সম্প্রতি সিইএসসি-র ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ বর্ষের মাশুল বাড়ানোর প্রস্তাব গ্রাহক সংগঠন অ্যাবেকার প্রবল যুক্তির সামনে দাঁড়িয়ে বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বাতিল করেছে। অ্যাবেকার বক্তব্য মাশুল বাড়ানোর কোনও প্রয়োজনই নেই। বরং তা ৫০ শতাংশ কমনো যেতে পারে। বিদ্যুতের দাম কীভাবে কমানো যেতে পারে সে সম্পর্কে অল বেঙ্গল ইলেকট্রিসিটি কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন (অ্যাবেকা) বারবার তুলে ধরেছে যে, ২০১৬-১৭-তে কয়লার দাম ৪০ শতাংশ কমে যাওয়াতে সিইএসসি-তে এক বছরে ৭৬০.৯৬ কোটি ও পিডিসিএল-এ ২৪০০.৫৪ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। এ ছাড়াও জিএসটি ৭ শতাংশ কমায় এক বছরে সিইএসসি ওই বছরে ১৩৮.১৮ কোটি ও রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম ৩৬০.৯৫ কোটি টাকা কম খরচ করেছে। ২০১৬-১৭ বর্ষে সিইএসসি ও রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানিতে কারিগরি ও বাণিজ্যিক ক্ষতি ২ শতাংশ কম হওয়ার ফলে দুই কোম্পানির সাশ্রয় হয়েছে যথাক্রমে ১৮৬.৭০ কোটি ও ৪২৭.৫৪ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে তৎকালীন পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে লিখিতভাবে এই দুই কোম্পানির মোট ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ করতে হয়নি জানালে উনিও মাশুল কমানো উচিত স্বীকার করেন। বিষয়টি মন্ত্রীসভায় তুলবেন বলেছিলেন।
রাজ্যের বর্তমান বিদ্যুৎমন্ত্রী গত অক্টোবর মাসে ঘোষণা করেছিলেন বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কয়লার ৬০ শতাংশ ক্যাপটিভ কয়লাখনিগুলো থেকেই ৩০ শতাংশ কম দামে পাওয়া যাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীও গত সেপ্টেম্বরে ঘোষণা করেছিলেন ক্যাপটিভ কয়লাখনি থেকে কয়লা পাওয়া গেলে বিদ্যুতের দাম কমবে। (বর্তমান ০২-৯-২০২১) গত ১ জানুয়ারি ডব্লুবিপিডিসিএল-এর চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর ডঃ পি বি সালিম জানিয়েছেন, তাঁদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ প্রতি ইউনিটে ৭০ পয়সা কমাতে সক্ষম হয়েছেন। তা হলে দাম কমানো হবে না কেন?
গত বছর ২৫ আগস্ট রাজ্য বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশন ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০-র জন্য রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানি যে মাশুল নির্ধারণের অর্ডার দেয় তাতে পরিষ্কার বলা হয়েছে, ২০১৬-১৭ বর্ষের বিদ্যুৎ মাশুল হিসাবে যা নেওয়া হয়েছে তা থেকেই পিডিসিএল-এর পাওনা টাকা এবং কোম্পানির পরবর্তী বছরগুলির মোট রাজস্ব আদায় হয়ে যাচ্ছে। এর সাথে ঐ অর্ডারে ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত এমভিসিএ (মান্থলি ভ্যারিয়েবল কস্ট অ্যাডজাস্টমেন্ট) খাতে কোনও টাকা আদায় করা যাবে না। তা