মহারাষ্ট্রের ধারাভি বস্তির উন্নয়ন প্রকল্প কার স্বার্থে

বাণিজ্য নগরী মুম্বাইয়ের একেবারে কেন্দ্রে অবস্থান করছে এশিয়ার বৃহত্তম বস্তি ধারাভি। প্রায় আড়াই বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে সেখানে বাস করেন ১০-১২ লক্ষ মানুষ। ওই এলাকার মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রায় ৫ হাজার ছোট বড় কারখানা। এখানকার চামড়ার কাজ, মাটির কাজ, জামাকাপড, প্লাস্টিক রিসাইক্লিংজাত দ্রব্য ইত্যাদি শুধু মুম্বাই বা ভারত নয়, ছড়িয়ে পড়ে এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে। গোটা মুম্বাই শহরের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এই ধারাভি বস্তিতে বসবাসকারী মানুষগুলির অবদান অনন্য। কাকভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এদের শ্রম নিংড়ে মুম্বাই হয়ে ওঠে আলোকোজ্জ্বল নগরী।

অথচ বস্তির এই মানুষগুলির বসবাস অন্ধকারে। সুস্থভাবে এক জনের চলবার মতো প্রশস্ত গলিও এখানে কম, মধ্য দুপুরেও বহু জায়গায় পৌঁছয় না সূর্যের এক বিন্দু আলো। পাশের নদী মজে এখন আবর্জনাময় নালা। প্রায়ই সেই নোংরা জল ঢুকে আসে বস্তির এক চিলতে ঘরের ভিতর। নেই পর্যাপ্ত পরিশুদ্ধ পানীয় জল, প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্ন শৌচাগার, যথাযথ অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা। শিশুরা প্রায়ই আক্রান্ত হয় টাইফয়েড, কলেরা, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি ব্যাধিতে। পুতিগন্ধময় এই পরিবেশে বস্তির মানুষগুলির গড় আয়ু কমে দাঁড়িয়েছে ৩৯ বছরে।

ধারাভির উন্নয়ন নিয়ে মহারাষ্ট্র সরকারের পরিকল্পনা চলছে দশকের পর দশক ধরে। গত বিধানসভা নির্বাচন ঘোষণার ঠিক একদিন আগে সরকার প্রতিশ্রুতি দেয় ধারাভি বস্তির পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লক্ষ মানুষকে তারা পুনর্বাসন দেবে। প্রচার করে এশিয়ার এই বৃহত্তম বস্তিকে তারা আধুনিক ‘আরবান হাব’-এ পরিণত করবে। দরিদ্র বস্তিবাসী মানুষগুলির জীবনের দুর্বিষহ অবস্থায় চিন্তিত সরকার যদি কোনও পদক্ষেপ নেয় সে তো আশারই কথা। কিন্তু তা কি হচ্ছে?

১০-১২ লক্ষ মানুষের মধ্যে যদি পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লক্ষ মানুষকে পুনর্বাসন দেওয়া হয় তবে বাকিরা যাবেন কোথায়? বাসিন্দাদের কাছে কোনও পরিষ্কার চিত্র নেই, নেই কর্তৃপক্ষের দিক থেকে স্বচ্ছ কোন উত্তরও। বিশেষ করে ওই বস্তিতে যে মানুষগুলি ঘরভাড়া নিয়ে বছরের পর বছর ধরে বসবাস করছেন, তাঁদের কী হবে, নতুন প্রকল্পে থাকার জন্য ঘর মিলবে কি না– তাও সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। ফলে প্রবল আশঙ্কায় দিন কাটছে মানুষগুলির। শুধু উচ্ছেদ হওয়ার ভয় নয়, ধারাভির বর্তমান বাসিন্দারা এরই সঙ্গে রুজি-রোজগার হারানোর আতঙ্কেও ভুগছেন। কারণ, এই বস্তিতে থাকা অগুন্তি ছোট কারখানা তাঁদের দু’বেলার খাবার জোগায়।

লক্ষণীয় বিষয় হল, মহারাষ্ট্র সরকারের স্লাম রিহ্যাবিলিটেশন অথরিটি (এসআরএ) ধারাভি রিডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (ডিআরপি) জমি বাছাই থেকে অন্যান্য প্রায় সমস্ত দায়িত্ব দেশের একচেটিয়া শিল্পপতি আদানির হাতে তুলে দিয়েছে। ডিআরপি, যাকে এখন এনএমডিপিএল (নবভারত মেগা ডেভলপমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড) বলা হচ্ছে, সেই এনএমডিপিএল-এর ৮০ শতাংশ শেয়ার আদানিদের হাতে, বাকি ২০ শতাংশ স্লাম রিহ্যাবিলিটেশন অথরিটির হাতে রয়েছে।

