বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশে নারী নিরাপত্তা বিপন্ন

 

উত্তরপ্রদেশে নারীরা কত নিরাপদ সে সম্পর্কে বিজেপি নেতাদের বক্তব্যই প্রথমে শোনা যাক। ২০২২ সালে এই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের এক সমাবেশে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, রাত বারোটার সময় ষোলো বছরের কোনও তরুণী গয়না পরে নির্ভয়ে ঘোরাঘুরি করতে পারে। আইনশৃঙ্খলার এই উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে ২০১৭ সালে রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর।

রাজ্যের বাহরাইচে ২০২২ সালেই আরেকটি নির্বাচনী সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এমনভাবে প্রশাসন পরিচালনা করছেন যে, রাজ্যে টেলিস্কোপ দিয়েও কোনও বাহুবলী খুঁজে পাওয়া যাবে না, সর্বত্র দেখা যাবে কেবল বজরঙবলী।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ঢাক পিটিয়ে যে কথাগুলি বলেছেন, তার সাথে বাস্তবের মিল কতটুকু? দেখা যাক ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য কী বলছে। ২০২২ সালে নারীদের উপর সংঘটিত ক্রাইম রেকর্ডে উত্তরপ্রদেশ এক নম্বরে। অপহরণ, ধর্ষণ, ধর্ষণ করে খুন, গণধর্ষণ– এইসব অপরাধে উত্তরপ্রদেশ দেশের মধ্যে শীর্ষস্থানে। ২০২০ সালে এই ধরনের অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছে ৪৯ হাজার ৩৮৫টি, ২০২১ এ সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ালো ৫৬ হাজার ৮৩। ২০২২ এ আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৭৪৩টি।

এ তো গেল কেবল নথিভুক্ত ঘটনার সংখ্যা। এই ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতের কথা ভেবে লজ্জায়, ভয়ে বহু মানুষ থানায় জানান না। আবার থানাও খুব চাপে না পড়লে সাধারণত নথিভুক্ত করতে চায় না। ফলে মহিলাদের উপর এই ধরনের অপরাধের সংখ্যা বাস্তবে অনেক বেশি। তা হলে কার কথা সত্য? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর, নাকি তাঁর সরকারের রেকর্ডরক্ষাকারী সংস্থার? দেখা যাক নাগরিক সমাজ কী বলছে। লখনৌ ইউনিভার্সিটির কার্যকরী উপাচার্য রূপরেখা ভার্মা ফ্রন্টলাইন পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বিজেপি নেতারা দাবি করছেন রাজ্যে ক্রিমিনালরা সব ইঁদুরের গর্তে ঢুকে গেছে। কিন্তু বাস্তবটা তা নয়। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর যে পরিবর্তনটা হয়েছে তা হল নারীদের উপর সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে সরকার ও পুলিশের বিরুদ্ধে মুখ খোলা যাবে না, আন্দোলন করা যাবে না। তিনি বলেন গত ২৫-৩০ বছরে উত্তরপ্রদেশে মহিলারা পর্দার আড়াল থেকে কিছুটা বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যে সমস্যাটা তৈরি হয়েছে তা হল মহিলাদের উপর যৌন অপরাধ বেড়েই চলেছে। খুন করা হচ্ছে নিষ্ঠুরভাবে, যা অতীতে এতটা ঘটত না।

বিজেপি-শাসিত এই রাজ্যে পুলিশের ভূমিকা কী? পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিস (পিইউসিএল) উত্তরপ্রদেশের এক্সিকিউটিভ সদস্য বিকাশ শাক্য ফ্রন্টলাইনকে জানান, অপহরণ, ধর্ষণ, গণধর্ষণ এই ধরনের ঘটনায় তদন্তের সময় নানা ভাবে চেষ্টা হয় নির্যাতিতাকে ভীত সন্ত্রস্ত করে দেওয়ার। সরকারি উকিল এবং পুলিশ নানা ভাবে চেষ্টা চালায় অপরাধীকে বাঁচানোর। এমনকি বিচারের পরও নির্যাতিতাকে হুমকি দেওয়া হয়।

