Breaking News

মণিপুরঃ সমাধান চায় না বিজেপি, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথেই এগোতে হবে মানুষকে

পাটনা

সম্প্রতি গণদাবীর দপ্তরে এসেছিলেন কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত এক মণিপুরি যুবক। তাঁর কথায়– আমরা মণিপুরের মেইতেই কিংবা কুকি, নাগা ইত্যাদি সব সম্প্রদায়ের মানুষ কলকাতায় এক সাথে কাজ করি, এক মেসে মিলে-মিশেই থাকি। কিন্তু মণিপুরের সীমানায় ঢুকলেই আমরা পরস্পরের চরম শত্রু হয়ে উঠি! কেন এমন হয় বলুন তো? আশঙ্কা হচ্ছিল, তিনি নিজে মেইতেই সম্প্রদায়ের, তাই হয়ত কুকিদেরই তিনি এর জন্য দোষী করবেন! কিন্তু একেবারেই তা নয়, তিনি বলে চললেন– এর জন্য প্রধান দায়ী সে রাজ্যের বর্তমান এবং প্রাক্তন শাসক দল বিজেপি ও কংগ্রেসের ভূমিকা। নিজেদের সরকারি গদি রক্ষার স্বার্থে তারাই নানা ভাবে ইন্ধন জুগিয়েছে এই জাতিদাঙ্গায়। এ কারণেই প্রায় দু’বছর ধরে মণিপুরে জাতিদাঙ্গার আগুন নেভেনি।

আজ আবার কেন্দ্রীয় সরকারের বদান্যতায় মণিপুর নতুন করে জ্বলছে। মেইতেই-কুকি জাতিদাঙ্গার সমাধানের চেষ্টা দূরে থাক, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী তাঁর অতি বিশ্বস্ত রাজ্যপালকে সামনে রেখে গায়ের জোরে কাজ হাসিলের যে নিদান দিয়েছেন, তাতে এই দুই পক্ষের বিভেদ আরও বেড়েছে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

মণিপুরের বর্তমান রক্তাক্ত জাতিদাঙ্গার পিছনের কারণটি বোঝার জন্য এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সংক্ষেপে আলোচনা করা দরকার। ভারত-বর্মা (বর্তমানে মায়ানমার) সীমান্ত এলাকার স্বাধীন রাজ্য মণিপুর ১৮২৪-এ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘আশ্রিত রাজ্যে’ পরিণত হয়। ১৮৯১-এ ব্রিটিশরা মণিপুর দখল করে। রাজপুত্র টিকেন্দ্রজিৎ সিং ও তাঁর সেনাপতিদের ইম্ফলের মাটিতে ফাঁসি দেয় তারা। এই আগ্রাসন নিয়ে মণিপুরে উপত্যকার জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়।অন্য দিকে, বর্মা (বর্তমানে মায়ানমার), বর্তমান বাংলাদেশ এবং ভারতের মণিপুর ও মিজোরামের পাহাড়ি অংশ মিলিয়ে চিন-লুসাই হিল এলাকায় কুকি, নাগা ইত্যাদি জনজাতি ও তাদের নানা শাখার মানুষ দীর্ঘদিন ধরে বাস করে আসছেন। ১৮২৬ থেকে একাধিকবার ব্রিটিশরা ইন্দো-মায়ানমার সীমান্তে লাইন টেনে এই জনগোষ্ঠীর মানুষকে পরস্পরের থেকে আলাদা করার চেষ্টা করেও সফল হয়নি। এই বিস্তীর্ণ এলাকার পাহাড়ের অধিবাসী জনজাতিরা বারবার এর বিরুদ্ধে মাথা তুলেছে। যার সবচেয়ে বড় বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯১৭ থেকে ১৯১৯ কুকি বিদ্রোহে। পাহাড়ি আদিবাসী জনগণ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়েছেন। আবার উপত্যকার সামন্ত রাজাদের বিরুদ্ধেও তারা লড়েছেন।