দেখা যাচ্ছে, এই এনএমডিপিএল ধারাভি বস্তির পুনর্বাসন প্রকল্পের জন্য মুম্বাইয়ের যে দিওনার এলাকায় জমি বেছে নিয়েছে তা বাস্তবে একটি চালু ধাপার মাঠ। সিপিসিবি (সেন্ট্রাল পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ড)-এর ২০২১ গাইডলাইন অনুসারে একটি বন্ধ হয়ে যাওয়া আবর্জনা কেন্দ্রে কোনও হাসপাতাল বা স্কুল তৈরি করা যায় না। আবর্জনা কেন্দ্রের সীমানা থেকে ১০০ মিটারের মধ্যে কোনও উন্নয়ন প্রকল্প তৈরি করা যায় না। প্রশ্ন উঠছে, নিয়ম যদি তা-ই হয় তবে দিওনারের মতো একটি চালু ধাপার মাঠে আবাসস্থল তৈরির ছাড়পত্র মিলল কী ভাবে? ২০২৪ সালের সিপিসিবি রিপোর্ট অনুসারে, দিওনারের বাতাসে ছড়িয়ে আছে বিষাক্ত গ্যাস। প্রতি ঘন্টায় ওই এলাকায় ৬২০২ কেজি বিষাক্ত মিথেন নির্গত হচ্ছে। ভারতের ২২টি প্রধান মিথেন হটস্পটের মধ্যে দিওনার একটি। আবর্জনার তরল ও মাটির তলার জলের সংযোগে ওই এলাকার জলও ব্যাপক দূষিত। এখানে রয়েছে দুটি প্ল্যান্ট– একটি ওয়েস্ট টু এনার্জি (ডব্লিউটিই) ও অন্যটি বায়ো সিএনজি। পুনর্বাসন প্রকল্পটি তৈরি হতে চলেছে দুটি প্ল্যান্টের প্রায় ৫০ মিটার দূরত্বের মধ্যে। নিয়ম অনুসারে কোনও ডব্লিউটিই প্ল্যান্টের ৩০০ থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে আবাসস্থল থাকা উচিত নয়। ডব্লিউটিই প্ল্যান্ট থেকে যে ছাই ও ধোঁয়া নির্গত হয় তা এলাকায় ব্যাপক বায়ু দূষণ ঘটায়। জানা গেছে, এই প্রকল্পের এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট অর্থাৎ পরিবেশের প্রভাব সংক্রান্ত সমীক্ষা এখনও পর্যন্ত করা হয়নি, যা প্রকল্পের পরিকল্পনার সময়েই করে ফেলার কথা। এ ব্যাপারে প্রশ্নের উত্তরে মহারাষ্ট্রের উপমুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডে বলেছেন ‘নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার আগে সমস্ত প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র নিয়ে নেওয়া হবে।’ এ কথা পরিষ্কার যে, সরকারি প্রভাব খাটিয়ে কোনও রকম নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই এটা তাঁরা করে ফেলবেন।

বাস্তবে ধারাভির মানুষগুলিকে এক আঁস্তাকুড় থেকে আরেক আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলা হতে চলেছে। এই যে আবর্জনা কেন্দ্রের ভিতরে ব্যাপক দূষণের মধ্যে এক মৃত্যু-উপত্যকায় পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লক্ষ মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে বিজেপি সরকার, এর কারণ কী? সরকারি দপ্তরগুলি একে অপরের উপর দায় চাপিয়ে অস্বস্তিকর প্রশ্ন এড়াচ্ছে। প্রকল্পের সর্বাধিক শেয়ারের মালিক আদানিদের তরফ থেকে কোনও উত্তর নেই। ডিআরপি-র সিইও ও এক সিনিয়র আইএএস অফিসার শ্রীনিবাস প্রশ্নের উত্তরে মুম্বাইয়ের জমি সংকট ও বিকল্প জমির সংখ্যা কম হওয়ার কথা বলেন। বলেন, ‘ডিআরপি’-র জন্য ২০০ থেকে ৩০০ একর জমির প্রয়োজন। তাই এর অসুবিধাগুলি জানা সত্ত্বেও দিওনারকে বেছে নিতে হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, এই অসুবিধাগুলি জানা সত্তে্বও কোনও সরকারি আধিকারিক বা সরকারের কোনও মন্ত্রী কি পরিবারসহ বসবাস করতে পারবেন ওই এলাকায়? নাকি আদানি সাহেব ওখানে তাঁর কোনও অফিস খুলতে পারবেন? উত্তরটা সকলেরই জানা। এ কেবল দরিদ্র বস্তিবাসীদের জীবন নিয়ে এক নিষ্ঠুর পরিহাস মাত্র।

