৫ অক্টোবর থেকে ১৯ নভেম্বর দীর্ঘ দেড় মাসব্যাপী ক্রিকেটের তিন ফর্ম্যাটের মধ্যে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় এক-দিনের ক্রিকেট বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতার ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে অস্ট্রেলিয়া রেকর্ডসংখ্যক ছয় বার চ্যাম্পিয়ন হল। ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীরা দেশের মাটিতে কাপ-জয়ের দোরগোড়ায় এসে এই পরাজয়ে দুঃখ পেতে পারেন। কিন্তু খেলায় জয়-পরাজয় আছেই। ১৯ নভেম্বর ফাইনালে ক্রিকেটের সব বিভাগেই যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে অস্ট্রেলিয়া জয়ী হয়েছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বিপক্ষ দেশের লক্ষাধিক দর্শকের সামনে টুর্নামেন্টে একটানা অপরাজিত থাকা একটি দলকে হারানো নিশ্চিতভাবেই তারিফযোগ্য। কিন্তু দেখা গেল, অস্ট্রেলিয়ার জয়ের সম্ভাবনা স্পষ্ট হতেই স্টেডিয়াম নীরব হয়ে গেল। বহু দর্শক খেলা শেষ হওয়ার আগেই মাঠ ছাড়লেন। যাঁরা বসে থাকলেন, তাদের মুখও ছিল ম্রিয়মান। অস্ট্রেলীয়রা বাউন্ডারি মারলে মাঠে ছিল শ্মশানের নীরবতা। কঠিন পিচে শক্তিশালী ভারতীয় বোলিংয়ের মোকাবিলা করে ট্রাভিস হেড যখন অসাধারণ সেঞ্চুরি করলেন, তখন কয়েকটা মাত্র হাততালির শব্দ শোনা গেল। যে ফাইনাল ম্যাচের টিকিটের চাহিদা ছিল আকাশচুম্বী, এমনকি পুলিশের নাকের ডগায় লাখ লাখ টাকায় যে ম্যাচের টিকিটের কালোবাজারি হয়েছে, সেই ম্যাচের পুরস্কার-বিতরণী অনুষ্ঠান পর্যন্ত অপেক্ষা করার ইচ্ছে দর্শকদের একটা বড় অংশেরই ছিল না। এই মনোভাবকে আর যাই বলা যাক, খেলোয়াড়োচিত নিশ্চয়ই বলা যাবে না। বিশ্বকাপ ফুটবল কিংবা অলিম্পিক গেমসের সাথে তুলনা করলে যে কারও ধারণা হবে ভারতীয় দর্শকরা বোধহয় বিপক্ষের সাফল্যকে সম্মান জানাতে ভুলে গিয়েছে! ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক নাসের হুসেন বলেছেন, মনে হচ্ছিল একটা ফাঁকা স্টেডিয়ামে খেলা হচ্ছে। ভারতীয় ফ্যানদের অন্তত একটু লজ্জিত হওয়া উচিত। অথচ ১৯৮৩ সালে ইংল্যান্ডের মাঠে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে সন্দীপ পাতিল যখন উইনিং স্ট্রোক নিচ্ছেন, তখন বব উইলিসের নেতৃত্বে গোটা ইংল্যান্ড দল হাততালি দিয়ে তাঁকে অভিবাদন জানিয়েছিল। এমনটাই তো হওয়া উচিত। কিন্তু ভারতে ক্রিকেটকে এখন খেলার পরিবর্তে একটা যুদ্ধে পরিণত করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে দেশের শাসক দলের নেতাদের ভঙ্গিমা– সব ক্ষেত্রেই খেলাকে কেন্দ্র করে একটা ‘যুদ্ধং দেহি’ ভাব। জুড়ে যাচ্ছে সাম্প্রদায়িক মনোভাবও। মহম্মদ শামি খারাপ পারফর্ম্যান্স করলে তার ধর্ম নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে, ‘হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটিতে’ খোঁচা দেওয়া, ট্রোল করা চলছে। ‘ভারত বনাম পাকিস্তান’ যে কোনও ম্যাচকে ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বানিয়ে তুলছে দেশের শাসকরা। খেলা নিয়ে উন্মাদনার বন্যায় দেশের মানুষকে ভাসিয়ে দিয়ে জীবনের মূল সমস্যাকে ভুলিয়ে দেওয়া– এ সব দীর্ঘ দিন ধরে চলছে।