শহিদ-ঈ-আজম ভগৎ সিংয়ের নব্বইতম শহিদ দিবস ২৩ মার্চ, ২০২০। নিচের লেখাটি এই মহান বিপ্লবীর জীবনসংগ্রাম ও আত্মদানের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসাবে প্রকাশ করা হল।
২৩ মার্চ দিনটি শহিদ-ঈ-আজম ভগৎ সিংয়ের শহিদ দিবস। ভগৎ সিং-দের কথা আজ আর জানানো হয় না নতুন প্রজন্মকে। এঁদের জীবন, আত্মদান, চিন্তাধারার প্রামাণ্য ইতিহাস রচনার কোনও উদ্যোগ নেই সরকারি তরফে। দেশের তরুণশক্তিকে জানানো হয় না শহিদ ভগৎ সিং কমিউনিজমের আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ফাঁসি দেওয়ার জন্য যখন জেলের সেপাই সেল থেকে তাঁকে নিয়ে যেতে আসে, তখন তিনি নিবিষ্টচিত্তে লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ বইটি পড়ছিলেন। তিনি সেপাইটিকে বলেছিলেন – ‘‘দাঁড়ান, একজন বিপ্লবীর সঙ্গে আর একজন বিপ্লবীর সাক্ষাৎকার চলছে।”
নিপীড়িত মানুষের পরাধীনতা, দুঃখ-যন্ত্রণা ভগৎ সিংকে অল্প বয়সেই ঘরছাড়া করেছিল। ডিগ্রি, চাকরির মোহ, সুখী গৃহীজীবন কোনও কিছুই তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। মাত্র ২৩ বছর বয়সে ভগৎ সিং-এর ফাঁসি হয়। এই অল্প সময়ের মধ্যে সাংগঠনিক কাজের সঙ্গে সঙ্গে ভগৎ সিং গভীর অধ্যয়ন করেছেন। যুগ যুগ ধরে একশ্রেণির মুষ্টিমেয় লোক তাদের শাসন-শোষণের স্বার্থে সমাজের বেশিরভাগ মানুষের উপর যে অত্যাচারের বুলডোজার চালিয়ে যাচ্ছে – তার হাত থেকে অত্যাচারিত শোষিত মানুষের মুক্তির সঠিক রাস্তা কোনটি, কীভাবে সাধারণ মানুষের মুক্তি আসবে– স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশাপাশি নিরন্তর এই চিন্তাই ভগৎ সিংকে সত্যানুসন্ধানী করে তুলেছিল। তাঁকে পড়তে হয়েছে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন। পড়তে হয়েছে বিভিন্ন দেশের বিপ্লবের ইতিহাস। তদানীন্তন সময়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে আপসহীন ধারার বিপ্লবীদের মধ্যে এতখানি অগ্রসর চিন্তা নিয়ে আমরা আর কোনও বিপ্লবীকে পাই না। রাজনীতিতে উন্নত নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও উচ্চ হৃদয়বৃত্তির দৃষ্টান্ত আমরা পাই ভগৎ সিং-এর জীবনের নানা ঘটনায়। নিজের ফাঁসির আদেশ শোনার পর ভগৎ সিং বটুকেশ্বর দত্তকে একটি চিঠিতে লেখেন, ‘‘আমার দণ্ড হয়েছে ফাঁসি, কিন্তু তোমার জন্য আজীবন কারাদণ্ডের আদেশ হয়েছে। তুমি বেঁচে থাকবে, বেঁচে থেকে দুনিয়াকে দেখিয়ে দেবে আদর্শের জন্য বিপ্লবীরা শুধু মরতেই পারে তা নয়, বেঁচে থেকে সমস্ত দুঃখ-যন্ত্রণার মোকাবিলাও করতে জানে। মরণ, পার্থিব যন্ত্রণা থেকে বেঁচে যাওয়ার উপায় না হওয়াই উচিত। কিন্তু যে বিপ্লবী ঘটনাচক্রে ফাঁসির দড়ি থেকে রক্ষা পেল, দুনিয়াকে তার দেখিয়ে দেওয়া উচিত, সে কেবল ফাঁসিকাঠে চড়তেই জানে না, কারাগারের ক্ষুদ্র অন্ধকার কক্ষে দিনের পর দিন চরম অত্যাচারকেও সহ্য করতে সে জানে।” ভগৎ সিং-এর এই চিঠির মধ্যে আদর্শের প্রতি গভীর উপলব্ধির প্রকাশ দেখা যায়।
