চালু প্রবচন বলে– সকালটা কেমন, তা দেখেই বোঝা যায় বাকি দিনটা কেমন যাবে। বিগত কয়েক দশকের ট্র্যাডিশন মেনে এ বছরেও পঞ্চায়েত ভোটের কাজ শুরু হতে না হতেই শুধু মনোনয়ন পর্বের মধ্যেই তিন জেলায় বোমা-গুলির আঘাতে ছয়জন নিহত। আহতের সংখ্যা বহু। এ যদি সকালের লক্ষণ হয় তা হলে বাকি সময়টাতে কী হতে চলেছে ভেবেও আতঙ্কে শিউরে উঠছে মানুষ।
আরও চিন্তার বিষয় বোমা-গুলি-আগুনের ঝড়ের মধ্যে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীর নিশ্চিন্ত ভাব। তিনি বলে দিয়েছেন, এত শান্তিপূর্ণ মনোনয়ন কোনও দিন হয়নি। শুধু তাই নয়, ভাঙড়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র নিয়ে আইএসএফ এবং তৃণমূলের মারামারির প্রসঙ্গে তিনি তাঁর পূর্বসূরী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কায়দাতে ‘আমরা ওরা’ ভাগ করে নিজের দলের অস্ত্রধারীদের পাশেই দাঁড়িয়েছেন। আজকের দিনের তথাকথিত গণতন্তে্র দলের সুপ্রিমোর চেয়ারটা যে নির্বাচিত প্রশাসনিক প্রধানের চেয়ারকে সব সময় ছাপিয়ে যায়, নিজের আচরণে আর একবার তা মনে করিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। আর রাজ্য নির্বাচন কমিশন! তারা নাকি কোনও হত্যার খবরই পায়নি! অন্য দিকে পুলিশ বুক ফুলিয়ে ৬২টা বোমা উদ্ধারের বড়াই করেছে! অথচ শুধু ভাঙড়েই মানুষ মিনিটে মিনিটে বোমা পড়তে দেখেছে, কয়েক শত বন্দুকধারীকে তাঁরা দাপাতেও দেখেছে। নানা এলাকার সন্ত্রাসের ছবি টিভি থেকে মোবাইলের স্ক্রিন কিংবা খবরের কাগজ, সর্বত্রই ঘুরছে। শুধু পুলিশ আর নির্বাচন কমিশন তা জানে না! বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেসের মতো বিরোধীরা কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকবে কি থাকবে না তাই নিয়ে সরকারের সাথে তরজাতেই ব্যস্ত। এখনই সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, এই দাবিটাই পিছনে চলে যাচ্ছে।
সংবাদমাধ্যমে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ভাঙড়, উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ার নাম বেশি এসেছে। কিন্তু আসেনি সেইসব জায়গার কথা যেখানে বিরোধী দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন কেন্দ্রের কাছে ঘেঁষতেই বাধা দেওয়া হয়েছে, আবার কোথাও এসডিও-বিডিও অফিসে আপাত শান্তি বজায় থাকলেও বিরোধীদের সন্ত্রস্ত্র করতে গ্রামে গ্রামে চোখরাঙানি ছাড়াও শাসকদলের গুন্ডাবাহিনী ও পুলিশ যৌথভাবে হামলা চালিয়েছে। এর পরেও মনোনয়ন তুলে নিতে ও ভোটের সময় সন্ত্রাসের রূপ কী হবে তা সময় বলবে। এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের প্রার্থীরা ক্যানিংয়ে মনোনয়ন দিতে গেলে তৃণমূলের বাহিনী তাদের মারধর করে কাগজপত্র কেড়ে নিয়েছে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় কুলতলির মেরিগঞ্জে হেড়োভাঙাতে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর অফিস পুলিশ এবং তৃণমূল একযোগে ঘিরে রেখে মনোনয়নে যেতেই বাধা দিয়েছে। মেরিগঞ্জ-১ এর যে সব গ্রামে এস ইউ সি আই (সি)-র সাংগঠনিক শক্তি বেশি সেখানে