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটে (২০২৩) যে দলই জিতুক না কেন, তাতে বিশ্ব ক্রিকেট সংস্থা আইসিসি কিংবা বিশ্বের সর্বাপেক্ষা ধনী ক্রিকেট সংস্থা ভারতের বিসিসিআই-এর রোজগারে কোনও পরিবর্তন আসবে না। ব্যাঙ্ক অফ বরোদার হিসাব অনুযায়ী, এবারের প্রতিযোগিতার ব্রডকাস্টিং রাইটস থেকে আইসিসি পেয়েছে ৩৫০০ থেকে ৪০০০ কোটি টাকা। স্পনসরশিপ থেকে আয় ১২৫০ কোটি টাকা। পুরস্কারমূল্য বাবদ আইসিসিকে দিতে হয়েছে ৮৩ কোটি টাকা। এই প্রতিযোগিতা থেকে আইসিসি-র উপার্জন ১০-১২ হাজার কোটি টাকা। তাদের পক্ষ থেকে আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল ২০২৪ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত আইসিসি তার মোট উপার্জনের ৩৮.৫ শতাংশ ভারতকে দেবে। সেই অনুযায়ী এবারের মেগা টুর্নামেন্ট থেকে বিসিসিআই-এর লাভ প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে আছে টিকিট বিক্রি বাবদ প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। বিসিসিআই ১০টি ক্রিকেট স্টেডিয়াম সাজানোর জন্য ৫০ কোটি টাকা দিয়েছে। কিন্তু, সব খরচ করেও বিসিসিআই বিপুল আর্থিক মুনাফা করেছে। আর এর ফলেই তারা আইসিসিকে নিজেদের মর্জিমাফিক ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পিচ বদল থেকে শুরু করে আয়োজক দেশের সুবিধা অনুযায়ী পিচ বানানো ইত্যাদি অভিযোগ তুলেছে সংবাদমাধ্যমের একাংশ। যদিও আইসিসি সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
খেলোয়াড়সুলভ মানসিকতার অভাব
সমগ্র পৃথিবীতেই ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, টেনিস, ব্যাডমিন্টন, কুস্তি, বক্সিং, অ্যাথেলেটিক্স– বিভিন্ন ধরনের ক্রীড়াকে কেন্দ্র করে শরীরচর্চা যেমন হয়েছে, তেমনই এর মধ্য দিয়ে দেশাত্মবোধের প্রকাশও ঘটেছে। খেলার সঙ্গে চর্চা হয়েছে বৌদ্ধিক-শক্তি, একতাবোধ, খেলোয়াড়সুলভ মানসিকতার। এসব কিছু মিলিয়ে ক্রীড়া একটি উন্নত শিল্প রূপেই সমাদৃত বিশ্ব জুড়ে। অলিম্পিকের আসরে শুরু থেকে জড়িয়ে ছিল এক উন্নত নৈতিকতা। পেশাদারি খেলার জগতেও এই নৈতিকতার চর্চা হয়েছে। ফুটবলের সর্বোচ্চ আসরে বিপক্ষের গোলকিপার বা ডিফেন্ডার মাঠে পড়ে গেলে নিশ্চিত গোল উপেক্ষা করে রেফারিকে খেলা থামানোর অনুরোধ করছেন ফরোয়ার্ড– এমন ঘটনা বিরল নয়। খেলার নৈতিকতা বলে খেলায় জেতাটাই বড় কথা নয়, অংশগ্রহণটাই বড়– এমন ঘটনাও আছে। স্পেনের বুর্লাডায় অনুষ্ঠিত আন্তর্দেশীয় অ্যাথলেটি’ প্রতিযোগিতায়। স্পেনের অ্যাথেলিট ইভান ফার্নান্ডেজ অ্যানায়া দ্বিতীয় স্থানে দৌড়তে দৌড়তে লক্ষ করেন প্রথম স্থানে থাকা কেনিয় প্রতিযোগী আবেল মুতাই দৌড় সম্পূর্ণ হয়ে গেছে ভেবে ভুল করে ১০ মিটার আগে থেমে গেছেন। ভুলের সুযোগ নিয়ে সহজেই জিততে পারতেন ইভান। কিন্তু তিনি ভুলটা বুঝিয়ে দিয়ে আবেলকে সাহায্য করেছেন জিততে। কেন তিনি এমন করলেন জিজ্ঞাসা করায় ইভান বলেন, ‘আমি ওই জয়ের যোগ্য ছিলাম না।’ ক্রিকেটেও এমন ঘটনা আছে।
ক্রিকেট এখন পণ্য
