চাকরি নেই, ছাঁটাই আছে৷ মজুরিবৃদ্ধি নেই, মূল্যবৃদ্ধি আছে৷ এমন এক সুসময়ে বিজেপি সরকারের নজর পড়েছে ব্যাঙ্কে গচ্ছিত সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের উপর৷
‘ফিনান্সিয়াল রেজলিউশন অ্যান্ড ডিপোজিট ইনসিওরেন্স (এফআরডিআই)–২০১৭’ নামে এই বিলে বলা হয়েছে, কোনও ব্যাঙ্কে দেউলিয়া ঘোষণার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে ঘুরে দাঁড়াতে গ্রাহকদের জমা করা টাকা তাদের কোনও অনুমতি না নিয়েই কর্তৃপক্ষ বদলে দিতে পারবে ব্যাঙ্কের শেয়ার, ডিবেঞ্চার, বন্ড প্রভৃতিতে৷ অর্থাৎ ব্যাঙ্ক এবং গ্রাহকের মধ্যে সুদ সমেত টাকা ফেরতের যে চুক্তি থাকে তা একতরফা ভাবে বদলে দিতে পারবে ব্যাঙ্কগুলি৷ এই বিল গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষের আর্থিক সুরক্ষায় মস্ত বড় আঘাত৷
বিলের এই উদ্দেশ্য গোপন করে সরকার প্রচার করছে, গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষাই নাকি এর উদ্দেশ্য৷ এর আগে বর্তমান বিজেপি সরকার যখন নোট বাতিল করেছিল কিংবা জিএসটি চালু করেছিল, তখনও একই ভাবে বলেছিল, এগুলির উদ্দেশ্য জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা৷ মানুষ হাড়ে হাড়ে বুঝেছে যে আসলে জনগণের স্বার্থকে দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির পায়ে জলাঞ্জলি দেওয়াই ছিল এগুলির একমাত্র উদ্দেশ্য৷ এই নতুন বিলটিও শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি, বিশেষত হাতে গোনা কিছু ধনকুবেরের পায়ে জনসাধারণকে বলি দেওয়ার আরও নগ্ণ, আরও ঘৃণ্য অপচেষ্টা৷
সাধারণভাবে দেশের ব্যাঙ্কগুলির সামনে আজ প্রধান সমস্যা হল, এনপিএ অর্থাৎ নন পারফর্মিং অ্যাসেট বা অনাদায়ী ঋণ৷ দেশের বৃহৎ পুঁজিপতিরা ব্যাঙ্কগুলি থেকে যে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে শোধ করেনি এবং তা করার কোনও ইচ্ছে তাদের নেই, সেগুলিই ব্যাঙ্কের ভাষায় এনপিএ বা অনুৎপাদক সম্পদ৷ তার পরিমাণ কত? শুধুমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে এর পরিমাণ ২০১৫–র মার্চের ২.৭৫ লক্ষ কোটি থেকে বেডে ২০১৭–র জুনে দাঁডিয়েছে ৭.৩৩ লক্ষ কোটি৷ এ ছাড়া রয়েছে বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির এনপিএ৷ সব মিলিয়ে পরিমাণ প্রায় ১০ লক্ষ কোটি টাকা৷ গত আগস্টে ২৮টি ঋণখেলাপি কোম্পানিকে চিহ্ণিত করেছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক৷ এর মধ্যে মাত্র ১২টি কোম্পানি ঋণ হিসাবে নিয়ে শোধ করেনি ২.৫ লক্ষ কোটি টাকা৷ বাকি টাকাও অনাদায়ী আছে বড় কোম্পানিগুলির কাছেই৷ এরা কারা? মূলত বিদ্যুৎ, ইস্পাত, রাস্তা তৈরির মতো পরিকাঠামো শিল্প ও বস্ত্র শিল্পের মালিকরা৷