তরুণদের উদ্দেশে একটি ভাষণে তিনি বলেন, ‘‘আমরা চাই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, এরই অবিচ্ছেদ্য প্রাথমিক কাজ হল রাজনৈতিক বিপ্লব সফল করা। তাই-ই আমরা করতে চাই। রাজনৈতিক বিপ্লব মানে শুধুমাত্র ব্রিটিশের হাত থেকে ভারতীয়দের হাতে রাষ্ট্র হস্তান্তর করা বোঝায় না। আমাদের সুনির্দিষ্ট বিপ্লবী লক্ষ্য আছে, জনগণের সমর্থনের ভিত্তিতে বিপ্লবী দলের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা আমরা চাই। তারপর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে গোটা সমাজকে পুনর্গঠিত করার পথে সংগঠিতভাবে আমাদের এগোতে হবে। বিপ্লবের এই সঠিক ধারণা যদি আপনার না থাকে তবে দয়া করে থামুন, ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান তুলবেন না। বিপ্লব শব্দটির তাৎপর্য অন্তত আমাদের কাছে সুমহান। এ শব্দটিকে যেমন তেমন করে ব্যবহার করতে বা অপব্যবহার করতে আমরা দিতে পারি না।” এক জায়গায় তিনি বলেছেন, ‘‘রাষ্ট্র এবং সরকারি প্রশাসন শাসক শ্রেণির একটা হাতিয়ার – যা দিয়ে সে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করে, নিজের স্বার্থকে রক্ষা করে। আমরা এই ক্ষমতা ছিনিয়ে এনে সেই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে মার্কসবাদের চিন্তা অনুযায়ী নতুন সমাজ গড়ে তুলতে চাই। এ কারণেই সরকারি ক্ষমতা হাতে পাওয়ার জন্য আমরা লড়ছি। সংগ্রামের মধ্য দিয়েই জনগণকে সচেতন ও প্রস্তুত করে গড়ে তোলা যায়। বিপ্লবের জন্য জনগণকে প্রস্তুত করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এজন্য বিপ্লবী কর্মীদের অপরিসীম আত্মত্যাগ প্রয়োজন। আমি খুব স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আপনি যদি ব্যবসায়ী হন কিংবা সামাজিক প্রতিষ্ঠা এবং পারিবারিক পিছুটান যদি আপনার থাকে তবে এ পথ আপনার জন্য নয়। বিপ্লবী দলের নেতা হওয়ার যোগ্যতা আপনার নেই। সান্ধ্য অবকাশে কিছু ভাষণ দেবার মতো নেতা আমাদের অনেক আছে, এসব নেতাদের কোনও মূল্যই নেই। লেনিন যাকে বলছেন জাতবিপ্লবী, তেমন ধরনের নেতা আমাদের চাই। আমাদের চাই এমন সব সর্বক্ষণের বিপ্লবী কর্মী, বিপ্লব ছাড়া আর কোনও আকাঙক্ষা, বিপ্লবের জন্য কাজ ছাড়া আর কোনও কাজ যাদের নেই। সুপরিকল্পিত অগ্রগতির জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হল জাত বিপ্লবীদের নিয়ে গঠিত একটি দল– আদর্শ সম্পর্কে যাঁদের ধারণা সুস্পষ্ট, যাঁদের পর্যবেক্ষণ নিখুঁত, উদ্যোগ গ্রহণ করার এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা যাঁদের আছে।”
বিপ্লবী জীবন সম্পর্কে ভগৎ সিং বলছেন, ‘‘শুধু আবেগ কিংবা আত্মদান নয়, এর জন্য প্রয়োজন সহিষ্ণুতা এবং আত্মত্যাগে উজ্জ্বল দীর্ঘ সংগ্রামী জীবন। নিজের ব্যক্তিগত আরাম আয়াসের জীবনকে ঝেড়ে ফেলুন। তারপর বিপ্লবী কাজ করুন। তিলে তিলে আপনাকে এগোতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন অদম্য সাহস, অধ্যবসায় এবং কঠোর সঙ্কল্প। কোনও বাধা, কোনও প্রতিবন্ধকতা যেন আপনাদের নিরুৎসাহিত করতে না পারে, কোনও ব্যর্থতা, কোনও বিশ্বাসঘাতকতা যেন আপনাদের হতোদ্যম করতে না পারে। অসীম সহিষুiরতা ও আত্মত্যাগের অগ্নিপরীক্ষার পর আসবে অনিবার্য বিজয়।”