মণিপুর দীর্ঘদিন ধরেই নানা উপজাতি ও তাদের নানা শাখার বাসভূমি। সকলের উৎপত্তি এক উপজাতি গোষ্ঠী থেকে নয় এবং ভাষা-সংস্কৃতি-আচার আচরণেও পার্থক্য আছে। নানা সময়েই এই নানা উপজাতির মানুষের মধ্যে রক্তাক্ত লড়াইয়ের ইতিহাস মণিপুরে আছে। বর্তমানে ইম্ফলকে কেন্দ্র করে যে উপত্যকা তাতে মূলত বাস করেন মেইতেইরা। যারা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশ। এই উপত্যকাকে ঘিরে থাকা পাহাড়ি এলাকায় কুকি, নাগা উপজাতি এবং তাদের বহু শাখার মানুষ বাস করেন। এ ছাড়াও কিছু বাংলাভাষী, নেপালিভাষী ইত্যাদি গোষ্ঠীর মানুষের বাস আছে এই রাজ্যে। এখানে তাই সমস্ত গোষ্ঠীর মানুষের ঐক্য গড়ে তোলার কাজটা অত্যন্ত জটিল এবং খুবই সংবেদনশীল।

ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে একমাত্র আসামে কিছুটা স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউ উঠেছিল। মণিপুরের মতো একেবারে প্রান্তিক এলাকায় তার প্রভাব ছিল খুবই দুর্বল। ফলে নানা গোষ্ঠীতে বিভক্ত মানুষের মধ্যে সমস্বার্থ বোধ গড়ে তোলা, তাকে ভিত্তি করে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে মানুষকে শামিল করার চেষ্টা স্বাধীনতা আন্দোলনের আপসমুখী নেতাদের দ্বারা পুরোপুরি অবহেলিত হয়েছে। এ কারণেই মণিপুরে ভারতীয়ত্ব, সমস্ত উপজাতির মধ্যে ভারতীয় হিসাবে একই পরিচয়-বোধ গড়ে ওঠার কাজে ঘাটতি থেকে গেছে। মণিপুরের এই পরিস্থিতি মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তকে আবার প্রমাণ করছে– মহান লেনিন দেখিয়েছেন, বর্তমান যুগে জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে বুর্জোয়ারা নেতৃত্বে থাকলে তারা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচিকে সম্পূর্ণ করতে অক্ষম। ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল মূলত আপসকামী বুর্জোয়ারা। মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, এই আপসকামী বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দিক থেকে এক জাতি গড়ে উঠলেও জাতপাত-প্রাদেশিকতা-উপজাতিগত পরিচিতির বিভেদ, ভাষাগত বিভেদ ইত্যাদি দূর করে সামাজিক সাংস্কৃতিক দিক থেকে ঐক্যবদ্ধ জাতি গড়ে তোলার পথে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। মণিপুরে এই সমস্যা খুবই প্রকট।

কিন্তু এই কাজটা যে অসম্ভব ছিল না তা বোঝা যায়, স্বাধীনতা আন্দোলনের একেবারে শেষ ভাগে স্বাধীনতা আন্দোলনের আপসহীন ধারার প্রতিনিধি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বের প্রতি মণিপুরের মানুষের সমর্থন দেখে। আজাদ হিন্দ বাহিনীর সাথে সুভাষচন্দ্র নিজে মণিপুরে গিয়ে মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন, তাদের সাহায্য চেয়েছিলেন। সে রাজ্যের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ আইএনএ বাহিনীকে সমর্থন শুধু নয়, সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। মেইতেই, পঙ্গল, কুকি, নাগা সকলেই আইএনএ বাহিনীকে সাহায্য করেছেন। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের জাঁতাকল থেকে মুক্তি আকাঙক্ষাই তাদের মধ্যে ঐক্য সংহতি সহমর্মিতা গড়ে দিয়েছিল। ১৯৪৫-এ আইএনএ বাহিনী পিছু হটার সময় আইএনএ বাহিনীতে যোগ দেওয়া মণিপুরের দু’জন মহিলা ও ১৭ জন পুরুষ রেঙ্গুন থেকে ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। এই রাজ্যের নাগা অধ্যুষিত এলাকার নেতা অনগামি ঝাপু ফিজো ১৯৪৪ সালে আইএনএ-তে যোগ দেন (সূত্রঃ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন, রাজনীতি ও সংগ্রাম, কৃষ্ণা বসু)।

