বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে আবারও ব্যাঙ্কসংযুক্তিকরণের রাস্তায় হাঁটতে চাইছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। ১২টি ব্যাঙ্ককে আপাতত ৪টি ব্যাঙ্কে আনার পরিকল্পনা তাদের। দীর্ঘকাল ধরে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি হল, সাধারণ মানুষের শ্রম এবং অর্থের বিনিময়ে রেল, ব্যাঙ্ক, বিদ্যুৎ প্রভৃতির মতো যে সমস্ত লাভজনক সরকারি বা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রয়েছে সেগুলিকে পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া, যাতে তারা তাদের বিপুল সম্পদের পরিমাণকে আরও বিপুলাকার দিতে পারে।
আইডিবিআই ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণ পর্ব শুরু হতে চলেছে। পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক, ইউকো ব্যাঙ্ক বা অন্যান্য ব্যাঙ্কগুলোতেও যখন দেখা যায় খরচ কমাতে সব রকম নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে স্থায়ী কাজে কম পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ‘হায়ার অ্যান্ড ফায়ার’ নীতিকে মান্যতা দিয়ে অস্থায়ী চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ করা হচ্ছে, প্রচলিত নিয়োগ পদ্ধতির বাইরে গিয়ে ‘অ্যাপ্রেন্টিস’-হিসাবে কাজ করতে শিক্ষিত যুব সমাজকে আহ্বান করা হচ্ছে, তখন বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে, অধিক থেকে অধিকতর মুনাফার লক্ষ্যে যারা ব্যাঙ্ক কিনতে চায়, এ হল তাদের প্রলুব্ধ করার পদক্ষেপ, সরকারি কোষাগারকে স্ফীত করার লক্ষ্যে ব্যাঙ্ক শিল্পকে বেসরকারিকরণের অশনি সঙ্কেত।
দেশে ছিল ২৭টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক। ২০১৭ সালে সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে তা দাঁড়াল ১২টি-তে। এর ফলে গত সাত বছরে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের ৩৩২১টি শাখা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। গ্রাহকদের সমস্যা বেড়েছে। প্রায় ৭৪ হাজার কর্মী কমে গিয়েছে। শাখার সংখ্যা এবং কর্মী সংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে নিম্নগামী হচ্ছে গ্রাহক পরিষেবার মান। যদিও পরিষেবা শুল্কের ক্ষেত্র এবং পরিমাণ– দুটোই বেড়ে চলেছে। ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া বা ইউবিআই, এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের মতো অনেকগুলি ব্যাঙ্কের ওই নামে আর কোনও অস্তিত্ব নেই। সংবাদ সূত্র অনুযায়ী এ বারের পরিকল্পনা সরকারি ব্যাঙ্ক ১২ থেকে ৪-এ নামিয়ে আনা। নতুন করে এই সংযুক্তিকরণ আরও বেশি বেসরকারিকরণের লক্ষ্যেই।
প্রত্যেকটি সরকারি তথা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক শক্তপোক্ত। বেসরকারি ব্যাঙ্ক ভেঙে পড়লে তাকে বাঁচাচ্ছে, তার গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষা করছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি। এক সময় যখন সব ব্যাঙ্কই বেসরকারি ছিল, তখন ব্যাঙ্ক কর্মচারী এবং গ্রাহকদের স্বার্থ ব্যাঙ্কে লালবাতি জ্বলার কারণে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৯১৩ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের আগে এ দেশে ২১৩২টি বেসরকারি ব্যাঙ্কে লালবাতি জ্বলেছিল। সর্বস্বান্ত হয়েছিল ব্যাঙ্কের আমানতকারীরা। ব্যাঙ্ক কর্মচারীরা খুইয়েছিল তাদের চাকরি। এখন আবার সেই পথ ধরে চলার পরিকল্পনা চলছে।
ব্যাঙ্কগুলিকে জুড়ে দিয়ে বড় ব্যাঙ্কে পরিণত করার আসল কারণ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কথায় প্রকাশ পেয়েছে। সংযুক্তিকরণের সুবিধা হিসাবে সেখানে বলা হচ্ছে, ব্যাঙ্কের বিপুল পরিমাণ অনাদায়ী ঋণ যা অনুৎপাদক সম্পদ বা এনপিএ-তে পরিণত হয়ে সঙ্কট সৃষ্টি করছে তার নিরসন হবে। তা ছাড়া জমা টাকা বা আমানতের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে যা বড় ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা গড়ে তুলবে। বড় ভারতীয় ব্যাঙ্ক থেকে আন্তর্জাতিক ব্যবসার ক্ষেত্রে ভারতীয় কোম্পানিগুলি গ্যারান্টি বা লেটার অফ ক্রেডিট বেশি পাবে। সকলেই জানেন পুঁজিপতিরা ব্যাঙ্ক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে শোধ করে না বলেই এনপিএ সঙ্কটের সৃষ্টি। আসল কথা কি তা হলে, ব্যাঙ্ক বড় না হলে বিজয় মালিয়া, নীরব মোদি, মেহুল চোক্সির মতো লুঠেরারা বেশি বেশি করে লুঠ করতে পারবেন না? বড় বড় ব্যবসায়ীদের মোটা অঙ্কের ঋণের টাকা সহজে মকুব করা যাবে না? সেই জন্যই কি ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণ?
বেসরকারিকরণ হলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির ৩১ শতাংশ গ্রামীণ শাখার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে পড়বে। অন্যান্য সমস্যাও বহু গুণ বৃদ্ধি পাবে। গরিব এবং গ্রামীণ গ্রাহকদের বিরাট একটা অংশ ব্যাঙ্ক পরিষেবার বাইরে চলে যাবে। প্রান্তিক চাষি, ছোট দোকানদার, আর্থিক দিক থেকে সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির একটা বিরাট অংশও ব্যাঙ্ক-ঋণের অভাবে গ্রামীণ বিত্তশালীদের থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে সর্বস্বান্ত হবে।
দেশে মোট ব্যাঙ্ক আমানতের ৭০ শতাংশ রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে। বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে মোট জমা টাকার পরিমাণ ১০০ লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি। সরকারের সহায়তায় এই বিশাল পরিমাণ টাকার নিয়ন্ত্রক হতে চাইছে এ দেশের ধনকুবের গোষ্ঠী। এই টাকার উপর ভিত্তি করে ঋণ দেওয়া হয়। ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণ ক্রমবর্ধমান। এই ঋণ না আদায়ের ফলে এগুলি ব্যাঙ্কের অনুৎপাদক সম্পদ বা এনপিএ-তে পরিণত হচ্ছে। অনাদায়ী এই সম্পদ ব্যাঙ্ক ব্যবস্থাকে দিনে দিনে দুর্বল করে দিচ্ছে। সরকার বহু ক্ষেত্রে বড় বড় কর্পোরেট ঋণ মকুব করে দিচ্ছে বা অনুৎপাদক সম্পদের বোঝা কমাতে ‘ব্যাড ব্যাঙ্ক’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ঘুরপথে জনগণের করের টাকায় সৃষ্ট সরকারি তহবিল থেকে ব্যাঙ্কগুলিকে অর্থ জোগান দিচ্ছে। ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের মধ্য দিয়ে জনগণের অর্থকে আরও যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে যাবে একচেটিয়া পুঁজির মালিকানাধীন কর্পোরেট সংস্থাগুলি।
কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের এই প্রচেষ্টা সফল হলে তা শুধু ব্যাঙ্ক কর্মীদের উপর আঘাত হানবে না, আঘাত হানবে ব্যাঙ্ক গ্রাহক সহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের উপর। দেশের আর্থিক দুরবস্থা আরও ত্বরান্বিত হবে। আর্থিক বৈষম্য সমাজের বুকে আরও ভয়াবহ রূপ নেবে।
- সংযুক্তিকরণের ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সংখ্যা ২৭ থেকে কমে ১২টি হয়েছে
- ব্যাঙ্কের ৩৩২১টি শাখাবন্ধ হয়েছে
- কমে গেছে ৭৪ হাজার কর্মী
- মহাজনী ঋণের খপ্পরে পড়তে চলেছে সাধারণ মানুষ