ভারতীয় পুঁজিপতিদের মুনাফার মোটা অংশ আসে অস্ত্র বেচে

ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ব্যাঙ্গালোরে অ্যারো ইন্ডিয়ার এক সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রতিরক্ষা মন্ত্রককে বলেন, ২০২৪-‘২৫-এর মধ্যে ভারতের অস্ত্র রপ্তানি ৫ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে হবে। বর্তমানে ভারতের অস্ত্র রপ্তানি ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ দু’বছরের মধ্যে ভারত অস্ত্র রপ্তানি ২৩৩ শতাংশ বাড়াতে চায়। কেন ভারত অস্ত্র ব্যবসায় এত জোর দিচ্ছে? প্রতিরক্ষা বা দেশরক্ষাই যদি অস্ত্র উৎপাদনের উদ্দেশ্য হবে তা হলে রপ্তানি কেন?

ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্পের ৮০ শতাংশই ছিল রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত। রিলায়েন্স, টাটা, আদানি গোষ্ঠী, অশোক লে ল্যান্ড, মাহিন্দ্রা প্রভৃতি ছশোর বেশি কোম্পানি এখন অস্ত্র উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত। শোনা যাচ্ছে উত্তরপ্রদেশ এবং তামিলনাড়ূতে আরও দুটি প্রতিরক্ষা করিডর তৈরি করবে কেন্দ্রীয় সরকার। তাতে বহু বেসরকারি কারখানা হবে। ভারতের ‘ডিফেন্স প্রোডাকশন পলিসি ২০১৮’ র লক্ষ্য ধার্য করা হয়েছে আকাশ যুদ্ধের নির্মাণে দ্রুত দেশকে শীর্ষ পাঁচের মধ্যে নিয়ে যাওয়া।

ভারত অস্ত্র বিক্রির জন্য ৭৫টিরও বেশি দেশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। লাইট কমব্যাট এয়ারক্রাফট তেজস বিক্রির জন্য কথা চলছে আর্জেন্টিনা এবং মিশরের সঙ্গে। সিঙ্গাঁপুর, মালয়েশিয়া, বাহরিন, দুবাইয়ে কয়েক বছর আগে থেকেই অস্ত্র রপ্তানি চলছে। অ্যারোনটিক্স  ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির প্রজেক্ট ডিরেক্টর সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, অন্তত ১৬টি দেশ বিমান কেনার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। মরিসাস চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে সামরিক হেলিকপ্টার কেনার বিষয়ে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ গায়নার সঙ্গে ভারত আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে পেট্রল চালিত জলযান রপ্তানির বিষয়ে। গত বছর ফিলিপিন্সের সাথে ৩৭৫ মিলিয়ন ডলারের ব্রহ্মোস মিসাইল রপ্তানির চুক্তি হয়েছে। এক প্রতিরক্ষা অফিসারের সংযোজন–দক্ষিণ আফ্রিকা, মিশর, আরব, আমিরসাহি, সৌদি আরব সহ দশটি দেশের সঙ্গে ব্রহ্মোস ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রির ব্যাপারেও কথা চলছে। ২০২২ সালে আর্মেনিয়া ভারত থেকে পিনাকা মাল্টিব্যারেল রকেট লঞ্চার, রকেট, অস্ত্রশস্ত্র কেনার জন্য চুক্তি করেছে। আরও বহু উদাহরণ আছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসে মনমোহন সিং নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের আনা উদার অর্থনীতিতে জোর দেন। এর ফলে অস্ত্র রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটে। সম্প্রতি রাজ্যসভায় উত্থাপিত এক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গত দু’বছরে ভারতের অস্ত্র রপ্তানি ৭০ শতাংশ বেড়েছে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পর্যবেক্ষণ ভারতের তিনটি অস্ত্র কারখানা হিন্দুস্তান অ্যারোনেটিক্স লিমিটেড, অবনী এবং ভারত ইলেক্ট্রনিক্স বিশ্বের ১০০টি শীর্ষস্থানীয় কোম্পানির মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে।

ভারতের উৎপাদন সংস্থা অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ড ওএফবি অস্ত্র ছাড়াও অস্ত্রের যন্ত্রাংশ, বিভিন্ন কেমিক্যাল এবং বিস্ফোরক, প্যারাসুট, লেদার এবং সেনাদের জামাকাপড় অন্তত বিশ্বের ৩০টি দেশে রপ্তানি করে, যার মধ্যে জার্মানি, বেলজিয়াম এবং আমেরিকাও রয়েছে।

ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্প এখন বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলির সমতুল্য। ২০২১ সালে মিলিটারি খাতে ভারতের বরাদ্দ ছিল ৪.৭৮ লক্ষ কোটি টাকা অর্থাৎ ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সামরিক বাজেটের দিক থেকে ভারত বিশ্বে তৃতীয়। প্রথম স্থান আমেরিকা (৭৩২ বিলিয়ন ডলার), দ্বিতীয় চিন (২৬১ বিলিয়ন ডলার)।

অস্ত্র আমদানির বিষয়েও ভারত দ্বিতীয়, প্রথম স্থানে সৌদি আরব। অস্ত্র উৎপাদন এবং আমদানি উভয় ক্ষেত্রে কেন ভারত এত জোর দিচ্ছে? কারণ এখানেই রয়েছে বিপুল মুনাফা অর্জনের নিশ্চিত নিরাপদ সুযোগ। এই একটি মাত্র বাজার যেখানে মন্দার ছায়া নেই। প্রায় সব সময়ই তেজিভাব। কারণ এখানে সাধারণ মানুষ ক্রেতা নয়, ক্রেতা সরকার।

জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সরকার অস্ত্র উৎপাদন করে, আমদানি করে। আবার সরকার এবং বৃহৎ পুঁজির মালিকরা বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল মুনাফা অর্জন করে। ফলে সমর শিল্পই অবক্ষয়িত পুঁজিবাদের যুগে শিল্পায়নের মূল ধারা। মার্কসবাদী চিন্তাবিদ শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, ছোট-বড় সব পুঁজিবাদী দেশই অর্থনীতির সামরিকীকরণে জোর দিয়ে থাকে। কারণ বাকি সব শিল্পেই মন্দা। ফলে পুঁজিবাদী অর্থনীতির জরুরি প্রয়োজন হল, সমর শিল্পের বাজার তৈরি করা, তেজি ভাব ধরে রাখা। সেই কারণে মানুষ না চাইলেও তারা যুদ্ধ বাধায়, যুদ্ধের হাওয়া তোলে পুঁজিপতিরা। এ তার অস্তিত্বের শর্ত। যুদ্ধ মানবসভ্যতাকে বহু ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেলেও, পুঁজিপতিদের কাছে যুদ্ধ আসলে লাভজনক ব্যবসা। বিশ্বে শান্তি স্থাপন করতে হলে যুদ্ধবিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামকে তীব্র করতে হবে।