৪ অক্টোবর লোহনক হ্রদে প্রবল জলোচ্ছ্বাসের জেরে হওয়া হড়পা বানে বিধ্বস্ত সিকিম। ইতিমধ্যেই ৪০ জনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে, নিখোঁজ শতাধিক। সরকারি হিসেবেই বিপন্ন হয়ে পড়েছেন ৮৬ হাজারেরও বেশি মানুষ। বিপর্যয়ের বেশ কয়েকদিন পরেও মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে নদীর বুকে পাথরের খাঁজে। এমনকি সমতল এলাকা জলপাইগুড়িতে ভেসে এসেছে কিছু নিষ্প্রাণ দেহ। মৃতের সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা বলা যাচ্ছে না। সিকিমের লাইফলাইন পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সংযোগকারী ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। উত্তরবঙ্গের কালিম্পং ও দার্জিলিং জেলার একাংশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রবল বৃষ্টি, হিমবাহের গলন বা ভূমিকম্প একাধিক কারণে এই বিপর্যয়।
কেন্দ্রীয় সরকার সিকিমের ত্রাণ ও উদ্ধারকাজের জন্য কিছু টাকা বরাদ্দ করেই দায়িত্ব শেষ করেছে। এ রাজ্যের তৃণমূল সরকার কেন্দ্রের কাছে বরাদ্দের দাবি জানিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। এর সবগুলিই কোনও না কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মৃত্যু ও ধ্বংসের পরের চেনা ছবি।
এর আগেও উত্তরাখণ্ডে ও হিমাচলপ্রদেশে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিপন্ন হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। প্রকৃতির নিয়ম না মেনে যথেচ্ছাচারের ফল কী, তার প্রমাণ মিলেছে সেখানেও। তা হলে সিকিম আলাদা কোথায়? সিকিমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে ২০ বছর আগেই একদল গবেষক সে বিষয়ে সরকারকে সতর্ক কর়েছিলেন। গবেষকদের একজন, দিল্লির জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এই বিপর্যয়ের পর প্রকাশ্যে আনেন বিষয়টি। অর্থাৎ বিপর্যয় ঘটতে পারে জানা সত্ত্বেও তা প্রতিরোধে সরকার কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। সরকার যদি এই রিপোর্টকে উপেক্ষা না করত, তাহলে হয়ত এভাবে জীবন দিয়ে চরম মূল্য দিতে হত না অসংখ্য অসহায় মানুষকে, হয়ত এই ভয়ঙ্কর ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা হলেও এড়ানো যেত।
সরকারের অবহেলার কারণ কী? পর্যটনকে এখন কিছুটা লাভজনক শিল্প হিসাবে দেখছে একচেটিয়া মালিকরা। তাদের মুনাফা বাড়াতে প্রশাসনের সহায়তায় পাহাড়ের কোলে অপরিকল্পিত নগরায়ণ চলছে, যা ভঙ্গুর, ধসপ্রবণ পাহাড়ি এলাকার পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। এ ছাড়াও বিদ্যুতের ব্যবসায় বেশি মুনাফার খোঁজ পেয়ে পুঁজি মালিকরা ছুটছে সেদিকে। সরকারও তাদের সাহায্য করছে, যত্রতত্র জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ার অনুমতি দিচ্ছে। পাহাড়ের যেখানে-সেখানে ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ধসিয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হয়েই চলেছে। প্রকৃতিও তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। যে কোনও সময় পাহাড়ে ধস নামছে। নদীর গতিপথ রুদ্ধ করে যত্র-তত্র নির্মাণ কাজও বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ।
বিপর্যয়ের ডিনামাইটের উপর অবস্থান করছে তিস্তা বেসিনের দু’পাশে থাকা সিকিমের চুংথাং, লাচুং, মঙ্গন, দিকচু, সিংটাম, রঙ্গো ও মেলি এবং উত্তরবঙ্গের তিস্তা বাজার, সেবক, জলপাইগুড়ি সহ কয়েকটি স্থানের বসতি এলাকা। সরকার ও প্রশাসনের অবহেলা তাদের বিপদকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। হিমালয়ের মতো অতি ‘সেনসেটিভ’ একটি প্রাকৃতিক অঞ্চলকে যেমনতেমন ভাবে ব্যবহার করতে যাওয়া আত্মঘাতের সামিল। মুনাফালোভী বুর্জোয়া ব্যবস্থার পরিচালকরা প্রকৃতির সমস্ত সম্পদকে শোষণ করে মুনাফা করার তাগিদে তা জেনেও বিজ্ঞানীদের হুঁশিয়ারিকে অবহেলা করছে।
২০০৩ সালে প্রথম প্রকাশিত একটি গবেষণায় সতর্ক করা হয়েছিল, সিকিমের ১৪টি লেক অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। এরপর ২০১৩ এবং ২০১৭ সালে আরও দুটি গবেষণা করে বিপদের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন গবেষকরা। এমনিতেই কোনও নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে মুনাফার লক্ষ্যে চলা পুঁজিবাদী ‘উন্নয়ন’ বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটাচ্ছে। গলছে হিমবাহ। তাতে হঠাৎ করে জলস্ফীতি হলে হিমবাহ থেকে তৈরি হ্রদ সেই জল ধারণ করতে পারে না। সিকিমের লোহনক হ্রদ এই ধরনের হিমবাহী হ্রদ। সেজন্য দুর্ঘটনার আশঙ্কা ছিল। গবেষকদের ও বিশেষজ্ঞদের সতর্কবাণী উপেক্ষা করে সরকার ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১২০০ মেগাওয়াটের একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। এর ফলে সেখানে একটি বিশাল বাঁধ নির্মাণ করতে হয়। পরিবেশবিদদের মতামতের কোনও তোয়াক্কা না করেই এবং ভৌগোলিক অবস্থান বিচার না করে একতরফাভাবে এই সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন। ভুটানের চুখা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মডেলে সিকিমের পর্যাপ্ত জল ব্যবহার করে ৫,২৪৮ মেগাওয়াট সম্পন্ন আরও ২৭টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা করে। কিন্তু কিছু জায়গায় স্থানীয় মানুষের প্রবল বিরোধিতায় বেশিরভাগ প্রকল্প অনুমোদন পায়নি, মাত্র ৯টি কেন্দ্র অবশেষে অনুমোদন পায়। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নদীতে বাঁধ নির্মাণের সাথে সাথে অন্যান্য নির্মাণকাজও চলতে থাকে। এর ফলে পরিবেশের উপর কী বিরূপ প্রভাব পড়বে সে সব বিচার করা দরকার ছিল।
কিন্তু পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষায় দায়বদ্ধ সরকার কোনও প্রকল্প করার ক্ষেত্রে পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যাকে একদমই গুরুত্ব দেয় না। আশু লাভই তাদের কাছে বিচার্য। ফলে সরকারের চূড়ান্ত অবহেলায় বিপদ বেড়েই চলেছে।
প্রতি বছর কোথাও না কোথাও বিপর্যয় ঘটে চলেছে। সরকারি অবহেলার পরিণামে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রভূত উন্নতি সত্ত্বেও প্রকৃতির ধ্বংসযজ্ঞে আহুতি দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকেই।