পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের নিষ্ঠুর আচরণ দেখে করোনা অতিমারির প্রথম দফার লকডাউনের সময়েই সারা দেশের মানুষ শিউরে উঠেছে। সরকারের আচরণের জন্য এই কোটি কোটি মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট দেখে সংবেদনশীল মানুষ কেঁদেছেন, নিদ্রাহীন রাত কাটিয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকার কিংবা রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি সরকারের কর্তাদের তাতে কিছুই যে এসে যায়নি তা তাদের আচরণেই স্পষ্ট। অতিমারির দ্বিতীয় অভিঘাতের সময়তেও একই ভাবে তারা নির্বিকার। সারা দেশে মানুষ দাবি জানিয়েছে অবিলম্বে পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে সরকার দাঁড়াক, তাদের বেতন, খাদ্য, পরিবারের নিরাপত্তা সরকার নিশ্চিত করুক। কিন্তু কোনও ফল হয়নি। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মীরা অবশেষে দ্বারস্থ হয়েছিলেন শীর্ষ আদালতের এবং আদালতের পক্ষেও এই ন্যায্য দাবিকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ২৯ জুন, আদালত পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য কমিউনিটি কিচেন এবং রেশনের বন্দোবস্ত করে তাদের খাদ্যের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বলেছে। সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে নির্দেশ দিয়েছে আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে তাদের এই অবশ্যপালনীয় কর্তব্য সম্পন্ন করতে হবে, যাতে একজন পরিযায়ী শ্রমিককেও এই অতিমারির সময়ে ক্ষুধার্ত না থাকতে হয়। একটা সভ্য দেশের সরকারের এমনিতেই যে কাজটা করার কথা ছিল, সেটুকু করাবার জন্যও শীর্ষ আদালতকে নির্দেশ দিতে হচ্ছে! অথচ এই করোনা মহামারীর মধ্যেও একচেটিয়া মালিক ধনকুবরদের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা মুনাফা পাইয়ে দিতে তো কোনও নির্দেশের অপেক্ষা কেন্দ্রীয় সরকারকে করতে হয়নি! এর পরও কি দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যায় না যে, সরকারটা আসলে কাদের?
এই নির্দেশেও কতটা কাজ হবে সে প্রশ্ন থাকছেই। কিন্তু রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা অন্তত গরিব মানুষের জন্য একটু হলেও মাথা ঘামাতে বাধ্য হবেন এ আশা অনেকে করছেন। যদিও, দেখা যাচ্ছে সরকারের ইচ্ছা মেনেই আদালতও বলেছে একমাস আগে অনলাইন অ্যাপ মাধ্যমে অভুক্ত মানুষটিকে জানিয়ে দিতে হবে তিনি কোথা থেকে রেশন তুলবেন! তার মানে, রেশন পেতে গেলে হাতে একটি স্মার্ট ফোন অতি-আবশ্যক! সরকার বেতন নিশ্চিত করল না, আশ্রয়ের ব্যস্থা করল না, পরিবার প্রতিপালনের উপায় কী হবে বলল না, চিকিৎসার দায়িত্ব নিল না। কিন্তু রেশনে একমুঠো চাল-গম পেতে আগে স্মার্ট ফোন কেনা জরুরি করে দিল! এই পরিযায়ী শ্রমিকরা কোথায় থাকেন, সে তথ্য জোগাড় কি সরকারের পক্ষে অসম্ভব ছিল, যে এর দায় শ্রমিকদের ঘাড়েই চাপাতে হল? অথচ ভোটের সময় এই শ্রমিকদেরই ভোট নিতে একেবারে তাদের বাড়িতে পর্যন্ত সরকারি অফিসার থেকে নেতা-মন্ত্রীদের পর্যন্ত লাইন লেগে যায়! সত্য সেলুকাস…!
ভারতে পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা প্রায় ৩৮ কোটি, যা দেশের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশের বেশি। অথচ অশিক্ষা ও দারিদ্রের কারণে তাঁরা সমস্ত রকম সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাঁদের কোনও পরিচয়পত্রও নেই। বিশেষত করোনা পরিস্থিতিতে কাজ চলে যাওয়ায় এরা দৈনন্দিন জীবনের মৌলিক চাহিদাটুকুও মেটাতে পারছে না। অথচ দেশের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক বিকাশে এদের অবদান অনস্বীকার্য। সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণেও এই চিত্র ধরা পড়েছে। আদালত সরকারকে মনে করিয়ে দিয়েছে খাদ্যের অধিকার জীবনধারনের মৌলিক প্রয়োজনগুলির অন্যতম এবং মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকার অধিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাজ হারানো মানুষগুলির কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে কেন্দ্রীয় সরকার গত বছরেই ১০০ দিনের কাজের অর্থবরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। অথচ এই সরকারই কর্পোরেটদের জন্য ২৭ হাজার কোটি টাকা ইনসেনটিভের ব্যবস্থা করেছিল। দেশে-বিদেশে বিপুল সমালোচনার মুখে সরকার সেদিন বলেছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের এত বিপুল সংখ্যা নাকি সরকারের জানা ছিল না। সেদিন তারা ঘোষণা করেছিল দেশের পরিযায়ী ও অসংগঠিত শ্রমিকদের সঠিক তথ্য নথিভুক্ত করা হবে। এ জন্য ‘ন্যাশনাল ডাটাবেস ফর আনঅর্গানাইজড ওয়ার্কারস'(এনডিইউডব্লুই) নামে একটি পোর্টাল তারা প্রস্তুত করবেন। তার জন্য বরাদ্দও করা হয়েছিল ৪৫.৩৯কোটি টাকা। কিন্তু এক বছরের মধ্যেও কেন্দ্রীয় শ্রমদপ্তর সেই কাজ শেষ করেনি। ফলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে যখন সরকার আবারও লকডাউন ঘোষণা করল, তখনও এই মানুষগুলিকে সুরক্ষা দেওয়ার কোনও পরিকল্পনা সরকার করতে পারল না। সরকারের এই নির্লিপ্ত মনোভাবকে শীর্ষ আদালত ‘ক্ষমার অযোগ্য’ বলে অভিযুক্ত করেছে। সত্যিই আজ দেশের মানুষের মনের কথাও এটাই– এ সরকারের অচরণ ক্ষমার অযোগ্য। কিন্তু কর্পোরেট সেবায় মগ্ন, ক্ষমতা ধরে রাখার নিকৃষ্ট রাজনীতির কূটকৌশলে মরিয়া বিজেপি নেতাদের কাছে আর্ত মানুষের এই কান্নার কোনও দাম নেই। আজ আদালতের যতটুকু ইতিবাচক রায় মানুষ পাচ্ছে তার পিছনে আছে বহু মানুষের আত্মদান। শত রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের মধ্যেও এনআরসি বিরোধী আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন যেভাবে মাথা তুলেছে, রাজ্যে রাজ্যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের যতটুকু পরিসর তৈরি হচ্ছে তার জমির উপর দাঁড়িয়েই সাধারণ মানুষের কথা বুর্জোয়া রাষ্ট্রের আদালতে কিছুটা হলেও স্বীকৃতি আদায় করতে পারছে। এই পরিসরটুকু ধরে রাখতে গেলেও চাই লাগাতার গণআন্দোলনের জোয়ার– সে কথা ভুলে গেলে চলবে না।