এর ফল কী ঘটছে? ব্যাঙ্কগুলি মূলধনের অভাবে নতুন ঋণ দিতে পারছে না৷ এমনকী কোনও কোনও ব্যাঙ্ক পুঁজির অভাবে রুগ্ন হয়ে পড়ছে৷ এমন একটি গুরুতর সমস্যার সমাধান হিসাবে সরকার কী করছে? এইসব বাঘা বাঘা ঋণখেলাপিদের বাধ্য করছে কি ঋণ শোধ করতে? জনসাধারণের কষ্টার্জিত টাকা এভাবে আত্মসাৎ করার জন্য তাদের ধরে কি গারদে পুরছে? না, বড় বড় এই জালিয়াত কোম্পানি মালিকদের টিকিও ছোঁয় না ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ কিংবা পুলিশ৷ কারণ বিজেপি কংগ্রেসের মতো বুর্জোয়া দলগুলি বড় বড় পুঁজিপতিদের আশীর্বাদধন্য৷ যার বিনিময়ে ঐসব কোম্পানি–মালিকরা দুঃসময়ে এইসব দলগুলির রাজনৈতিক সেবা পায়৷ যেমন ঋণখেলাপির ক্ষেত্রে পাচ্ছে৷ বুর্জোয়াদের এইসব দলই সরকারে বসে জনগণের করের টাকা থেকে ব্যাঙ্কগুলিকে ঘাটতি পূরণ করতে টাকা জুগিয়ে যায়৷ সম্প্রতি যেমন প্রধানমন্ত্রী ব্যাঙ্কগুলির ঘাটতি মেটাতে ২ লক্ষ ১১ হাজার কোটি টাকা ঢালার কথা ঘোষণা করেছেন৷ অতীতেও এভাবে বারে বারে হাজার হাজার কোটি টাকা ঢালা হয়েছে৷ প্রতি বাজেটে বিপুল অঙ্কের একটা টাকা এই খাতে বরাদ্দই রাখে সরকার৷ অথচ সাধারণ মানুষ, যাঁরা ছোট ছোট ব্যবসা বা অন্য নানা কারণে ঋণ নিয়ে থাকেন, তাঁদের ঋণ কোনও কারণে বাকি পড়লে পুলিশ তাঁদের কোমরে দড়ি দিয়ে গারদে পুরে দেয়৷
কিন্তু ব্যাপারটা কি এমন যে, এই সব পুঁজিপতিরা সত্যিই কলকারখানার উৎপাদনে বা ব্যবসায় এমন মার খেয়েছে যে ভিখারি হয়ে গিয়ে ঋণ শোধ করতে পারছে না? দেউলিয়া হয়ে গিয়ে আত্মহত্যা করছে? মোটেও তা নয়৷ দেখা যাচ্ছে তারা বহাল তবিয়তেই আছে এবং অন্য ব্যবসাগুলির মুনাফায় তারা ফুলে–ফেঁপে ঢোল হয়ে যাচ্ছে৷ গত সাত–আট বছর ধরে পৃথিবী জুড়ে যে একটানা মন্দা চলছে, ভারত তার বাইরে নয় এ কথা ঠিক৷ কিন্তু তার জন্যই এই সব পুঁজিপতিরা ঋণ শোধ করতে পারেনি, ব্যাপারটা এমন নয়৷ এই সব কোম্পানির মালিকরা পরিকল্পিত ভাবে কোম্পানি থেকে তাদের নিজস্ব বিনিয়োগ মোটা মুনাফা সমেত আগেই সরিয়ে ফেলেছে৷ বরং তাদের এইভাবে টাকা সরিয়ে নেওয়াই কোম্পানিগুলিকে দ্রুত দুর্বল করেছে এবং তাদের ঋণ এনপিএ–তে পরিণত হয়েছে৷ নতুন বিলে কিন্তু এই সব দুর্নীতিগ্রস্ত মালিকদের থেকে অনুৎপাদক সম্পদ উদ্ধারের জন্য, অর্থাৎ ঋণের টাকা ফেরত দিতে বাধ্য করার জন্য কোনও পদক্ষেপের কথাই বলা হয়নি৷ কিংবা ভবিষ্যতে যাতে আর কোনও পুঁজিপতি জনগণের টাকা এভাবে চূড়ান্ত অন্যায় এবং বেআইনি উপায়ে আত্মসাৎ করতে না পারে তারও কোনও ব্যবস্থার কথাও এই বিলে বলা হয়নি৷ এ থেকেই প্রমাণ হয় পুঁজিপতিদের কাছ থেকে অনাদায়ী ঋণ উদ্ধার করা এই বিলের কোনও উদ্দেশ্যই নয়৷