অস্ত্র উদ্ধারের নামে কৃষক পরিবারের ঘরে ঘরে পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে যাতে একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে এস ইউ সি আই (সি)-কে আটকানো যায়। দলের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য ১৬ জুন সমাজমাধ্যমে প্রচারিত এক বার্তায় বলেন, রাজ্য সরকার, শাসকদল এবং নির্বাচন কমিশন মিলে গণতন্ত্রের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে।
সিপিএম সরকারের আমল থেকেই পঞ্চায়েত নির্বাচন মানেই মানুষ প্রহর গোনে আবার কত প্রাণ এবারে যাবে? ১৯৮০-র দশক থেকে প্রতিটি পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের সমর্থকদের বাড়িতে বাড়িতে সাদা থান পৌঁছে দিয়ে হুমকির হিমশীতল পরিবেশ সৃষ্টি করাকে তৎকালীন শাসকদলের নেতারা প্রায় একচেটিয়া শিল্পে পরিণত করেছিলেন। প্রতি বছরেই পঞ্চায়েত নির্বাচনের শেষে কোনও বছর ৭০, কোনও বছর ৩০-৪০ জনের মৃত্যু সংখ্যা গুনতে হত মানুষকে। একের পর এক বুথে বিরোধীরা শূন্য আর সিপিএম প্রায় সব ভোট পাওয়ার রেকর্ডের তখনই শুরু। তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় বসার পর এই ভিত্তি থেকে শুরু করে নির্বাচনী সন্ত্রাসে সিপিএমের যথার্থ উত্তরসূরীর পরিচয় দিয়েছে। বিজেপি, যারা পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্র হত্যা নিয়ে বড় বড় বত্তৃতা করে, তারাই ত্রিপুরায় সরকারে বসার পর সমস্ত পঞ্চায়েত বিরোধীশূন্য করার কর্মসূচি নিয়েছিল। শাসকদলগুলির নেতাদের বক্তব্যে অদ্ভূত মিল– আগে সিপিএম বলত বিরোধীরা প্রার্থী জোগাড় করতে না পারলে কি আমরা জেগাড় করে দেব? ত্রিপুরায় বিজেপি হুবহু এক কথা বলেছে। এখন পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল বলছে, কেউ মনোনয়ন দিতে যেতে ভয় পেলে আমাদের বলুন আমরা জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করব। একটা প্রশ্নের উত্তর এরা কেউ কি দেবেন– মনোনয়ন জমা দিতে ভয়ের প্রশ্নটা উঠল কেন? এটাই তো প্রমাণ করে পরিস্থিতিটা আসলে কী হয়ে আছে। দেখা যাচ্ছে, বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থায় যে দলই শাসকের আসনে বসছে তারাই যে কোনও ভোটে বিশেষত পঞ্চায়েত নির্বাচনে সব ক্ষমতা একা দখল করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
কিন্তু কেন এমন হবে? নির্বাচন, বিশেষত পঞ্চায়েত নির্বাচন মানেই কি রক্তপাত-প্রাণহানি, বিরোধীদের ভোটে দাঁড়াতেই বাধা? তা হলে সংবাদমাধ্যমে আদর করে ভোটকে ‘গণতন্তে্রর উৎসব’ বলার মানে কী? এই যদি উৎসবের চেহারা হয়, গণতন্ত্র মানে যদি ‘জোর যার মুলুক তার’ হয়, তা হলে সে গণতন্ত্র থাকা আর না থাকায় মানুষের কী এসে যায়! এই প্রশ্নটা আজ উঠছে। পঞ্চায়েতী রাজ নিয়ে নানা গালভরা কথা বলে থাকেন কেন্দ্র কিংবা রাজ্য সরকারের গদিতে নানা সময় বসা সব দলের নেতারাই। কিন্তু পঞ্চায়েত যে ঘুঘুর বাসায় পরিণত হয়েছে তা সহজেই বোঝা যায়। গ্রামীণ মানুষের ক্ষমতায়ন নয়, পঞ্চায়েত আসলে আমলাতন্ত্র এবং রাজনৈতিক দালালদের হাতে গ্রামীণ মানুষকে বন্দি করে