স্বাধীন ভারতে শাসকদের ভূমিকা পরিস্থিতি জটিল করেছে

স্বাধীন ভারতে শাসক বুর্জোয়া দলগুলির নেতারা নিজেরাই নানা সম্প্রদায়, বর্ণ-জাতিগত বিভেদে আচ্ছন্ন। তারা কেন্দ্র এবং নানা রাজ্যে সরকারি গদিতে বসার তাগিদে নতুন ধরনের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি নিয়ে চলে। সারা দেশের খেটে খাওয়া মানুষের ঐক্য ও সর্বহারা শ্রেণির বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে তোলার পথে তারা এ ভাবে বাধা সৃষ্টি করে। এটা তাদের ওপর বুর্জোয়া শ্রেণি নিয়োজিত অন্যতম দায়িত্ব। আঞ্চলিক পুঁজিপতিদের সাথে বৃহৎ বহুজাতিক একচেটিয়া পুঁজির মালিক জাতীয় পুঁজির সাথে তুলনামূকভাবে দুর্বল আঞ্চলিক পুঁজির দ্বন্দ্বের ফলে যে আঞ্চলিক দলগুলি গড়ে ওঠে তারাও অঞ্চলিকতাবাদ, প্রাদেশিকতা, জাতপাতের বিভেদে মদত দেয়। এই দুই পক্ষই বিভেদ জিইয়ে রাখে, কখনও কখনও সাধারণ মানুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেয়। মণিপুরেও এর কোনও ব্যতিক্রম ঘটেনি।

মণিপুরের মাটিতে যে ধরনের জাতিগত-সম্প্রদায়গত বিভেদের উপাদান মজুত ছিল তাকে সহজেই জাতিদাঙ্গা লাগানোর কাজে ব্যবহার করতে পেরেছে এই শক্তিগুলি। ভারতের স্বাধীনতার পর মণিপুরের রাজারা প্রথমে রাজন্য শাসিত রাজ্য হিসাবে স্বাধীন থাকার সিদ্ধান্ত নিলেও ভারত সরকার সামরিক শক্তির জোরে ১৯৪৯-এ তার ভারতভুক্তি ঘটায়। স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল ধারায় যেহেতু মণিপুর ছিল না, তাদের বিশেষ অবস্থানকে ঘিরে রাজ্যবাসীর মধ্যে ভারতীয়ত্ব গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে। মণিপুরের মানুষের মধ্যে তাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য (আইডেন্টিটি) হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কাজ করছিল। এটাকে দূর করতে স্বাধীন ভারতের সংবিধানে ৩৭১-সি ধারায় মণিপুরের জন্য কিছু বিশেষ অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু কাশ্মীরে ভারত সরকার যেমন ৩৭০ ধারার কোনও মর্যাদা কোনও দিন রাখেনি, মণিপুরেও একই কাজ করেছে। মণিপুরের বিশেষ অবস্থানকে যথাযথ মান্যতা দিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সে রাজ্যের সমস্ত জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তোলা, সমগ্র ভারতের সাথে সামাজিক-সাংস্কৃতিক মিলনে সাহায্য করার জন্য যে জনমুখী দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন তা এ দেশের কোনও সরকারি বুর্জোয়া দলের কাছে আশা করাই বৃথা। এর সঙ্গে কেন্দ্রীয় শাসকদের বঞ্চনা, অনুন্নয়নের বিরুদ্ধে মানুষের বিক্ষোভকে জাতিবাদী-প্রাদেশিকতাবাদী বিচ্ছিন্নতার শক্তিগুলি কাজে লাগিয়েছে। এর ফলে কিছু সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনী গড়ে ওঠে। মণিপুরের মানুষের মনের এই ক্ষত নিরাময় দূরে থাক, সব দলের রাজত্বেই কেন্দ্রীয় সরকার চেয়েছে কেবলমাত্র সামরিক শক্তির জোরে মানুষের এই সমস্যাকে দাবিয়ে রাখতে। অথচ স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘদিন কংগ্রেস এবং এখন বিজেপি মণিপুরের উগ্র প্রাদেশিকতাবাদীদের সাথে হাত মিলিয়ে সে রাজ্যে সরকারি ক্ষমতায় থেকেছে। মেইতেই জনগোষ্ঠী সে রাজ্যে সর্ববৃহৎ এবং বিধানসভার ৪০টি আসনের মধ্যে ৩০টিতেই মেইতেইরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে কংগ্রেস এবং বিজেপি উভয়েই এই জনগোষ্ঠীর উগ্রজাতিবাদী শক্তিগুলিকে মদত দিয়ে তাদের ত্রাতা সেজে ভোটে জেতার চেষ্টা করেছে। যতদিন গেছে বিজেপি আরও উগ্রভাবে এই কাজ করেছে। শাসকদলগুলির এই ভূমিকায় সে রাজ্যের নানা উপজাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র সংঘাতের পরিস্থিতি ক্রমাগত বেড়েছে।