২০১৭ তে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে বিজেপির যোগী আদিত্যনাথ নারীদের উপর অত্যাচার খর্ব করার ঘোষণা দিয়ে অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড গঠন করেছিলেন। বাস্তবে এই রোমিওদের বেশিরভাগই শাসকদলের অনুগত। ফলে বিচার করবে কে? উত্তরপ্রদেশের শোনভদ্রে এমএলএ-এমপিদের অপরাধ বিচার করার একটি স্পেশাল কোর্ট আছে। এখানে ১,১৪১টি মামলা ঝুলছে, যা দেশের মধ্যে সর্বাধিক। মামলার বিচারে কোর্টের বিশেষ তৎপরতা নেই। এলাহাবাদ কোর্টের হস্তক্ষেপে কিছুদিন আগে এই কোর্ট একটু নড়েচড়ে বসে এবং ২০২৩ এর ডিসেম্বরে একটা রায় দেয়, যা বিজেপি সরকারকে চরম অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। রায়ে দেখা গেল, দুধির বিজেপি বিধায়ক রামদুলার গোন্ড ১৫ বছরের এক মেয়েকে ধর্ষণ ও গর্ভবতী করার অপরাধে ২৫ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। বিধানসভা থেকে তাঁর সদস্যপদ খারিজ হয়। কিন্তু বিজেপি তাঁর সদস্যপদ খারিজ করার পথে হাঁটেনি।

বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির আইআইটিতে কুড়ি বছরের এক ছাত্রী গণধর্ষণের শিকার হন। নির্যাতিতা পাঁচজনের নামে গণধর্ষণের অভিযোগ আনেন। তারা প্রত্যেকেই বিজেপি-আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত। ফলে পুলিশ অপরাধের মাত্রা কম করে দেখাতে শ্লীলতাহানি হিসেবে অভিযোগ নথিভুক্ত করে। এর বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। অবশেষে পুলিশ গণধর্ষণের ধারা যুক্ত করতে বাধ্য হয়।

২০২৩-এর জুনে উত্তরপ্রদেশের বারাবাঁকি জেলায় ১৭ বছরের এক দলিত কন্যা আত্মহত্যা করে। অভিযোগ জানানোর পর পুলিশ ক্রিমিনালদের ধরার পরিবর্তে আপস-মীমাংসা করে নেওয়ার জন্য ধর্ষিতার পরিবারকে চাপ দেয়। পুলিশের কি এই ভূমিকা পালন করার কথা? এই কি প্রধানমন্ত্রীর ‘বেটি বাঁচাও’ ঘোষণার বাস্তব রূপ?

কী বলছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী? তিনি এই ঘটনার তিন মাসের মাথায় গোরখপুরের এক সভায় বলেন, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় যদি কেউ মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে, তাকে আমরা যমালয়ে পাঠাবো। কেউ আমাদের বাধা দিতে পারবে না। কি সাংঘাতিক হুংকার! কিন্তু জনগণ দেখতে পাচ্ছেন অপরাধীরা যমালয়ের পরিবর্তে শাসকদলের কার্যালয়েই নিরাপদে রয়েছেন।

তা হলে কী দেখা যাচ্ছে? বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশে পুলিশ নিরপেক্ষ ভাবে নয়, শাসকদলের অপরাধীদের বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করে চলেছে। পুলিশ সব রাজ্যেই এ ভাবে শাসকদলের হয়েই কাজ করে। সিপিএম আমলে পশ্চিমবঙ্গে পুলিশ যেভাবে দলদাসের ভূমিকা পালন করেছে, তৃণমূল আমলেও তাই চলছে। পুলিশকে খানিকটা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে বাধ্য করতে হলে প্রয়োজন নাগরিক আন্দোলন, যে কথাটা এস ইউ সি আই(সি) বরাবরই বলে আসছে।

(তথ্যসূত্রঃ ফ্রন্টলাইন, ২৬ জানুয়ারি, ২০২৪)