আদানি দুর্নীতির তদন্তে কমিটি তৈরিতে বন্ধ খামের ‘পরামর্শ’ খারিজ করে দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে এক বড় ধাক্কা দিল। আদানি গোষ্ঠী জালিয়াতির মাধ্যমে তাদের সংস্থাগুলির শেয়ারের দাম অনেকখানি বাড়িয়ে দেখিয়েছে, হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে এই তথ্য প্রকাশ পেতেই কোম্পানির শেয়ারের দাম পড়ে অর্ধেক হয়ে যায়। সংস্থায় লগ্নিকারীরা বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হন। এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে লগ্নিকারীদের অর্থের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে সুপ্রিম কোর্ট একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেয়। মোদি সরকার তা অস্বীকার করতে না পেরে বলে, সেই কমিটিতে কারা থাকবেন, তার কাজের পরিধি কী হবে, তা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার মুখবন্ধ খামে সুপ্রিম কোর্টকে তার ‘পরামর্শ’ জানাবে।
ইতিমধ্যে দেশ জুড়ে এই দাবি প্রবল হয়েছে যে, আদানি-কেলেঙ্কারিতে সরকারের অর্থ দফতর, সেবি, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভূমিকা কী ছিল, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আদানির ঘনিষ্ঠতার প্রভাব এই কাণ্ডে কী ভাবে পড়েছে, সরকার এই বেআইনি কাজে আদানিদের কী ভাবে সহায়তা করেছে, বিনিময়ে বিজেপি কী কী সুবিধা পেয়েছে প্রভৃতি বিষয়গুলিকে অন্তর্ভুক্ত কর়ে তদন্ত করতে হবে। সরকারের দেওয়া মুখবন্ধ খাম খুলে ‘পরামর্শ’গুলি খতিয়ে দেখে প্রধান বিচারপতি জানান, সরকার নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করলে তার স্বচ্ছতা থাকবে না। তিনি জানান, সুপ্রিম কোর্টই তদন্ত কমিটি গঠন করবে।
স্বাভাবিক ভাবেই ‘পরামর্শ’ নাকচ করে দেওয়া সরকার তথা বিজেপি নেতাদের কাছে একটি বড় ধাক্কা। পরামর্শ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়, প্রধানমন্ত্রী সহ বিজেপি নেতারা ভেবেছিলেন, তদন্ত কমিটিতে কারা থাকবেন, তার কাজের পরিধি কী হবে তা বেঁধে দিয়ে তাঁরা তাঁদের ইচ্ছামতো তদন্তকে পরিচালিত করতে পারবেন এবং নিজেরা তদন্তের আওতা থেকে আড়ালে থাকতে পারবেন। অর্থাৎ ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে অভিযুক্ত বিজেপি নেতারাই ঠিক করে দিতে চেয়েছিলেন তদন্ত কোন পথে হবে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে বিজেপি নেতাদের সেই ‘পরিকল্পনা’ ধাক্কা খেয়ে থেমে গেছে।
কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতায় বসা থেকেই বিজেপি নেতারা একের পর এক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে কব্জা করতে নেমে পড়েন। বহু ক্ষেত্রেই সেই চেষ্টা সফল হয়েছে। আইনমন্ত্রী লাগাতার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের কলেজিয়াম ব্যবস্থার সমালোচনা করতে থাকেন। বিজেপি নেতাদের লক্ষ্য, বর্তমান কলেজিয়াম ব্যবস্থা বাতিল করে বিচারপতিদের নিয়োগ ক্ষমতা সরকারের নিজের হাতে নিয়ে আসা। এই লক্ষে্য চাপ তৈরি করতে তাঁরা আরএসএস এবং উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়কেও মাঠে নামান।
সম্প্রতি আরএসএসের মুখপত্রে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধে ভারতকে বদনামের লক্ষে্য সুপ্রিম কোর্ট হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। তাদের আরও অভিযোগ, জনগণের অর্থে পরিচালিত সুপ্রিম কোর্ট দেশ বিরোধিতার কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে। উপরাষ্ট্রপতিও বারবার কলেজিয়াম প্রশ্নে সরকারি আধিপত্যের পক্ষে সওয়াল করেছেন।
বুঝতে অসুবিধা হয় না, সরকার কেন বিচারপতি নিয়োগ ব্যবস্থাকে কব্জা করতে চায়। বিজেপি নেতাদের উদ্দেশ্য একদিকে সুপ্রিম কোর্টকে চাপে রেখে আদানি-কেলেঙ্কারির তদন্তকে নিয়ন্ত্রণ করা, কলেজিয়াম ব্যবস্থা তুলে দিয়ে পছন্দমতো বিচারপতি নিয়োগ করে পছন্দমতো রায় বের করে আনা এবং অন্য দিকে প্রতিদিন নতুন নতুন ক্ষেত্রে সরকারের ভাবমূর্তিতে যে ভাবে কালি লাগছে তাতে জাতীয়তাবাদ, দেশের স্বার্থ প্রভৃতি কথার ধূমজাল তৈরি করে সেই কালিকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এস আব্দুল নাজিরকে অবসরের ঠিক পরেই যে ভাবে কেন্দ্রীয় সরকার অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্যপাল হিসাবে নিয়োগ করে এবং প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-এর অবসরের পরই তাঁকে রাজ্যসভায় মনোনয়ন দিয়ে দেওয়া হয়, তাতে এর পিছনে নোট বাতিল এবং রামমন্দির সহ বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে সরকারের পছন্দমতো রায় দেওয়ার যে ভূমিকা রয়েছে, এই অভিযোগ আজ জনমনে দৃঢ়।
একটা বিষয় পরিষ্কার, ক্ষমতায় বসার পর বিজেপি যে রকম বেপরোয়া ভাবে সমস্ত ক্ষেত্রেই ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে, এমকি কোর্টের বিভিন্ন রায়কেও নানা উপায়ে প্রভাবিত করছে, তাতে হঠাৎ সুপ্রিম কোর্ট এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিল কেন? বিশেষ করে আদানি-কাণ্ডে তদন্তের প্রশ্নে? তবে কি এখন ভারতের একচেটিয়া পুঁজিপতিরাও দ্বিধাবিভক্ত? আদানি ইস্যুকে কেন্দ্র করেই কি পুঁজিপতিদের মধ্যে গোষ্ঠীবিবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে? ভবিষ্যতই এর জবাব দিতে পারবে। তবে এ কথা ঠিক যে, সুপ্রিম কোর্টের এই রায় বিজেপির পক্ষে এক বিরাট ধাক্কা, যা কলেজিয়াম ব্যবস্থা বাতিল করার পক্ষে বিজেপিকে কোনও সুবিধা দেবে না, বরং বিরুদ্ধেই যাবে। সুপ্রিম কোর্টের রায় বুঝিয়ে দিল, কলেজিয়াম প্রথা বাতিল করতে বিজেপি নেতৃত্বের কেন এত ব্যগ্রতা।