সাম্প্রতিক রক্তাক্ত অধ্যায়ের সূত্রপাত মেইতেই জনগোষ্ঠীকে ‘এসটি’ তালিকাভুক্ত করার প্রশ্ন নিয়ে। শাসক দল বিজেপি মেইতেইদের বুঝিয়েছিল এসটি তালিকায় সংরক্ষণ পেলে তোমাদের বেকারি ঘুচবে, তোমরা পাহাড়ে জমি কিনতে পারবে। অথচ, তারা বলছে না যে, সংরক্ষণের আওতায় থেকেও কুকি-জো জনজাতির মানুষকে বেআইনি পোস্ত চাষ ও জঙ্গল নির্ভর জীবন কাটাতে হয় কেন? কংগ্রেসও একই ভাবে মেইতেইদের শত্রু হিসাবে কুকিদের তুলে ধরেছে দীর্ঘসময়। বিজেপি সরকারের সদ্য পদত্যাগী মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসার মাত্র পাঁচ মাস আগে ছিলেন কংগ্রেসের সহসভাপতি। মেইতেইদের মধ্যে আশঙ্কার বাতাবরণ সৃষ্টি এবং একই সাথে তাদের ত্রাতা সেজে ভোট কুড়োনোর জন্য বিজেপি সমগ্র কুকি সমাজের বিরুদ্ধে ড্রাগ চোরাচালানের অভিযোগ আনছে। এই সমস্ত অঞ্চলে আফিম চাষকে ভিত্তি করে এই সমস্যা নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সমস্ত জনগোষ্ঠীকে এভাবে দাগিয়ে দেওয়া চলতে পারে কি? যদিও বিজেপির একাধিক নেতা এমনকি সদ্য প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং-এর ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধেও ড্রাগ চোরা-চালানে মদত দেওয়ার অভিযোগ আছে।

২০২৩-এর ১ জুলাই মণিপুরের এক শিক্ষাবিদকে উদ্ধৃত করে দ্য টেলিগ্রাফ লিখেছিল, বিজেপি মেইতেই মায়েদের বুঝিয়েছিল– কুকিদের হাতে উপত্যকার সব জমি চাকরি দখল হয়ে যাবে। তাই সন্তানের ভবিষ্যতের স্বার্থেই তাদের পাঠাতে হবে কুকিদের বিরুদ্ধে লড়তে। পুলিশ পিছন থেকে সাহায্য করবে। কিন্তু বাস্তবে কুকিরাও সশস্ত্র, তাদের যেমন প্রাণ যাচ্ছে, মেইতেই যুবকরাও প্রাণ হারাচ্ছেন।

