০ বছর হতে চলল, এখনও এই বিস্ফোরণ কাণ্ডে অভিযুক্তদের শাস্তি হল না৷ সাধ্বী প্রজ্ঞা ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল পুরোহিত বর্তমানে জামিনে মুক্ত৷ এদের শাস্তি দেওয়া দূরের কথা, মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলাটিকেই লঘু করে দেওয়া হল৷ এর ফলে দিন যত গড়াবে, নাম কা ওয়াস্তে মামলার শুনানি চলতে চলতে অভিযোগ থেকে পুরোপুরি অব্যাহতি পাওয়ার সুযোগ পাবে সন্ত্রাসবাদীরা৷
আর একটি মামলায় একইভাবে রেহাই পেয়ে গিয়েছিল অভিযুক্তরা৷ গুজরাটের বুকে সংঘটিত সোহরাবুদ্দিন হত্যা মামলা৷ তার কোনও বিচার হয়নি৷ গুজরাট পুলিশ সোহরাবুদ্দিনকে হত্যা করার আগে তাঁকে ও তাঁর স্ত্রী কৌসর বাঈকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল৷ তারপর সোহরাবুদ্দিনকে হত্যা করে পুলিশের সাথে ‘এনকাউন্টারের’ গল্প শুনিয়েছিল৷ তাঁকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছিল পুলিশ, এ কথা কৌসর বাঈ প্রকাশ্যে আনায় তাঁকে মেরে কবরে পুঁতে দিয়েছিল তারা৷ সোহরাবুদ্দিন ও কৌসর বাঈ–এর অপহরণের একমাত্র সাক্ষী তুলসীরাম প্রজাপতি বারবার আদালতের কাছে তাঁর জীবন সংশয়ের কথা তুলে ধরেছিলেন৷ বেশি সময় না দিয়ে গুজরাট পুলিশ কর্তারা তাঁকেও হত্যা করে সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট করে দেয়৷ সেই সময় গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন অমিত শাহ৷ তারই মদতে পুলিশ অফিসাররা এক হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিতে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলে৷ এমনকী ২০১৪ সালে সোহরাবুদ্দিন হত্যা মামলার বিশেষ সিবিআই আদালতের বিচারপতি ব্রিজগোপাল হরকিষাণ লোয়াকে নাগপুরের এক সরকারি গেস্টহাউসে রহস্যজনক ভাবে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়৷ তাঁর পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, মৃত্যুর আগে বিচারপতি লোয়া বেশ কিছু শাসানি–ফোন এবং ঘুষের বরাত পেয়েছিলেন৷ তাঁকে সোহরাবুদ্দিন হত্যা মামলায় অভিযুক্তদের পক্ষে সন্তোষজনক রায় দিতে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিল কেউ বা কারা৷ বোঝাই যাচ্ছে, ক্ষমতার হাত কত লম্বা এবং তা অভিযুক্তদের রেহাই দিতেই সক্রিয় হয়েছিল৷
দুটি ঘটনার প্রেক্ষাপটই সংখ্যালঘু নিধন৷ মোদিজি ও তাঁর দল বিজেপি রাজ্যে রাজ্যে যতই ‘উন্নয়ন’–এর গল্প শোনান না কেন, মানুষকে বিভ্রান্ত করার হাতিয়ার কিংবা নির্বাচনে তাঁদের জেতার তুরুপের তাস একটাই– হিন্দুত্বের জিগির৷ সেটা বিজেপি নেতারাও আর রাখঢাক করতে পারছেন না৷ মালেগাঁও বিস্ফোরণে অভিযুক্ত হিন্দুত্ববাদীদের ‘মাকাকা’ থেকে রেহাই দেওয়ার ঘটনায় তা প্রমাণিত৷ সাধারণ খেটে–খাওয়া মানুষ হিন্দু কিংবা সংখ্যালঘু মানুষের উন্নয়নের সাথে হিন্দুত্ববাদের কোনও যোগ নেই৷ ভারতবর্ষের মানুষ সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা নিশ্চয়ই প্রতিহত করতে পারবে৷