১৪ মার্চ শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির দিশারি মহান কার্ল মার্ক্সে ১৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসাবে তাঁরই লেখা ‘মজুরি দাম মুনাফা’র (১৮৬৫) একটি অংশ প্রকাশ করা হল।
‘‘শ্রমের সঙ্গে যন্ত্র অবিশ্রাম প্রতিযোগিতা করছে এবং অনেক সময়েই যন্ত্রের ব্যবহার শুরু করা সম্ভব হয় তখনই যখন শ্রমের দাম একটা বিশেষ মাত্রায় পৌঁছায়। কিন্তু যন্ত্রের প্রয়োগ হল শ্রমের উৎপাদন-শক্তি বৃদ্ধির বহু পদ্ধতির একটি। এই একই যে ঘটনা একদিকে সাধারণ শ্রমকে আপেক্ষিকভাবে প্রয়োজনাতিরিক্ত করে তুলছে, তাই আবার অন্য দিকে দক্ষ শ্রমকেও সরল করে তোলে ও এইভাবে তার মূল্য হ্রাস করে।
এই একই নিয়ম কার্যকরী হয় অন্য ভাবেও। শ্রমের উৎপাদন-শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অপেক্ষাকৃত উচ্চহারের মজুরি সত্তে্বও পুঁজি সঞ্চয়ের গতি ত্বরাণ্বিত হবে। …
… কেউ কেউ অনুমান করতে পারেন যে, পুঁজির দ্রুততর সঞ্চয় শ্রমের চাহিদা বাড়িয়ে দিয়ে মজুরদের অনুকূলেই পাল্লা ঝোঁকাবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বহু সমসাময়িক লেখক বিস্ময় প্রকাশ করেছেন– গত বিশ বছরে ইংরেজ জনসংখ্যার চেয়ে ইংরেজ পুঁজি অত বেশি দ্রুত বেড়ে ওঠা সত্ত্বেও মজুরি তত বেশি বৃদ্ধি পেল না কেন? কিন্তু সঞ্চয়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পুঁজির সংবিন্যাসেরও একটা ক্রমিক পরিবর্তন ঘটে। মোট পুঁজির যে অংশটা গঠিত স্থির পুঁজি, যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, সমস্ত রকমের উৎপাদনের উপায় দিয়ে, সেই অংশটা পুঁজির অন্য যে-অংশ মজুরির জন্য বা শ্রম ক্রয়ের জন্য প্রযুক্ত হয় তার তুলনায় উত্তরোত্তর বেশি করে বৃদ্ধি পায়। …
…শিল্পোন্নতির পথে শ্রমের চাহিদা পুঁজি সঞ্চয়ের সঙ্গে তাল রেখে চলে না। চাহিদাও বাড়তে থাকবে, কিন্তু পুঁজি-বৃদ্ধির তুলনায় তা বাড়বে ক্রমক্ষীয়মাণ হারে। …
আধুনিক শিল্পের বিকাশলাভের ঘটনাটাই যে মজুরের বিপক্ষে আর পুঁজিপতির সপক্ষে উত্তরোত্তর বেশি বেশি করে পাল্লা ভারী করবে আর সেইহেতু পুঁজিবাদী উৎপাদনের সাধারণ ঝোঁক হবে গড়পড়তা মজুরির মান বাড়ানোর দিকে নয়, কমানোর দিকে, অথবা শ্রমের মূল্যকে কমবেশি তার ন্যূনতম সীমায় ঠেলে দেওয়ার দিকেই, তা দেখাবার পক্ষে উপরের কথা ক’টিই যথেষ্ট। এই ব্যবস্থায় ঘটনার প্রবণতা যখন এই দিকে তখন তার অর্থ কি এই যে মজুরদের উচিত পুঁজির জবরদস্তির বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ বন্ধ করা ও তাদের সাময়িক উন্নতির জন্য কালে-ভদ্রে যে সুযোগ মেলে তার যথাসাধ্য সুবিধা গ্রহণের চেষ্টা ছেড়ে দেওয়া? মজুরেরা যদি তাই করে তা হলে তারা এক উদাসীন হতভাগ্যদলের সমস্তরে নেমে যাবে, মুক্তির কোনও আশা যাদের নেই। মনে হয় আমি দেখাতে পেরেছি যে, মজুরির মানের জন্য তাদের সংগ্রামের ঘটনাগুলি সমগ্র মজুরি-প্রথার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত, ১০০-র মধ্যে ৯৯টি ক্ষেত্রেই মজুরি বৃদ্ধির জন্য তাদের সংগ্রামটা হচ্ছে তাদের নির্দিষ্ট শ্রম-মূল্যটা বজায় রাখার চেষ্টামাত্র। আর নিজেদের যে পণ্য হিসেবে বেচতে হয় এই অবস্থার মধ্যেই নিহিত রয়েছে পুঁজিপতির সঙ্গে তাদের শ্রমের দর নিয়ে লড়াইয়ের প্রয়োজন। পুঁজির সঙ্গে তাদের দৈনন্দিন সংগ্রামে তারা যদি কাপুরুষের মতো নতিস্বীকার করে তা হলে নিশ্চয়ই বৃহত্তর কোনও আন্দোলনের উদ্বোধনে তারা নিজেদের অযোগ্য বলেই প্রতিপন্ন করবে।
সেই সঙ্গে মজুরি-প্রথার ভিতরে সাধারণভাবে যে মজুরদের দাসত্ব নিহিত রয়েছে তার কথা বাদ দিলেও শ্রমিক শ্রেণির প্রতিদিনকার লড়াইয়ের চূড়ান্ত ফলাফল নিজেদের মধ্যে অতিরঞ্জিত করে দেখা উচিত নয়। তাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, তারা লড়ছে ফলাফলের সঙ্গে, ঐ ফলাফলের হেতুর সঙ্গে নয়। তারা নিম্ন গতি মন্দীভূত করছে, সে গতির দিক পরিবর্তন করছে না, তারা উপশমের ওষুধ লাগাচ্ছে, রোগ সারাচ্ছে না। সুতরাং পুঁজির অবিরাম আক্রমণ ও বাজারের হেরফের থেকে অনবরত এই যেসব অনিবার্য গেরিলা যুদ্ধের উদ্ভব হচ্ছে তার মধ্যেই নিজেদের একান্তভাবে ডুবিয়ে রাখা তাদের উচিত নয়। তাদের বোঝা উচিত যে, বর্তমান ব্যবস্থা যত দুর্গতিই তাদের উপরে চাপাক না কেন, সেই সঙ্গে এ ব্যবস্থা সমাজের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের পক্ষে প্রয়োজনীয় বৈষয়িক অবস্থা ও সামাজিক রূপ সৃষ্টি করছে। ‘ন্যায্য শ্রম-দিবসের জন্য ন্যায্য মজুরি!’– এই রক্ষণশীল নীতির বদলে তাদের উচিত পতাকায় এই বিপ্লবী মন্ত্র মুদ্রিত করা ‘মজুরি প্রথার অবসান চাই!”