প্রধানমন্ত্রী ৭ মার্চ বলে গেছেন, চাই ‘আসল পরিবর্তন।’ নির্বাচন এলেই পরিবর্তনের স্লোগান ওঠে। ভোট এলে বিরোধী দলগুলি পরিবর্তনের ডাক দেয়। শাসক দল দেয় স্থিতাবস্থা রক্ষার ডাক– বলে, উন্নয়নকে অব্যাহত রাখতে তাদের প্রার্থীকে ভোট দিন। কখনও বলে, ‘উন্নততর উন্নয়ন’। প্রধানমন্ত্রীর স্লোগানও তাই গতানুগতিক।
কিন্তু মোদিজির পরিবর্তনের মুখ কারা? যাঁদের নামে সারদা-নারদা সহ বহু কেলেঙ্কারির অভিযোগ, যাঁদের বিরুদ্ধে তাঁরা ‘ভাগ মুকুল ভাগ’, ‘ভাগ শুভেন্দু ভাগ’ বত্তৃতা করেছেন তাঁরাই এখন বঙ্গ বিজেপির মুখ তথা তারকা প্রচারক। কোটি কোটি টাকার বস্তা নিয়ে নগ্ন দুর্নীতির পথে তৃণমূল থেকে সিপিএম থেকে কংগ্রেস থেকে নেতা ভাঙিয়ে, কোথাও মন্ত্রীত্বের লোভ, কোথাও সিবিআইয়ের গ্রেপ্তারির ভয় দেখিয়ে বিজেপিতে যোগদানের যে সব মেলা তারা করলেন, তাতে অভিযুক্তরাই তাঁদের নয়নের মণি। নীতি দূরের কথা, মুখগুলোর পরিবর্তনও তো হওয়ার আশা নেই।
তাহলে প্রধানমন্ত্রী এই পরিবর্তন বলতে কী বুঝিয়েছেন? বুঝিয়েছেন নিছক সরকার পাল্টানো, শাসকদল পাল্টানো, মুখ্যমন্ত্রী পাল্টানো। কিন্তু এগুলো তো বাহ্যিক পরিবর্তন, আসল পরিবর্তন হয় কী করে? এই ধরনের পরিবর্তন তো হয়েই চলেছে। এর দ্বারা কি মানুষের জীবনের দুর্দশার কোনও পরিবর্তন হবে? জিনিসপত্রের দাম কমবে? কালোবাজারি, মজুতদারি বন্ধ হবে? বেকার ছেলেমেয়েরা চাকরি পাবে? কৃষকরা ফসলের ন্যায্য দাম পাবে? ব্যয় কমিয়ে সবার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে? সবার জন্য সুলভে উন্নত মানের চিকিৎসা মিলবে? পুলিশ-প্রশাসন নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করবে? ব্যক্তির মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা অক্ষুন্ন থাকবে? মহিলাদের উপর ক্রমাগত বাড়তে থাকা নির্যাতন বন্ধ হবে? প্রধানমন্ত্রী কি আসল পরিবর্তন বলতে এই সব পরিবর্তনের কথা বলেছেন? তা যদি না বলেন, তবে তো তা নিছকই একের পর এক সরকার বদলের আয়োজন! এই পরিবর্তন তো রাজ্যের মানুষ স্বাধীনতার ৭৩ বছর ধরে দেখে আসছে। তাঁরা জানেন, এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাঁদের জীবনের সমস্যাগুলির পরিবর্তনের কোনও সম্পর্ক নেই।
২০১৪-তেও তো প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রে আসল পরিবর্তনের ডাক দিয়ে সরকারে বসেছিলেন, কী পরিবর্তন এনেছেন? কংগ্রেস সরকারের কোন জনবিরোধী নীতিটার পরিবর্তন তাঁরা ঘটিয়েছেন? সব রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তি বেচে দেওয়া, কৃষিজমি একচেটিয়া পুঁজির হাতে তুলে দেওয়া, এনআরসি চালু, শ্রমিক মারা শ্রমনীতি– কংগ্রেসের এই নীতিগুলির কোনওটার পরিবর্তন বিজেপি করেছে? নাকি তাকে আরও আক্রমণাত্মক করে তুলে সাধারণ মানুষের জীবনে বোঝা আরও বাড়িয়েছে? নতুন কৃষিনীতিতে কৃষকদের সর্বনাশের ব্যবস্থা করা হয়েছে, গোটা কৃষিব্যবস্থাটিকে একচেটিয়া ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। শ্রমআইনে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে শ্রমিকদের প্রায় সব ধরনের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়ে মালিকদের হাতে অবাধ শ্রমিক শোষণের অধিকার তুলে দেওয়া হয়েছে। নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষার সামগ্রিক বেসরকারিকরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা সাধারণ মানুষের থেকে শিক্ষার সুযোগকে কেড়ে নেবে। কেন্দ্রের বিজেপি শাসনে মতপ্রকাশের, প্রতিবাদের অধিকার কেড়ে নিয়ে এগুলিকে অপরাধের পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে। ধর্মীয় স্বাধীনতাকেও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বিজেপি শাসনে বেকারি গত ৫০ বছরে সর্বোচ্চ রেকর্ডে পৌঁছেছে। এগুলি কি আসল পরিবর্তন?