অ্যাক্ট ইস্ট নীতি’র বিশেষ পরিকল্পনা

মণিপুর মিজোরামের মতো উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলির রাস্তা ধরে ভারতের একচেটিয়া পুঁজির মালিক ও বিদেশি বহুজাতিকদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের সম্ভাবনা দেখে ২০১৫ থেকে কেন্দ্রীয় সরকার ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির কথা বলতে থাকে। তার স্বার্থে পাহাড়ের বাসিন্দা উপজাতিদের ক্ষোভ নিরসন দরকার হয়ে পড়ে। তাই কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৮-তে ভারত, মায়ানমারের সীমান্তের ১৬ কিলোমিটারের মধ্যে পাহাড়ি জনজাতিদের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে ‘ফ্রি মুভমেন্ট’ হিসাবে দুই দেশে ছড়িয়ে থাকা তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে যাওয়ার জন্য ভিসা ছাড়াই বিশেষ অনুমতি নিয়ে যাতায়াত ও ৭২ ঘন্টা থাকার সুযোগ দেয়। কিন্তু একই সাথে বিজেপি তার ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির স্বার্থে ২০১৭-র বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসকে হারাতে মেইতেই ভোটব্যাঙ্ক তৈরিতে জোর দেয়। তারা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মানুষের প্রবল ক্ষোভকে কাজে লাগায় এবং মেইতেইদের ত্রাতা সেজে প্রচার করতে থাকে কুকিরা উপত্যকার জমি নিয়ে নেবে, ওদের সংখ্যা বাড়ছে ফলে ওরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যাবে ইত্যাদি। প্রচার চলে, কুকিরা সকলেই বহিরাগত, ওদের দেশ থেকে বার করে দিতে হবে। তারা প্রতিশ্রুতি দেয়, ১৯৫১-র সেন্সাসের ভিত্তিতে এনআরসি চালু করে বড় অংশ কুকি-জো মানুষকে ভারত থেকে বার করে দেওয়া হবে। এই অনুসারে ২০২১-এর জুলাই-এ ‘ফ্রি মুভমেন্ট’ অনুমতি প্রত্যাহার করার ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, ২০২২ থেকে তা বন্ধ (ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫)। মায়ানমারে অস্থিরতার কারণে জনজাতির কিছু মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে চলে এসে থাকলেও তাদের চিহ্নিত করা ও আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবিক দৃষ্টিতে বিষয়টির সমাধান এক জিনিস, কিন্তু কুকি জনজাতিভুক্ত সমস্ত মানুষকে বহিরাগত বলে যেভাবে প্রচার চালাচ্ছে বিজেপি তা সম্পূর্ণ অন্য বিষয়। কুকি জনগোষ্ঠী ঐতিহাসিকভাবেই মণিপুরের দীর্ঘদিনের বাসিন্দা এবং ভারতীয় নাগরিক। তাদের সকলকে বহিরাগত বলার ফলে কুকিদের মধ্যে ক্ষোভকে কাজে লাগাচ্ছে সেখানকার উগ্রজাতিবাদী শক্তিগুলি। পরিস্থিতি এমন যে, এখন ‘মণিপুরি’ সত্ত্বার খোঁজ পাওয়াই মুশকিল– হয় সেটা মেইতেই সত্ত্বা, না হলে কুকি সত্ত্বায় বিভক্ত হয়ে গেছে।

সব জনগোষ্ঠীই পুঁজিবাদী শোষণের শিকার

বাস্তব হল, মণিপুরে কোনও জনগোষ্ঠীই আর এক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের সুযোগ কাড়ছে না। তারা সকলেই শোষিত, অবহেলিত, বঞ্চনার শিকার। স্বাধীনতার পর থেকে শিল্প-কারখানা এবং অন্যান্য উন্নয়নের প্রশ্নে উত্তরপূর্বের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পিছিয়েই থেকেছে। বর্তমান অস্থিরতা শুরুর ঠিক আগের তথ্য দেখাচ্ছে, মণিপুরের জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশ দারিদ্রসীমার নিচে। কর্মক্ষম জনসংখ্যার মাত্র ৩২ শতাংশ কিছু কাজ পায় (দ্য টেলিগ্রাফ ৫.৩.২০২২)। সরকারি- বেসরকারি নির্দিষ্ট বেতনের স্থায়ী কিংবা ক্যাজুয়াল চাকরি মোট কর্মসংস্থানের মাত্র ২৭.৮ শতাংশ। মণিপুরে শিল্প অতি নগণ্য, সরকারি চাকরিও খুব কম। সংরক্ষণের আওতায় থেকেও পার্বত্য জেলাগুলির আদিবাসী মানুষের মধ্যে দারিদ্র এবং কর্মহীনতার মাত্রা অতি তীব্র। সে রাজ্যের সব জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ যুব বয়সীকে কাজ খুঁজতে দেশের নানা স্থানে পাড়ি জমাতে হয়। এই পরিস্থিতির সুযোগে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ধুরন্ধর মতলববাজরা কংগ্রেস বিজেপির মতো শাসকদল ও প্রশাসনের সাথে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে মানুষকে লড়িয়ে দিয়ে নিজেদের আখের গোছানোর চেষ্টা করছে।

