মানসিক অবসাদ, অবসাদজনিত আত্মহত্যা, একাকীত্ব আজকের সমাজে নতুন নয়। সংবাদপত্র, সোশ্যাল মিডিয়া, টিভির খবরে চোখ রাখলেই দেখা যায়, মানসিক অবসাদের প্রকোপ সর্বত্র ক্রমাগত বাড়ছে। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এর বাড়বাড়ন্ত চোখে পড়ার মতো। একচেটিয়া পুঁজিশাসিত সমাজ মুষ্টিমেয় পুঁজিমালিকের বিপুল মুনাফার বিনিময়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষকে শুধু আর্থিক ভাবেই নিঃস্ব করেনি, কেড়ে নিচ্ছে মনের স্বাভাবিক সুস্থতা, আনন্দ, প্রশান্তিও। পুঁজির স্বর্গরাজ্য আমেরিকার বুকে একটি সংস্থার সাম্প্রতিক সমীক্ষা রিপোর্টে নতুন করে উঠে এসেছে মানসিক স্বাস্থ্যেযর এই উদ্বেগজনক ছবি।
‘আমেরিকা’ বললে এই সেদিনও মূলধারার মিডিয়ার দৌলতে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের সাধারণ মানুষের চোখে এক ঝাঁ-চকচকে সুখী সমৃদ্ধ দেশের ছবি ভেসে উঠত। বিশ্বায়নের কল্যাণে হাজারো আমেরিকান ব্র্যান্ড ঢুকে পড়েছিল ভারতবর্ষের উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তদের ঘরে ঘরে। সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোর রমরমাকে কেন্দ্র করে কিছুদিনের জন্য এ দেশের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছাত্রদের ঢল নেমেছিল আমেরিকার কর্মক্ষেত্রে, যার পোশাকি নাম হয়েছিল ‘ব্রেন ড্রেন’। আজ সময় আরও এগিয়েছে। আরও তীব্র হচ্ছে পুঁজিবাদের শোষণ। কল্যাণকামী রাষ্ট্রের মুখোশ খুলে ক্রমশ বেরিয়ে পড়ছে শাসকের নখ-দাঁত। ইন্টারনেটের কল্যাণে আমেরিকা সহ প্রথম বিশ্বের দেশগুলোর দারিদ্র, কর্মহীনতা, শ্রমিক বিক্ষোভের পরিসংখ্যান পাওয়া আজ কোনও কঠিন ব্যাপার নয়। আমেরিকার বুকে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলন, জর্জ ফ্লয়েড হত্যা এবং তার পরবর্তী গণবিক্ষোভের মতো অজস্র ঘটনা প্রমাণ করেছে– দারিদ্র, বৈষম্য, জাতিভেদ, আর্থ-সামাজিক সমস্যা মোকাবিলায় সরকারের উদাসীনতা এবং অপদার্থতাকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমেরিকার মানুষের মধ্যেও প্রতিনিয়ত জমা হচ্ছে ক্ষোভের পাহাড়। ছাত্র-যুবদের মানসিক স্বাস্থ্যের এই সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, ভৌগোলিক বা আর্থ-সামাজিক ব্যবধান যাই থাক, দেশে দেশে তরুণ প্রজন্মের অবসাদগ্রস্ততার ছবিটা কমবেশি একই রকম।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ডিসিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এই রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে মাস দুই আগে। আমেরিকায় যুবসমাজ তথা স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মানসিক অবসাদ কী ব্যাপক হারে বাড়ছে, তার ভয়াবহ ছবি উঠে এসেছে ওই সমীক্ষায়। ২০২১ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে যে ১ কোটি ৭০ লক্ষ ছাত্রছাত্রী বেসরকারি এবং সরকারি স্কুলে ভর্তি হয়, তার মধ্যে ৭০ লক্ষেরও বেশি তীব্র হতাশা ও অবসাদের কবলে পড়ে। মানসিক চাপ ও বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্য আত্মহত্যা করে প্রায় ১৭ লক্ষ জন। তথ্য বলছে, দেশের বুকে ১৫ থেকে ১৮ বছরের ছেলেমেয়েদের মৃত্যুর প্রধান কারণই হল অবসাদজনিত আত্মহত্যা।