এই অবস্থায় ব্যাঙ্কগুলিতে যেভাবে লাফ দিয়ে এনপিএ–র পরিমাণ বাড়ছে তাতে ব্যাঙ্কগুলি বাঁচবে কী করে? কোনও অসুবিধা নেই জবাই করার জন্য রয়েছে আমজনতা তথা ব্যাঙ্কের আমানতকারী সাধারণ মানুষ৷ বিলের ৫২নং ধারায় একটি ‘বেল ইন’–এর ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে৷ এত দিন পর্যন্ত কোনও কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যদি কোনও ব্যাঙ্কের ব্যবসা চালানোর ক্ষমতা বিপন্ন হয়ে পড়ত তবে সরকার টাকার জোগান দিত৷ একে বলা হয় ‘বেল আউট’ করা৷ এখন থেকে আর সরকার এভাবে বাইরে থেকে টাকা দেবে না৷ ব্যাঙ্ককে ভেতর থেকেই এই জোগানের ব্যবস্থা করে দিতে চায় সরকার৷ অতএব লুঠ করো আমনতকারীদের টাকা৷ এই ধারা অনুযায়ী সেই পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়াতে আমানতকারীদের টাকাকেই কাজে লাগানো হবে৷ এখন কোনও একটি ব্যাঙ্কে যতগুলি অ্যাকাউন্টে যত টাকাই কারও থাকুক না কেন, সেই ব্যাঙ্কের ব্যবসা লাটে উঠলে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত নিশ্চিত ভাবে ফেরত পাবেন তিনি৷ কারণ, গ্রাহকপিছু ওই টাকা বিমা করা থাকে৷ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে বাকি টাকার পিছনেও থাকে কেন্দ্রের অলিখিত গ্যারান্টি৷ নতুন আইনে এই টাকা ফেরত পাওয়ার কী হবে তার কোনও দিশা নেই৷ এমনকী বিমার পরিমাণ এক লক্ষ টাকাই থাকবে, না আরও কমবে, তার কোনও হদিশ এই বিলে নেই৷
খসড়া বিলে ফিনান্সিয়াল রেজলিউশন কর্পোরেশন গঠনের কথা বলা হয়েছে৷ এর অধিকাংশ সদস্য হবেন কেন্দ্রীয় সরকারের মনোনীত৷ তাঁরাই ব্যাঙ্কের আর্থিক পরিস্থিতি বিচার করে বলবেন ব্যাঙ্ক বিপদসীমার কাছে আছে কি না৷ এ ক্ষেত্রে তারা ব্যাঙ্ককে আর্থিক দায়মুক্ত করতে বেল ইনের সিদ্ধান্ত নেবে৷ অর্থাৎ আমানতকারীদের জমা রাখা টাকা তাদের কোনও অনুমতির তোয়াক্কা না করেই বদলে দিতে পারবে শেয়ার, ডিবেঞ্চার, বন্ড প্রভৃতিতে৷ বাস্তবে ব্যাঙ্ক যদি ফেল পড়ার মুখে চলে যায়, এমনকী রুগ্নও হয়ে যায় তবে স্বাভাবিক ভাবেই এই শেয়ার, ডিবেঞ্চার, বন্ডের মূল্য যে শূন্যে পরিণত হবে তা বলা বাহুল্য৷ এ ছাড়াও এই কর্পোরেশন চাইলে আমানতকারীর সঙ্গে ব্যাঙ্কের সুদসহ টাকা ফেরত দেবার চুক্তিটা সম্পূর্ণ বাতিল করে দিতে পারে৷ সে ক্ষেত্রে আমানতকারী তার জমা টাকার এক পয়সাও ফেরত পাবেন না৷ আমানতকারীকে টাকার বদলে ব্যাঙ্কের শেয়ার নিতে বাধ্য করতে পারে৷ চাইলে চুক্তির শর্ত বদলে আমানতের মেয়াদ বাডিয়ে দিতে পারে অথবা সুদের হার কমিয়ে দিতে পারে৷ ফলে অধিকাংশ সাধারণ মানুষ যাঁরা তাঁদের কষ্টার্জিত টাকা ব্যাঙ্কে রাখেন ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের কথা ভেবে, অর্থাৎ সংসার চালানো, মেয়ের বিয়ে দেওয়া, চিকিৎসা, সন্তানের শিক্ষা প্রভৃতি নানা প্রয়োজনে, তাঁদের এই টাকা যা আসলে ব্যাঙ্কের আমানতের সিংহভাগ, বিজেপি সরকার সেই মানুষগুলোর অধিকাংশেরই শেষ সম্বলকে এই ভাবে পুঁজিপতিদের জালিয়াতির খেসারত হিসাবে ব্যবহার করতে চলেছে৷ অর্থাৎ পুঁজিপতিরা তাদের জালিয়াতি চালিয়ে যাবে, লুটের টাকায় পুঁজির পাহাড় গড়বে, আর সবকিছু হারিয়ে সাধারণ মানুষ পথে বসতে, আত্মহত্যা করতে বাধ্য হবে৷ কংগ্রেস আমলেও কংগ্রেসি নেতাদের বদান্যতায় বড় বড় পুঁজিপতিরা ব্যাঙ্ক থেকে মোটা টাকা একইভাবে ঋণ নিয়ে ফেরত দেয়নি৷ বিজেপি শাসনে পুঁজিপতিরা আরও অনেক বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এবং তাদের এই লুঠতরাজের খেসারত আসবে সাধারণ মানুষের আমানত লোপাট করে৷ পুঁজিপতিদের হয়ে এতবড় নির্লজ্জ দালালি ইতিপূর্বে আর কেউ করতে পারেনি৷ এ জন্যই তো ২০১৪ সালের নির্বাচনে কর্পোরেট পুঁজির অঢেল সমর্থন ছিল মোদির পিছনে৷
ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের পর থেকে এখনও কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ফেল পড়েনি৷ কিছু কিছু বেসরকারি ব্যাঙ্কের আর্থিক অবস্থা কখনও বিপন্ন হলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক হস্তক্ষেপ করে আমানতকারীদের টাকার সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছে৷ তা হলে ৫২ নং ধারাটি সরকার নিয়ে এল কেন? এই ধারা থেকেই তো স্পষ্ট, বিজেপি সরকার অনেক সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনা নিয়ে এই ধারা যোগ করেছে৷ অর্থাৎ বিজেপি সরকার অনাদায়ী ঋণ উদ্ধারের জন্য পুঁজিপতিদের উপর কোনও চাপ সৃষ্টি করবে না৷ আবার ব্যাঙ্কগুলোকেও বাঁচিয়ে রাখা দরকার৷ তাই জনগণের উপর বোঝা চাপাও৷
ব্যাঙ্কগুলি আমানতের সুদের পরিমাণ ক্রমাগত কমিয়ে চলেছে৷ সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষ একটু বেশি সুবিধা পাওয়ার আশায় চিটফান্ডগুলিতে টাকা রেখে কীভাবে প্রতারিত হয়েছে তা সকলেরই জানা৷ বিজেপি সরকার যদি এই মারাত্মক আইন পাশ করিয়ে নিয়ে আসে, যদি ব্যাঙ্কে আমানতের নিরাপত্তা না থাকে তবে সাধারণ মানুষ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে বাধ্য হবে৷ তাতে লাভ পুঁজিপতিদেরই৷ কারণ শেয়ার বাজারে বাড়তি বিনিয়োগ হলে শেয়ারের দাম বাড়বে৷ পুঁজিপতিদের হাতেই যেহেতু কোম্পানির বেশির ভাগ শেয়ার, তাই এর দ্বারা তারাই লাভবান হবে সবচেয়ে বেশি৷
স্বাভাবিকভাবেই সাংঘাতিক এই বিলের বিরুদ্ধে দেশের সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েছে৷ সেই ক্ষোভের সামনে পড়ে বিজেপি সরকার বিলটিকে বর্তমান অধিবেশনে পেশ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ তার মানে এই নয় যে, এই আইন হবে না৷ সুযোগ পেলেই তারা এই আইন চালু করবে৷ কারণ পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষায় বিজেপির যে সামগ্রিক পরিকল্পনা এবং পুঁজিপতি শ্রেণি তাদের স্বার্থ রক্ষার যে দায়িত্ব বিজেপিকে দিয়েছে, তার কোনও পরিবর্তন হয়নি৷ এই অবস্থায় জনসাধারণের স্বার্থ রক্ষার একমাত্র গ্যারান্টি হল সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে সংগঠিত আন্দোলনের রূপ দেওয়া৷ এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) কেন্দ্রীয় কমিটি এই দানবীয় বিলের বিরুদ্ধে দেশজোড়া আন্দোলনের ডাক দিয়েছে৷ সব স্তরের মানুষকে আজ সেই আন্দোলনে সামিল হতে হবে৷