আগুন জ্বালিয়েছে মতলববাজ দলগুলি

গত বিধানসভা ভোটের আগে মণিপুরের কুকি-জো ইত্যাদি আদিবাসীদের কাছে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তাদের জঙ্গল ও জমির অধিকার এবং অন্যান্য দাবির বিষয়টি তারা দেখবে। যার ভিত্তিতে ৭ জন কুকি বিধায়কও পেয়েছে তারা। কিন্তু ভোটের কিছুদিন পর থেকে বিজেপি পরিচালিত রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার মণিপুরে পাহাড়ে এবং বনাঞ্চলে মায়ানমার থেকে আসা অনুপ্রবেশকারী খোঁজার অছিলায় ভারতীয় নাগরিক আদিবাসী জনগণকে স্বাভাবিক এবং আইনগত অধিকার দিতে অস্বীকার করছে। তারা বহু গ্রামউচ্ছেদ করার কাজ শুরু করেছে। সংবিধানের ৩৭১-সি ধারা এবং আদিবাসী অধিকার সংক্রান্ত আইনগুলি অকেজো করে রেখে অধিকাংশ বনাঞ্চলকে ‘রিজার্ভ ফরেস্ট’ ঘোষণা করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করতে অভিযান চলছে। সাম্প্রতিক বনসুরক্ষা বিধির নামে আদিবাসীদের থেকে অরণ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টাও পাহাড়ি জনজাতিগুলিকে বিক্ষুব্ধ করছে। মূলত কুকি জনজাতিদের বেশ কিছু গ্রাম সরকার উচ্ছেদ করেছে বা উচ্ছেদের নোটিশ দিয়েছে। সে রাজ্যের খনিজ এবং বনজ সম্পদ ও জমির ওপর স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। যাতে বৃহৎ পুঁজিমালিক কর্পোরেট কোম্পানিগুলি এই এলাকার জমি ও খনিতে থাবা বসাতে পারে।

এ সবের ফলে পাহাড়ি জনজাতিদের মধ্যে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা আশঙ্কা, উদ্বেগ ও ক্ষোভ দানা বাঁধছে। এর সুযোগ নিয়ে কুকিদের ম্যধ্য কিছু উগ্র জাতিবাদী শক্তি বিষ ছড়াচ্ছে। অন্যদিকে, পদত্যাগী মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং-কে মেইতেই স্বার্থের চ্যাম্পিয়ন হিসাবে তুলে ধরে বিজেপি দেখাতে চেয়েছে যেন, কুকি সহ অন্যান্য অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষই মেইতেইদের বেকারত্ব, দারিদ্রের জন্য দায়ী। এই মিথ্যা প্রচারের জোরে শান্তিপূর্ণ মেইতেই জনগণের মধ্যে কুকিদের সম্পর্কে প্রবল ক্ষোভ এবং বিষাক্ত শত্রুতার জন্ম হয়েছে। এই চক্রান্ত আরও একবার পরিষ্কার হয়েছে বিজেপির সদ্য প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সম্প্রতি ফাঁস হওয়া এক অডিও কথোপকথনে। শোনা গেছে তিনি নিজেকে মেইতেই গোষ্ঠীর সশস্ত্র গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষক হিসাবে তুলে ধরছেন। এই কারণেই কেন্দ্রীয় সরকার দীর্ঘ সময় ধরে নীরব দর্শক হয়ে বসে থেকেছে। আবার দেশ জুড়ে প্রবল সমালোচনার মুখে সমস্যা সমাধানের নামে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার ভান করে তারা এমন কিছু কাজ করছে যাতে কুকি-মেইতেই বিরোধ বাড়ছে। আসামে এক সময় বিদেশি বাছাইয়ের নামে একদল ভারতীয় নাগরিককে উচ্ছেদের চেষ্টার মধ্য দিয়ে এই রকমই বিষাক্ত শত্রুতার পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল। এর ফলে আসামে রক্তাক্ত জাতিদাঙ্গার যে মারাত্মক দৃশ্য দেখা গিয়েছিল তারই একটা বর্ধিত প্রতিচ্ছবি মণিপুরে এখন দেখা যাচ্ছে।