আসলে মুম্বাই শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত ধারাভি বস্তির বিপুল পরিমাণ জমি আদানি সাহেবের চাই। তিনি সেখানে প্রোমোটিং করে লক্ষ কোটি টাকা মুনাফা লুটবেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এই একচেটিয়া শিল্পপতির আবদার তো যে কোনও মূল্যে রাখতেই হবে মহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকারের কর্তাদের। তাই উন্নয়নের নামে গোটা বস্তি এলাকাটিকে তুলে দেওয়া হয়েছে আদানিদের হাতে। সেখানকার উচ্ছেদ হতে চলা হতদরিদ্র বাসিন্দাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা দেখার দায়িত্বও তুলে দেওয়া হয়েছে আদানি-কোম্পানিরই ওপরে। আদানি সাহেব তো আর সমাজসেবার উদ্দেশ্য নিয়ে কাজে নামেননি! তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য, প্রোমোটিং ব্যবসায় বিপুল মুনাফা লোটা। সেই লুটের ধাক্কায় দিন আনা-দিন খাওয়া ধারাভি বস্তির বাসিন্দাদের অন্ধকার জীবন যদি আরও বেশি সর্বনাশের অতলে তলিয়ে যায়, তো যাক না! আদানি সাহেবরা তার জন্য চিন্তিত নন। তাই বিষাক্ত গ্যাসে ভরা চরম অস্বাস্থ্যকর আবর্জনাময় একটি অ-বাসযোগ্য এলাকাই নির্ধারিত হয়েছে দুর্ভাগা এই মানুষগুলির বসবাসের জন্য। আদানি সাহেবদের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ একচেটিয়া কারবারিদের মুনাফার কাছে এইসব হতদরিদ্র মানুষগুলির জীবনের দাম আর কতটুকুই বা! তাই মহারাষ্টে্রর বিজেপি সরকারও এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সেবায় তাঁরা দাসখত লিখে দিয়েছেন যে!

হায় রে পুঁজিবাদী সভ্যতা! ধনগর্বে ঝলমল করতে থাকা এই মুম্বাই শহরের সবটুকুই যে গড়ে উঠেছে ধারাভি বস্তির বাসিন্দাদের মতো অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষের ঘাম-রক্ত ঝরানো পরিশ্রমের বিনিময়েই! এই বস্তির বিশাল এলাকা জুড়ে আগামী দিনে তৈরি হবে যে সব বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট বা উচ্চবিত্তদের বসবাসের ফ্ল্যাট, সেগুলিও হয়তো গড়ে উঠবে এখানকার উচ্ছেদ হওয়া মানুষগুলিরই মেহনতে। সামান্য মজুরির বিনিময়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে ধনীদের প্রাসাদ গড়ে দিয়ে দুর্ভাগা এই মানুষগুলি ফিরে যাবে দিওনারের আঁস্তাকুড়ে নিজেদের ডেরায়। যতদিন জীবনীশক্তি থাকবে, ততদিন এভাবেই তাঁরা কাটিয়ে যাবেন অ-মানুষের জীবন।

এঁদেরই ভোটে জিতে ক্ষমতায় বসে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কর্তারা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে যাবেন এই ঘোরতর অন্যায় আর অবিচারকে। কিন্তু এই অন্যায়-অবিচার মেনে নিতে রাজি নন মুম্বাই শহরের কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ও ধারাভির উচ্ছেদ হতে চলা বাসিন্দাদের একাংশ।

উপযুক্ত পুনর্বাসন, রুজি-রুটির ব্যবস্থা সহ নানা দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন গড়ে তুলছেন তাঁরা।

এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪১ সংখ্যা ২৩ – ২৯ মে ২০২৫ এ প্রকাশিত