মেয়র ও ডেপুটি মেয়র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৬ জানুয়ারি দিল্লি পুরসভায় যা ঘটল তা বিজেপির চরম নীতিহীনতা এবং ক্ষমতালোলুপতার এক নিকৃষ্ট নিদর্শন হয়ে থাকল। এবং এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিজেপি ও আম আদমি পার্টির (আপ) সদস্যদের মধ্যে যে মারামারির ঘটনা ঘটল তাকেও এক কথায় ন্যক্কারজনক ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।
৭ ডিসেম্বর বিজেপির ১৫ বছরের আধিপত্যকে পরাস্ত করে দিল্লি পুরসভা দখল করে আপ। ২৫০টি আসনের মধ্যে আপ জেতে ১৩৪টি। অন্য দিকে বিজেপি পায় ১০৪টি। স্বাভাবিক ভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আপ। তা সত্ত্বেও এই গণ-রায় মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা বিজেপি নেতারা দেখাতে পারলেন না। বোর্ড দখল করতে মরিয়া হয়ে নেমে পড়লেন তাঁরা। মেয়র এবং ডেপুটি মেয়র পদে প্রার্থী দেয় তারা। তার আগে কাউন্সিলর কেনার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে তাতে সুবিধা করতে না পেরে মাঠে নামায় উপরাজ্যপাল ভি কে সাে’নাকে। মেয়র ও ডেপুটি মেয়র নির্বাচন উপলক্ষে প্রোটেম স্পিকার পদের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া আপ তাদের এক প্রবীণ কাউন্সিলারের নাম প্রস্তাব করে। কিন্তু সাক্সেনা তা নাকচ করে দিয়ে বিজেপি কাউন্সিলার, প্রাক্তন মেয়র সত্য শর্মাকে এই পদের জন্য বেছে নেন। স্বাভাবিক ভাবেই আপ এটিকে উপরাজ্যপালের পদের অপব্যবহার এবং বিজেপির পক্ষে নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব বলে বর্ণনা করে। এ ছাড়াও সাক্সেনা রাজ্যে সরকারে থাকা আপের সঙ্গে কোনও পরামর্শ না করেই দশ জন মনোনীত সদস্যের নাম ঘোষণা করে দেন। আপ অভিযোগ করে, এই দশজনই বিজেপি কর্মী। এ দিন মেয়র নির্বাচনের শুরুতে রীতি অনুযায়ী নির্বাচিত কাউন্সিলারদের শপথ গ্রহণের কথা, পরিবর্তে এই মনোনীত সদস্যদের শপথ শুরু করান সাক্সেনা। আপ তার প্রতিবাদ জানায়। তাঁরা আশঙ্কা করেন, অধিকার না থাকলেও সাক্সেনা এঁদের ভোটাধিকার দেবেন। আপ প্রথমে কাউন্সিলারদের শপথ নেওয়ানোর দাবি জানাতে থাকে। উপরাজ্যপাল এই দাবি না মানায় আপ কাউন্সিলাররা বাধা দেন। তারপরই দুই দলের কাউন্সিলাররা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। নির্বিচারে কিল চড় ঘুষি লাঠি চেয়ার ছোঁড়ছুড়ি চলতে থাকে। উভয় দলের সদস্যরাই আহত হন। সাক্সেনা নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করে দেন।
গায়ের জোরে চূড়ান্ত নীতিহীন কায়দায় বিজেপির ক্ষমতা দখলের এমন চেষ্টা অবশ্য দেশের মানুষকে আর বিস্মিত করে না। ক্ষমতায় বসার আগে যেদিন নেতারা বিজেপিকে ‘আলাদা ধরনের দল’ ঘোষণা করে দেশের মানুষের কাছে সমর্থন চেয়েছিলেন সেদিন স্বাভাবিক সরলতায় বহু মানুষ তা বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু গত প্রায় এক দশকের অভিজ্ঞতায় দেশের মানুষ দেখেছে, ক্ষমতা দখলের জন্য বিজেপি নেতারা এমএলএ কেনা, দল ভাঙানো, পদের লোভ দেখানো, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, ইডি-সিবিআই লেলিয়ে বশে আনা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানো, জাতপাতের জিগির তোলা প্রভৃতি এমন কোনও অনৈতিক রাস্তা নেই যা নেননি। রাজনীতিতে যে নৈতিকতা বলে কিছু আছে, এ দেশেও যে তার উজ্জ্বল নিদর্শন রয়েছে, বিজেপির আচরণ দেখে তা বোঝার উপায় নেই। স্বাভাবিক ভাবেই দিল্লি পুরসভায় বিজেপির আচরণ মানুষকে আর বিস্মিত করেনি। কিন্তু বিজেপির এই নিকৃষ্ট আচরণেও সাধারণ মানুষের সহানুভূতি পাচ্ছেন না আপ নেতারা। কারণ বিজেপির বিকল্প কোনও নীতি বা আদর্শ তাঁরা জনগণের সামনে রাখতে পারেননি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্না হাজারের আন্দোলন, যা দেশ জুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করেছিল, তাকে পুঁজি করে শুরুতে মানুষের সমর্থন পেলেও আজ তাঁদের আচরণে দেশের মানুষ আর অন্য দলগুলির সঙ্গে আপের কার্যত কোনও পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছে না। সাম্প্রতিক গুজরাট নির্বাচনে আপ নেতাদের ধর্মীয় আবেগ উস্কে তোলা বত্তৃতা এবং প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি শুনে বহু মানুষই তাদের বিজেপির বি-টিম বলে অভিহিত করেছিলেন। সম্প্রতি দিল্লি জুড়ে মদের দোকানের ঢালাও লাইসেন্স দেওয়া এবং তাকে কেন্দ্র করে নেতাদের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া এবং সদ্য গঠিত পাঞ্জাব মন্ত্রিসভায় একের পর এক মন্ত্রীর দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া এবং পদত্যাগের ঘটনা সে কথারই সত্যতা প্রমাণ করছে।
আবার এই নীতিহীন বিজেপিই পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের আকণ্ঠ দুর্নীতির দিকে আঙুল তুলে নৈতিকতার চ্যাম্পিয়ান সাজার চেষ্টা করছে। তৃণমূলের প্রতি ঘৃণা এবং পূর্বতন সিপিএম শাসকদের নীতিহীনতায় ক্ষুব্ধ কিছু মানুষ সেই ছদ্মবেশ দেখে তাদের চিনতে ভুল করছে। আজ একটা কথা দেশের মানুষকে নিঃসংশয়ে বুঝতে হবে যে, সম্পূর্ণ পচে যাওয়া, আকণ্ঠ দুর্নীতিতে ডুবে যাওয়া এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সেবা যে দলই করবে সে দল দুর্নীতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। কারণ, এই ব্যবস্থাটি দাঁড়িয়েই আছে সর্বোচ্চ মুনাফার লক্ষে্য শ্রমিক শ্রেণির উপর মালিক শ্রেণির অন্যায় শোষণের উপর ভর করে। তাই আজ রাজনীতিতে নৈতিকতা রক্ষা করতে হলে শোষণমূলক এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা নেই। সরকারি ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খেতে থাকা রাজনৈতিক দলগুলি, তার নাম ও পতাকার রঙ যা-ই হোক, তারা আসলে সবাই মালিক শ্রেণিরই স্বার্থরক্ষাকারী দল। তাই তারা কেউই পুঁজিবাদের বিরোধিতার রাস্তায় হাঁটতে নারাজ।
এই সব দেখতে দেখতে সাধারণ মানুষ এই দলগুলি সম্পর্কে সম্পূর্ণ বীতশ্রদ্ধ। বলেন, ও সব দলই সমান– সব দলই পচে গেছে। কিন্তু এটাই কি সব? মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে রাজনীতিতে একটা নতুন ধারা এ দেশের বুকে প্রতিষ্ঠা করেছেন মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ। এই কারণে অন্য সব দলকে দেখে মানুষ বলে, রাজনীতি হল শয়তানের আখড়া। শিবদাস ঘোষের হাতে গড়া দল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) কে দেখে সেই মানুষই বলেন, এই একটা দল, যারা এমএলএ-এমপি’র তোয়াক্কা না করে জনস্বার্থে লড়াই করে যাচ্ছে। পার্থক্যটা যে রাজনৈতিক মূল দৃষ্টিভঙ্গির, অর্থাৎ শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গির, সেটাকেই আজ স্পষ্ট ভাবে বোঝা দরকার।