সিডিসি এর কারণ হিসেবে দু’বছর ধরে চলা করোনা অতিমারিকে চিহ্নিত করেছে, যার ফলে সমাজের মানসিক স্বাস্থ্য ক্রমাগত ভেঙে পড়েছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে চরম দারিদ্র, সামাজিক অসাম্য, পুলিশি অত্যাচার ও যুদ্ধ। ইম্পেরিয়াল কলেজ-লন্ডন-এর তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকায় প্রায় আড়াই লক্ষ তরুণ করোনা অতিমারির সময় রুজিরুটি হারিয়েছিলেন। কোভিডের আক্রমণে মা-বাবার মৃত্যুর পর মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন আরও অনেকে। ২০২০ সালে এই সংস্থাই আমেরিকায় অভিভাবকদের উপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখিয়েছিল, অতিমারিজনিত আর্থিক বিপর্যয়, প্রিয়জনের মৃত্যু কী ভাবে আমেরিকার মানুষকে দিশাহীন অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। আমেরিকায় ওয়েন স্টেট ইউনিভার্সিটির চাইল্ড অ্যান্ড ফ্যামিলি বিভাগের অধ্যাপক লাকি (ক্যাথলিন) ম্যাকগর্ন বলেন, বহু অভিভাবক কোভিডের সময় মানসিক উত্তেজনায় বিধ্বস্ত হয়েছেন, অনেকেই ভুগেছেন মানসিক অবসাদে। অভিভাবকদের মানসিক অস্থিরতা, অবসাদ স্বভাবতই সন্তানদেরও প্রভাবিত করেছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়ানক হয় যে, ‘আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিকস’ শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। স্বভাবতই, দেশের নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্যের এই শোচনীয় অবস্থায়, সরকারের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। গোটা বিশ্বের মধ্যে কোভিডে মৃত্যুতে আমেরিকা ছিল একেবারে সামনের দিকে। সেখানে স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেহাল দশা, সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে থাকা বিপুল ব্যয়বহুল চিকিৎসা-ব্যবস্থার ছবি বিভিন্ন মাধ্যমে উঠে আসে। এই সমীক্ষা এটাও প্রমাণ করল, স্বজনহারা মানুষগুলোর দেখভালের জন্য, ছাত্র-যুবকদের মানসিক সমস্যার প্রতিবিধানের জন্য কোনও কার্যকরী পদক্ষেপ সরকার নেয়নি। সমীক্ষা বলছে, আমেরিকায় নারীসমাজের অবস্থাও উদ্বেগজনক। ৫৭ শতাংশ ছাত্রী চরম হতাশার মধ্যে দিয়ে গেছে, ৪১ শতাংশ জানিয়েছে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির কথা। তার আগের পুরো বছর জুড়ে ৩০ শতাংশ ছাত্রী আত্মহননের পথ বেছে নেওয়ার কথা ভেবেছে। এদের বড় অংশই আত্মহত্যা করেছে অথবা তার চেষ্টা করতে গিয়ে গুরুতর জখম হয়েছে। বোঝাই যায়, এই পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। করোনাজনিত মানসিক স্বাস্থ্যহানি এর একমাত্র কারণও নয়। আর্থিক অসাম্য, পুলিশি অত্যাচার, যুদ্ধ, নিরাপত্তার অভাব বছরের পর বছর দেশের মানুষকে এক অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য করেছে, যার ফলাফল উঠে এসেছে এই রিপোর্টে।
বছর বছর এই ধরনের সমীক্ষা হয়, ফল বেরোয়। দেখা যায়, আমেরিকা, ইউরোপ থেকে শুরু করে সমস্ত পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশে মানসিক স্বাস্থ্যের গ্রাফ ক্রমশই নিম্নগামী। ভারতেও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠরত মেধাবী ছাত্রছাত্রীর আত্মহত্যার সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। আর্থিক দুর্দশা দিয়েও সবটা ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না, কারণ এই অবসাদ-আত্মহত্যা উচ্চবিত্তদের মধ্যেও যথেষ্ট বেশি। তা হলে এর উৎস কী, শেষই বা কোথায়? চিকিৎসা বা কাউন্সেলিং দিয়েও বাঁধভাঙা বন্যার মতো এই অবসাদ তেমনভাবে আটকানো যাচ্ছে না কেন? এই সর্বনাশ আটকানোর পথ কী?
এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায়। প্রতিযোগিতা এই পুঁজিবাদী সমাজের মূলগত বৈশিষ্ট্য। স্বভাবতই উপরিকাঠামো তথা সমাজের মানসিক কাঠামোতেও তার প্রতিফলন ঘটে। তাই মানুষও এই সমাজে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। এই সমাজে প্রত্যেকেই যেন প্রত্যেকের চরম প্রতিদ্বন্দ্বী। যত দিন যাচ্ছে, পুঁজিবাদী সমাজের সঙ্কট বাড়ছে দ্রুত হারে। একই সাথে বাড়ছে একদিকে সুযোগের অভাব, অন্যদিকে অন্যকে দমিয়ে নিজেকে বড় করে তোলার প্রবণতা। এই সমাজে সকলকে পিছনে ফেলে এগোতে না পারলে মূল্য থাকবে না– এই আশঙ্কা চেপে বসছে বহু মানুষের মনে। তার জন্য সবেতেই প্রথম হওয়ার এত চাপ।
তারই সঙ্গে মানুষকে ঘিরে রয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। অনেক খরচ করে ডিগ্রি তো জোগাড় করা গেল, কিন্তু কাজ মিলবে তো? আজ কাজ আছে, কাল থাকবে তো! কাজের জায়গায় চূড়ান্ত পারদর্শিতা যদি দেখানো না যায়, প্রোমোশন যদি আটকে যায়, জীবনটাই তো তাহলে ব্যর্থ হয়ে যাবে! এই ধরনের দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ-অনিশ্চয়তা কুরে কুরে খাচ্ছে মানুষকে। অনিশ্চয়তা বাসা বেঁধেছে পারিবারিক সম্পর্কগুলির মধ্যেও। চরম আত্মকেন্দ্রিকতা ভেঙেচুরে দিচ্ছে, বিকৃত করে দিচ্ছে পারস্পরিক সম্পর্কগুলোকেও। এই পরিস্থিতি জন্ম দিচ্ছে হতাশা, অবসাদের।
আরও একটি বিষয় আছে। পরিবারগুলো কিছুদিন আগেও যে নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছোটদের দিত, আজ তা দিতে পারছে না। প্রবল আর্থিক সঙ্কট স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে পরিবারের সকলকে কাজে নামতে বাধ্য করছে। ফলে ছোটদের দেখার সময় আজ অনেকেরই হাতে নেই। আবার দেখা যাচ্ছে পরিবার যত উচ্চবিত্ত, বিচ্ছিন্নতা তত যেন বেশি। কারণ, সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র। দরিদ্র মানুষের কুটিরে আজও যে মানবিকতা, স্নেহ ছোটদের ঘিরে থাকে, উচ্চকোটির সমাজে তা অনুপস্থিত। দরিদ্র ঘরে আত্মহত্যা বাড়ছে দারিদ্রের জ্বালায়। আর উচ্চবিত্ত ঘরে বাড়ছে পাশে কেউ না থাকার যন্ত্রণায়। যত দিন যাবে, এই অসুস্থ পুঁজিবাদী সমাজ মানুষকে আরও একা করে দেবে। বাড়াবে অবসাদ, আত্মহত্যা।