হলে দেখা যাচ্ছে, ২০১৬-১৭ বর্ষে অস্বাভাবিক হারে মাশুল বাড়ানো হয়েছিল, যা তখনকার সময়ে কোম্পানির প্রয়োজনেরও বেশি। আবার নেওয়া যাবে না বলা হলেও এমভিসিএ খাতে এপ্রিল ২০১৯ থেকে আগস্ট ২০২১ পর্যন্ত কোটি কোটি টাকা গ্রাহকদের থেকে কোম্পানি তুলে নিয়েছে। সুতরাং মাশুলের বাড়তি টাকা এবং এমভিসিএ খাতের অন্যায়ভাবে কেটে নেওয়া টাকা গ্রাহকদের ফেরত দেওয়া উচিত এবং বিদ্যুতের মাশুল মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি মতো এবং ন্যায্যত কমানো উচিত।
গ্রাহকদের কাছ থেকে চড়া হারে লেট পেমেন্ট সারচার্জ (এলপিএসসি) আদায় করে বিদ্যুৎ কোম্পানি। বিদ্যুৎমন্ত্রী এবং কমিশনের চেয়ারম্যান মেনে নিয়েছিলেন যে এই চার্জ ব্যাঙ্ক রেটের বেশি হওয়া উচিত নয়। কিন্তু আজও পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। দেশের মধ্যে পাঁচটি কৃষিপ্রধান রাজ্য কৃষিতে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দিলেও অন্যতম কৃষিপ্রধান এই রাজ্যে কৃষিতে বিদ্যুতের মাশুল দেশের মধ্যে সর্বাধিক। গত লকডাউনের সময় ক্ষুদ্র শিল্প পুরোপুরি বন্ধ থাকলেও তাদের ঘাড়ে বিশাল অঙ্কের ফি’ড চার্জের বোঝা চাপানো হয়েছে। এর ফলে রাজ্যে হাজার হাজার ক্ষুদ্র শিল্প বন্ধ হয়ে চলেছে। লাইফ-লাইন গৃহস্থ বিদ্যুৎ গ্রাহকদের মাসে মাত্র ২৫ ইউনিট বিনামূল্যে দেওয়ার সিদ্ধান্ত যাতে কার্যকর না করতে হয় তার জন্য নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে আবেদনপত্রে রাজ্যের প্রায় কোনও গ্রাহক পরিষেবা কেন্দ্রেই ৩০০ ওয়াটের কমে লোড লিখতে দেওয়া হচ্ছে না এবং কেউ লিখলে তার আবেদন ফর্ম গ্রহণ করা হচ্ছে না। বন্ধ, খারাপ হয়ে যাওয়া লক্ষ লক্ষ মিটার সময়মতো পরিবর্তন করা হচ্ছে না এবং খারাপ থাকাকালীন ইচ্ছামতো বাড়তি টাকার বিল পাঠিয়ে দেওয়া চলছেই। এর বিরুদ্ধে গ্রাহকদের অভিযোগপত্র পর্যন্ত গ্রাহক পরিষেবা কেন্দ্রের স্টেশন ম্যানেজার গ্রহণ করতে রাজি নয় যা নিয়ে প্রায়শই গ্রাহকদের পোস্ট অফিসের মাধ্যমে অভিযোগ জানাতে বাধ্য করা হচ্ছে।
জনবিরোধী বিদ্যুৎ আইন-২০০৩ ও সংশোধনী বিল-২০২১ আইনে পরিণত হবার আগেই রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানি তাদের সমস্ত স্তরের অফিসের কাজ, মেরামতি, মিটার রিডিং, বিল তৈরি, বিতরণ, নতুন কানেকশন সহ সমস্ত কিছু কনট্রাক্টরের মাধ্যমে করছে। এর ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের বিদ্যুৎ শিল্পে বেসরকারিকরণের উদ্দেশ্যকেই বাস্তবায়িত করা হচ্ছে। বাড়ছে চুরি-দুর্নীতি, যার দায়ভার আবার গ্রাহকদের উপর বর্তাচ্ছে। সম্প্রতি প্রি-পেইড মিটার লাগানোর সিদ্ধান্ত এবং সৌর-বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহারে বাধা নিষেধ আরোপের রেগুলেশন কার্যকরী করার মাধ্যমেও জনবিরোধী বিদ্যুৎ বিল-২০২১ এর প্রয়োগ করার চেষ্টা চলছে।