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে ধর্মীয় বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে যে দেশাত্মবোধ ও বিপ্লবী আন্দোলনের প্রবাহ বইছিল, ভগৎ সিং সেই প্রবাহের ধারাবাহিকতার মধ্যে থেকেও একটা ছেদ রচনা করেন। ধর্ম সম্পর্কিত ভগৎ সিং-এর বক্তব্য আজকের দিনে খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি বলছেন, ‘‘ধর্ম আমাদের অগ্রগতির পথে দুর্লঙ্ঘ্য বাধা। যেমন ধরুন আমরা চাই সমস্ত মানুষ সমান হোক, মানুষে মানুষে উঁচু-নিচু বা অস্পৃশ্যতার ভেদাভেদ যেন না থাকে। কিন্তু সনাতন ধর্ম তো এই ভেদাভেদের পক্ষে। এই বিংশ শতাব্দীতে পণ্ডিত মৌলবীরা আজও মেথরের ছেলের কাছ থেকে গলায় মালা নেন তারপর কাপড়-চোপড় সহ স্নান করে শুদ্ধ হন। অচ্ছুৎদের তাঁরা পৈতা পরার অধিকার দেন না। এমন যে ধর্ম তার বিরুদ্ধে কিছু না বলে নীরবতাই যদি শ্রেয় মনে করি, তবে তো সব কিছুতে জলাঞ্জলি দিয়ে মরে বসে থাকতে হয়। চোখের উপর আমরা দেখছি ধর্ম আমাদের সামনে পর্বত প্রমাণ বাধা স্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একের ধর্ম বলছে গরু কাটা চলবে, অন্যের ধর্মে লেখা আছে গরুকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করতে হবে। তাহলে এখন কী হবে? যদি অশ্বত্থ গাছের ডাল ভাঙলেই ধর্ম ভেঙে পড়ে তাহলে কী-ই বা করা যায়। এইসব ধর্মীয় দর্শন, সংস্কার ও ধর্মীয় আচার-আচরণকে কেন্দ্র করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভেদ শেষপর্যন্ত জাতীয় ধর্ম হয়ে দাঁড়ায় এবং তাকে ভিত্তি করে পৃথক পৃথক সংগঠন গড়ে ওঠে। এর অশুভ পরিণাম যে কী তা আমরা স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি। যতদিন পারস্পরিক বিদ্বেষ মন থেকে মুছে ফেলে আমরা এক না হব, ততদিন বাস্তবে ঐক্য গড়ে উঠতে পারে না। কেবলমাত্র ব্রিটিশ সিংহের থাবা থেকে মুক্তি পাওয়ার নাম স্বাধীনতা নয়। পূর্ণ স্বাধীনতার অর্থ হল সমস্ত মানুষের মিলেমিশে থাকবার ক্ষমতা অর্জন এবং সর্বপ্রকার মানসিক দাসত্ব ও দুর্বলতা থেকে মুক্তি।” ভগৎ সিং যুক্তিকেই বলেছেন জীবনের ধ্রুবতারা। তিনি বলেছেন, ‘‘কেবল বিশ্বাস, বিশেষ করে অন্ধ বিশ্বাস খুবই বিপজ্জনক। ওই প্রবণতা মানুষের চিন্তাশক্তিকেই নষ্ট করে দেয়। মগজকে ভোঁতা করে দেয়। মানুষ এরই ফলে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়ে।”
আজ সরকারি রাজনৈতিক দলগুলির নেতাদের নোংরামি, নীতিহীন জীবনযাপন দেখে বিবেকবান মানুষেরা আঁতকে উঠছেন। অনেকে রাজনীতি থেকে মুখ ফেরাচ্ছেন। তাঁদের মনে রাখা দরকার ভগৎ সিংয়ের মতো উন্নত চরিত্রের সৃষ্টি রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য থেকেই হয়েছিল, যে রাজনীতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে। নিপীড়িত মানুষের প্রতি অসীম ভালবাসাই এই রাজনীতির মূল মন্ত্র। তাই, ভগৎ সিং-এর মতো যুবক আজ সমাজে সৃষ্টি করতে চাইলে ভোটসর্বস্ব নোংরা রাজনীতিকে পরাস্ত করে নিপীড়িত মানুষের মুক্তির দিশারি উন্নত রাজনীতির চর্চা করতে হবে। রাজনীতি থেকে মুখ ফেরালে প্রতিক্রিয়াশীল নোংরা রাজনীতির হাতই শক্তিশালী হবে।