সত্তরের দশকের ধনকুবের কেরি প্যাকারের টাকার আনুকুল্যে বেশ কিছু নামী ক্রিকেটার বর্ণবৈষ্যবাদী তৎকালীন দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল।সঠিকভাবেই মানুষ প্রশ্ন তুলেছিল, ‘টাকা রোজগার করাটাই কি বড় কথা?’ আর আজ আইপিএল-এর জন্য ক্রিকেটার নিলাম হচ্ছে। ক্রিকেটাররা যেন ‘হস্তিনাপুর রাজসভা’য় পাশা-খেলার পণের সামগ্রী। এখন বর্ষাকালেও ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। বিশ্বকাপের মতো প্রতিযোগিতার আগে-পরে ঠাসা ক্রীড়াসূচি থাকছে প্রায় সব দলের ক্রিকেটারের। ফলে পারফর্ম্যান্সে প্রভাব পড়ছে। ভারতের অধিনায়ক থেকে শুরু করে বর্তমানে বহু ক্রিকেটার টিভিতে জুয়াখেলার বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। তাদের লক্ষ্য ক্রিকেটের নামে কত অর্থ পকেটে ভরা যায়।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের মঞ্চকেও ব্যবহার করতে চেয়েছেন মোদি, অমিত শাহরা
এবারের বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা হয়েছে আমেদাবাদের যে স্টেডিয়ামে সেই মোতেরা স্টেডিয়াম দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের একটি বড় মঞ্চ। ২০২১ সালে এইস্টেডিয়ামের নাম নিজের নামে রাখেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কেবল ভারত নয়, বিশ্বের কোথাও এমন নির্লজ্জতার উদাহরণ বিরল। মধ্যযুগের রাজা-মহারাজাদের মতো নিজের নামাঙ্কিত সেই স্টেডিয়ামে ফাইনালের দিন সপারিষদ উপস্থিত ছিলেন মোদি, অমিত শাহরা। দেশের ধনীতম ক্রীড়াসংস্থা বিসিসিআই-এর সচিব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পুত্র জয় শাহ, কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ সিং ঠাকুর ইত্যাদিরাও ছিলেন। স্টেডিয়ামে মুহুর্মুহু উঠছিল ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান। ঠিক যেমন ইসরোর সফল চন্দ্রাভিযানের পর গোটা দেশকে জোর করে নরেন্দ্র মোদির মুখ দেখানো, ভাষণ শোনানো হয়েছিল, তেমনই ফাইনালে ভারতের সম্ভাব্য বিজয়ের পরেই আরও একবার কৃতিত্ব নেওয়ার মঞ্চ প্রস্তুত করাই ছিল বলে অনেকের অনুমান। কিন্তু ফাইনালের ফল সেই পরিকল্পনায় জল ঢেলে দেওয়ায় পুরস্কার-বিতরণ মঞ্চ থেকে প্রধানমন্ত্রী দৃষ্টিকটুভাবে প্রস্থান করেছেন।
কুসংস্কার, ধর্মীয় আচার নয়, নিবিড় অনুশীলনই সাফল্য আনতে পারে
এমনিতেই ক্রিকেট, ফুটবল সহ নানা খেলায় কুসংস্কারের ব্যাপক প্রভাব আছে। তার উপরে গত এক দশক ধরে বিজেপি শাসনে এইগুলি ব্যাপক ভাবে বেড়েছে। সুতরাং, ভারত সেমিফাইনালে ওঠার পর থেকে শুরু হয়ে গিয়েছিল মন্দিরে, দরগায় প্রার্থনা, মানত করা। অনেক জ্যোতিষী ভারত ‘চ্যাম্পিয়ন’ হবে বলে ঘোষণা করে দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অন্ধ কুসংস্কার নয়, ভবিষ্যদ্বাণীও নয়– খেলার মাঠে জয়পরাজয় নির্ধারিত হয় সেই দিনের পারফর্ম্যান্স দিয়েই। তাই ভারত যেমন ভাল খেলে নিউজিল্যান্ডকে সেমিফাইনালে হারিয়েছে, তেমনই অস্টে্রলিয়া ভালো খেলেই ফাইনালে ট্রফি জিতেছে। এখানে অলৌকিকতার কিংবা পয়া-অপয়ার কোনও ঠাঁই নেই। নিবিড় অনুশীলন, সঠিক প্রশিক্ষণ, সঠিক পরিকল্পনাই সাফল্য নিয়ে আসে। আবারও তা প্রমাণ হল বিশ্বকাপ ফাইনালে।