রাখার জন্য বুর্জোয়া শ্রেণির জোরালো হাতিয়ার। যে কাজগুলি প্রশাসনেরই করার কথা সেগুলিকেই পঞ্চায়েতের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে করানো হয়। নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনও ক্ষমতা পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরেই কার্যত নেই। পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে পুঁজিবাদী শোষণের নাগপাশের বিরুদ্ধে কেউ মাথা তুলতেই না পারে, তা একেবারে গ্রামের পাড়া স্তর পর্যন্ত নিশ্চিত করা যায়। পঞ্চায়েতের ক্ষমতাসীন দল এবং তার নানা স্তরের নেতারা এই ব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসে থাকেন। তাদের না জানিয়ে পরিবারের সামান্য কোনও সিদ্ধান্তও গ্রামীণ মানুষের পক্ষে নেওয়া প্রায় অসম্ভব। এই প্রবল দাপটই সীমাহীন দুর্নীতিরও সুযোগ করে দেয়। গ্রামের সাধারণ মানুষকে তাদের প্রাপ্য অধিকার পাওয়ার জন্য পঞ্চায়েতী বাবুদের নানা ভাবে খুশি করতে হয়। শাসকদলের বিরুদ্ধে গেলে কোনও প্রাপ্যই মিলবে না। এ ছাড়াও নেতাদের খুশি করতে বহু ধরনের ভেট পৌঁছে না দিলে মানুষের ভাগে কিছুই পড়ে না। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম আমল থেকে জবকার্ড, বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতা, গ্রামীণ মানুষের জন্য বরাদ্দ নানা সরকারি ঋণ এমনকি রেশন কার্ড পেতেও এই বাবুদের দুয়ারে ঘুরে ঘুরে হয়রান হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়নি এমন গ্রামীণ মানুষ বিরল। পঞ্চায়েতের মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষের ওপর রাজনৈতিক দাপট বজায় রাখা এবং দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা লোটার স্বর্গরাজ্য এই দুইয়ের মেল বন্ধনই ক্ষমতার চারপাশে ঘোরা ভোটবাজ দলগুলিকে যে কোনও প্রকারে পঞ্চায়েত দখলে এত প্ররোচিত করে। সে জন্য বহু জায়গায় অনৈতিক জোট করতেও দ্বিধা করে না। উপরের নেতারা চোখ বুঝে থেকে বিষয়টা ঘটতে দেয়। একসময়ের চরম বিরোধী সিপিএম-কংগ্রেস এখন জোটসঙ্গী। আবার কুলতলির মৈপীঠে দেখা গেছে ২০১৮-র নির্বাচনে এস ইউ সি আই (সি)-র বিরুদ্ধে তৃণমূল, সিপিএম, কংগ্রেস এক সাথে লড়েছিল। বিজেপির সাথে নানা অজুহাতে সিপিএম কিংবা তৃণমূল বা কংগ্রেসের হাত মেলানো বিরল নয়।
এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে এস ইউ সি আই (সি) মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তার ভিত্তিতে গ্রামীণ মানুষের কাছে কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছে। গ্রামীণ এলাকার বেকারত্ব সারা দেশেই সর্বকালীন রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে। সরকার একচেটিয়া মালিকদের স্বার্থে কৃষিনীতি নেওয়ায় সাধারণ মানুষের পক্ষে কৃষি ক্রমাগত অলাভজনক হয়ে পড়ছে। ফলে এই ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ কমছে। কৃষিকে ভিত্তি করে শিল্প গড়ে তোলা, ফসলের ন্যায্য দামের ব্যবস্থা করার কোনও উদ্যোগই কেন্দ্র কিংবা রাজ্য সরকারের নেই। বৃহৎ পুঁজির ডেয়ারির সাথে প্রতিযোগিতায় গ্রামীণ মানুষের গবাদি পশু পালনের মাধ্যমেরোজগার বন্ধ হয়ে পড়েছে প্রায়। একশো দিনের কাজে বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার বরাদ্দ কমাচ্ছে, তা আটকেও রাখছে। অন্য দিকে রাজ্যের তৃণমূলের দুর্নীতিতে তা আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে।