দুঃখের হলেও সত্য, সিপিএম, সিপিআই এবং নকশালপন্থী বলে পরিচিত বামপন্থী নামধারী দলগুলির মণিপুর শাখা সেখানে সরকারের এই ভূমিকার বিরোধিতা করেনি। আর প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস, প্রধানমন্ত্রী কেন মণিপুর যাচ্ছেন না, এই প্রচার ছাড়া সরকারকে চাপ দেওয়ার কোনও উদ্যোগ নেয়নি।

জনজীবনের সাধারণ দাবিগুলি নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই রাস্তা

যে যুবকের কথা দিয়ে এই প্রতিবেদনের শুরু, তাঁর যন্ত্রণাকেই আবার স্মরণ করে বলতে হয়– শাসক বুর্জোয়া শ্রেণির চক্রান্তে পা দিয়ে মণিপুরের সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষের মূল্যবান জীবন ছারখার হয়ে যাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার পর কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার নতুন করে বিভেদ বাড়ানোর রাস্তা নিয়েছে। রাজ্যপাল সময়সীমা বেঁধে লুঠ করা অস্ত্র জমা দেওয়ার কড়া বিবৃতি দিলেও বিজেপির মদতপুষ্ট গোষ্ঠীগুলি এই অস্ত্র জমা দিতে সরাসরি অস্বীকার করছে। সরকার কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। সমস্ত রাস্তা খোলার নামে আদিবাসীদের এলাকায় জোর করে এলাকার বাইরের লোক ঢোকানোর চেষ্টার বিরুদ্ধে মহিলারা রাস্তায় নেমেছেন। এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের এলাকায় যখন যেতেই পারছেন না, রাজধানী ইম্ফলেও একই পরিস্থিতি! এই সময় সেনাবাহিনীর জোরে কিছু বাস চালিয়ে জটিলতা বাড়ানোর চেষ্টা দেখে বোঝা যাচ্ছে বিজেপি সরকার সমস্যার সমাধান আদৌ চায় না। তাই সমস্যা সমাধানে মণিপুরের মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। এই ভ্রাতৃঘাতী বিষাক্ত পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে কুকি-জো, মেইতেই সহ সকল সম্প্রদায়ের খেটে-খাওয়া শোষিত মানুষের সাধারণ সমস্যা– বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষ-স্বাস্থ্যের সুযোগ কেড়ে নেওয়া, জমির অধিকার হারানো, কৃষকের ফসলের দাম না পাওয়া, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের মতো বিষয়গুলির বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়াই-ই এই সমস্যার একমাত্র সমাধান।

মণিপুরের সব সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে আবেদন, সমস্ত উপজাতি ও গোষ্ঠীর সাধারণ সমস্যাগুলি চিহ্নিত করে তা সমাধানের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ গণকমিটি গড়ে অন্দোলনে এগিয়ে আসুন। সরকারকে বাধ্য করুন সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। অন্যথায় ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা ও খেটেখাওয়া মানুষের পরস্পরের ওপর রক্তাক্ত আক্রমণ তাঁদের জীবনের সমস্যাকে বাড়াবে, শোষকদের হাতকেই শক্ত করবে।