বিজেপি যে রাজ্যগুলি শাসন করছে, সেগুলিতে কি আসল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে? দেখা যাচ্ছে সেখানেও কংগ্রেস ভাঙিয়ে আনা নেতারাই বিজেপির সম্পদ। সর্বত্রই তাঁদের শাসনে ধনী-দরিদ্রে বৈষম্য আকাশ ছুঁয়েছে। চুরি-দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতা মাত্রাছাড়া আকার নিয়েছে। মহিলাদের উপর খুন-ধর্ষণ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। গুজরাট মডেল বলতে গুজরাট গণহত্যার কথা যদি ছেড়েও রাখা হয়, কোন মডেল বিজেপি দেখাচ্ছে? বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানের চোখ থেকে হতদরিদ্র বস্তি আড়াল করতে পাঁচিল তোলাটাই মডেল? বেকারি, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্যে গুজরাটের অবস্থান সারা ভারতের গড়ের ওপরে। অন্যদিকে আম্বানি, আদানিদের বিপুল বৈভবও বেড়েছে গুজরটের মাটিতে। এই মডেল দেশের মানুষ চাইতে পারে? ত্রিপুরায় সরকারে বসেই সরকারি চাকরিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। বিজেপি শাসনে অপরাধ এবং নারী নির্যাতনের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে উত্তরপ্রদেশ। পশ্চিমবঙ্গেও কি প্রধানমন্ত্রী এমন পরিবর্তনের কথাই বলতে চেয়েছেন?
একদল মানুষ বুর্জোয়াদের প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে ভাবছেন, সরকার বদলালেই সমস্যার সমাধান হবে। তাঁরা ভেবে দেখুন, এ দেশে বহুবার সরকার বদল হলেও সাধারণ মানুষের জীবনের কেন কোনও পরিবর্তন হয়নি। স্বাধীনতার পর গত ৭৩ বছরে কেন্দ্রে ও রাজ্যে বহুবার সরকার বদল হয়েছে। কেন্দ্রে ১৯৪৭ থেকে ‘৭৭ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের শাসন ছিল। তার পর এসেছে জনতা পার্টির সরকার। জনতার পর আবার কংগ্রেস, পরে কংগ্রেস পাল্টে যুক্তফ্রন্ট সরকার, তাকে পাল্টে বাজপেয়ীর এনডিএ, তারপর মনমোহন সিংহের ইউপিএ, তারপর আবার এনডিএ। এভাবে সরকার বদলের কত পুনরাবৃত্তি ঘটছে, কিন্তু জনজীবন যে তিমিরে সেই তিমিরেই। কারণ সরকার বদলের দ্বারা পুঁজিবাদী শোষণ ব্যবস্থা পাল্টায় না, অর্থাৎ আসল পরিবর্তন হয় না। রাষ্ট্রযন্ত্র একই থাকবে, একই শাসন প্রণালী থাকবে, একই আর্থিক নীতি বহাল থাকবে, পাল্টাবে কেবল তার পরিচালক ম্যানেজাররা! এটা তো আসল পরিবর্তন হতে পারে না। আসল পরিবর্তন কথাটির অর্থ হল মৌলিক পরিবর্তন, আমূল পরিবর্তন, একেবারে গুণগতভাবে পৃথক নতুন ব্যবস্থার প্রবর্তন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে, শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে এর অর্থ বর্তমান শোষণমূলক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা পাল্টে শোষণহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা, আর্থিক ব্যবস্থা প্রবর্তন, যাকে এক কথায় বলা হয় বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন। এটা কোনও পুঁজিবাদে বিশ্বাসী কোনও দল আনতে পারে না। তবুও এই ব্যবস্থার মধ্যে নির্বাচিত একটা সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা যদি সৎ হন, যদি দেশের মানুষের প্রতি তাঁদের দরদবোধ থাকে, তা হলে আপেক্ষিক অর্থে হলেও দুর্নীতি কিছুটা কমাতে পারে, জনস্বার্থে কিছুটা কাজ তারা করতে পারে। কিন্তু ভোটবাজ দলগুলির নেতাদের চরিত্রে এসব গুণের চিহ্নমাত্র আছে কি! একমাত্র একটি বিপ্লবী দলের নেতাদের মধ্যেই মাত্র এই সব গুণের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। তাই এ বারের নির্বাচনে সৎ, সংগ্রামী, ধর্মনিরপেক্ষ এবং যথার্থ আন্দোলনকারী দলের প্রার্থীদের জয়ী করার পাশাপাশি দরকার জনস্বার্থে সরকারকে কাজ করতে বাধ্য করার জন্য শক্তিশালী গণআন্দোলন গড়ে তোলা।