প্রতি দিন গ্রাম থেকে হাজারে হাজারে মানুষকে শহরে বা ভিন রাজ্যে পাড়ি জমাতে হয় সামান্য রোজগারের আশায়। মূল্যবৃদ্ধি এবং রোজগারহীনতা মিলে এমন পরিস্থিতি যে, গ্রামাঞ্চলে সরষের তেলের এক-দু’টাকার পাউচ, কিংবা সামান্য মশলাপাতির বিক্রিও কমছে। মানুষের কেনার ক্ষমতাই নেই। জ্বালানির কেরোসিন এখন আগুন দাম, অথচ গ্যাস কেনার সামর্থ্য নেই বহু পরিবারের। পরিবারগুলোকে ফিরে যেতে হচ্ছে কাঠের জ্বালের যুগে। গ্রামীণ বিদ্যুতায়নের বড়াই সরকার করলেও কেন্দ্র-রাজ্য দুই সরকারের বিদ্যুৎ নীতির ফলে বহু মানুষেরই বিদ্যুতের বিল জোগানোর ক্ষমতাই নেই। গ্রামে শিক্ষার জন্য স্থাপিত এসএসকে, এমএসকে-গুলোর অভিভাবকত্ব নিয়ে পঞ্চায়েত দপ্তর আর শিক্ষা দপ্তরের ঠেলাঠেলি চলছে। প্রাইমারি স্কুলগুলো শিক্ষকের অভাবে, সরঞ্জামের অভাবে ধুঁকছে। মাধ্যমিক পরীক্ষা তুলে দিয়ে, চার বছরের ডিগ্রি কোর্স চালু করে ও শিক্ষাকে পুরোপুরি বেসরকারি করার যে নীতি কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার নিয়েছে, তাতে গ্রামীণ মধ্যবিত্ত গরিব মানুষের ঘরে শিক্ষার আলো নিভতে চলেছে। মিড ডে মিল, আশা, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের ওপর চলছে সীমাহীন শোষণ। গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, গ্রামীণ হাসপাতালগুলোতে সামান্য জ্বর-পেটখারাপের ওষুধ কিংবা ফোঁড়া কাটার মতো অপারেশনও এখন হয় না। মানুষকে হত্যে দিতে হয় শহরের হাসপাতালের দরজায়। এগুলি নিয়ে দাবি তুলতে কোনও পঞ্চায়েতকেই দেখা যায় না। সমস্ত কিছু থেকে বঞ্চিত মানুষকে সরকার একটা জিনিস সহজে এবং সস্তায় দিতে চায় তা হল– মদ। ফলে গ্রামীণ পরিবারে শান্তি এখন বিপন্ন। তাই পঞ্চায়েতের মধ্যে যদি ন্যূনতম গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখতে হয়, মানুষের প্রাপ্য সুবিধা, পঞ্চায়েতের কাজ কিছুটাও আদায় করতে হয়, তাহলে গ্রামীণ এলাকাতেও একের পর এক গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া আর কোনও পথ নেই। পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতির চক্করে ফাঁসলে এই মতলববাজ নেতাদের ক্ষমতালিপ্সা চরিতার্থ করতে ঘরের সন্তানদের রক্ত ঝরা বারবার দেখতে হবে।
এই অবক্ষয়ী ধারার বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের শক্তি হিসাবে পঞ্চায়েত নির্বাচনে এসইউসিআই (সি) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের জনবিরোধী নীতি, দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে এবং গ্রামীণ সমস্যা নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে এস ইউ সি আই (সি) প্রার্থীদের জয়ী করার আহ্বান জানিয়েছেন রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য।