একদিকে পর পর দুই বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষকের ব্যাপক ফসলের ক্ষতি হয়েছে তার উপর এই বোরো চাষের সময় লাতারে বকেয়া টাকা আদায় করতে লাইন কাটা হয়ে চলেছে। এর ফলে এবার প্রায় ২০ শতাংশ বোরো চাষ কমেছে, যার ফলে রাজ্যে চালের দাম বাড়ছে।
এ সমস্ত ঘটনা প্রমাণ করছে দীর্ঘ প্রায় ৪“৫ বছর ধরে সরকারি এবং বেসরকারি উভয় কোম্পানি গ্রাহকদের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বাড়তি আদায় করেছে। এর সাথে সিইএসসি-তে নতুন কানেকশন নিতে বা মিটার সিফটিং এ অস্বাভাবিক সার্ভিস চার্জ নেওয়া হয়, যা রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানির ক্ষেত্রে নেওয়া হয় লোডভিত্তিক। দাবি উঠছে সিইএসসি-তেও লোডভিত্তিক সার্ভিস কানেকশন চার্জ নিতে হবে। এই পরিস্থিতিতে অ্যাবেকা কয়েক মাস ধরে সারা রাজ্য ব্যাপী স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান চালাচ্ছে। বিদ্যুতের মাশুল ৫০ শতাংশ কমাতে হবে এই দাবিতে ২ মার্চ বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশন ও এসইডিসিএল-এ বিক্ষোভ দেখাবে অ্যাবেকা। এর সাথে আরও ১৬ দফা দাবি তুলেছে সংগঠন।
গ্রাহকদের দাবি
১. বিদ্যুতের মাশুল ৫০ শতাংশ কমাতে হবে।
২. এলপিএসসি ব্যাঙ্ক রেটে করতে হবে।
৩. ট্যারিফ অর্ডার ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অনুযায়ী ২০১৬-১৭ বর্ষে বাড়তি নেওয়া টাকা গ্রাহকদের ফেরৎ দিতে হবে।
৪. ট্যারিফ অর্ডার ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অনুযায়ী এমভিসিএ বাবদ কেটে নেওয়া (এপ্রিল ২০১৯ থেকে আগস্ট ২০২১ পর্যন্ত) টাকা গ্রাহকদের ফেরৎ দিতে হবে।
৫. চাষের সময় কৃষি বিদ্যুতে লাইন কাটা চলবে না, সমস্ত কাটা লাইন জুড়ে দিতে হবে।
৬. সমস্ত খারাপ ও বন্ধ মিটার পরিবর্তন ও বিল সংশোধন করতে হবে।
৭. সমস্ত অফিসে (বিশেষ করে সিসিসি লেভেলে) গ্রাহকদের অভিযোগপত্র জমা নেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৮. মাতৃভাষাতে সহজবোধ্য করে বিদ্যুৎ বিল করতে হবে।
৯. স্পট বিলিং এর বিল আইন অনুযায়ী এবং প্রিজার্ভ করার যোগ্য করতে হবে।
১০. লকডাউন পিরিয়ডের ক্ষুদ্র শিল্পের ফি’ড চার্জ মকুব করতে হবে।
১১. প্রি-পেইড মিটার গ্রাহকের বিনা অনুমতিতে লাগানো চলবে না।
১২. সৌর-বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহারের উপর কোনও রকম বিধি-নিষেধ আরোপ করা চলবে না।
১৩. জঙ্গলমহল, চা-বাগান ও লাইফ লাইন গ্রাহকদের বকেয়া বিলের টাকা মকুব করে বিল রেগুলারাইজ করতে হবে।
১৪. কৃষি বিদ্যুৎ গ্রাহকদের এককালীন এলপিএসসি মকুব করে বকেয়া এনার্জি চার্জের টাকা পরিশোধের ব্যবস্থা করতে হবে।
১৫. সিইএসসি-তে সার্ভিস কানেকশন চার্জ রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানির সমতূল্য করতে হবে।
১৬. কৃষিতে বিনামূল্যে এবং গৃহস্থে মাসে ১০০ ইউনিট পর্যন্ত বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দিতে হবে।
১৭. জনবিরোধী বিদ্যুৎ আইন ২০০৩ ও সংশোধনী বিল ২০২১ বাতিল করতে হবে।