সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশ সরকার জানিয়েছে, ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি)-র পরামর্শ মেনেই দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাস বই থেকে মুঘল অধ্যায় বাদ দেওয়া হয়েছে যা আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে কার্যকর হবে। এনসিইআরটি-র পরামর্শেই দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাস বই থেকে ‘থিমস অব ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি, পার্ট টু’ এ ‘কিংস অ্যান্ড ক্রনিকলঃ মুঘল কোর্ট’ অধ্যায়টি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই নির্দেশ কার্যকর হলে সিবিএসই-র দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রদের আর মুঘল ইতিহাস পড়ার প্রয়োজন থাকবে না। ইতিপূর্বে মুঘল আমলে গড়ে ওঠা বহু ঐতিহাসিক শহর ও স্থানের নাম উত্তরপ্রদেশ সরকার বদলে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারও দিল্লির মুঘল গার্ডেন্সের নাম পরিবর্তন করেছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর নানা বত্তৃতায় বার বার ইতিহাস নতুন করে লেখার কথা বলে আসছেন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে, সম্প্রতি ইউজিসি-র পক্ষে ইতিহাসের যে সিলেবাস প্রকাশ করা হয়েছে তাতে ইতিহাস বিকৃতির ভুরি ভুরি প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। ফলে এনসিইআরটি-র সুপারিশ মেনে এই বদল হয়েছে বলে ছেলেভোলানো হাস্যকর যুক্তির আড়ালে তাদের গভীর পরিকল্পনাটি সহজেই উপলব্ধি করা যায়। আসলে তারা এনসিইআরটিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তাদের সুপরিকল্পিত চক্রান্ত আড়াল করার চেষ্টা করেছে মাত্র।
কিন্তু পাঠ্যপুস্তক থেকে এভাবে মুঘল ইতিহাস বাদ দিলেই কি ইতিহাসের তিনশো বছরের বেশি সময়কে (১৫২৬-১৮৫৭) মুছে দেওয়া সম্ভব? যদি একটি যুগের সবকিছুই কদাকার, অন্ধকারাচ্ছন্ন থেকেও থাকে তা হলেও কি সেই সময়ের ইতিহাসকে মুছে দেওয়া যায়? ইউরোপের ইতিহাসে মধ্যযুগের সময়কে অন্ধকারাচ্ছন্ন বলে ইতিহাসে পড়ানো হলেও সামগ্রিক ইতিহাস চর্চা থেকে ওই সময়কে বাদ দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া মানবসভ্যতার ইতিহাস ভাঙাগড়া, উত্থান-পতন, অন্ধকার থেকে আলোর পথে উত্তরণের ইতিহাস। অন্ধকার আছে বলেই মানুষ বাঁচার জন্য আলোর সন্ধান করে, সভ্যতাকে ক্রমাগত এগিয়ে নিয়ে যায়। তাই ইতিহাসের ধারাবাহিক পর্বগুলিকে জানতে হয়। আমাদের দেশের সমাজ সংস্কৃতির বিবর্তনের ধারা স্রোতের মতো প্রবাহিত। এই ধারায় কখনও ছেদ পড়েনি। প্রাচীন রাজবংশের আমল থেকে শুরু করে সুলতানি যুগের পর মুঘল যুগেও সংস্কৃতির বিবর্তনের ধারা রুদ্ধ হয়ে যায়নি।
প্রশ্ন উঠেছে, মুঘল পর্বকে সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়া হল কেন? কেবল মুসলমান বলেই কি বিষয়টিকে সামনে আনা হচ্ছে? তা হলে শের শাহের পাঁচ বছরের শাসনকে কী ভাবে আনা হবে? যে ঐতিহাসিক গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড তিনি গড়েছিলেন, ঘোড়ার পিঠে করে ডাক-ব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন, তা ছাত্ররা কী ভাবে জানবে?
হেমু বিক্রমাদিত্য, রানা প্রতাপ, দুর্গা দেবী, চাঁদ বিবি, শিবাজি প্রমুখ ইতিহাসের নামী অনামী চরিত্রকে সামনে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাঁদের প্রসঙ্গ আলোচনা করতে হলে মুঘল সম্রাটদের কীর্তিকাহিনীকেও আনতে হবে। একজনকে বাদ দিয়ে আর একজনকে প্রতিষ্ঠা করা কি সম্ভব? শুধু একজনের কথা বলে গেলে সেটা ইতিহাস না হয়ে গল্পই হবে। ইতিহাসকে মুছে দিয়ে সেই মনগড়া গল্প লেখার ও পড়ানোর জন্যই কি এই উদ্যোগ?
কিন্তু এভাবে কি ইতিহাসের একটি অধ্যায়কে মুছে দেওয়া যায়? আজও উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লি, পাঞ্জাব, হরিয়ানা সহ পুরো উত্তর ও পশ্চিম ভারত জুড়ে যে স্থাপত্য-ভাস্কর্যগুলি মুঘল ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে, সেগুলি মোছা যাবে কী ভাবে? যে লালকেল্লায় প্রতি বছর স্বাধীনতার বিজয় কেতন উড়ানো হয় তা কার নামাঙ্কিত হবে? তাজমহল, ইবাদতখানা, জামা মসজিদ– এগুলির কী হবে? এটা কেমন করে ভুলিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে যে, আকবরের হলদিঘাট আক্রমণের সময়ে মুঘল ফৌজের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাজা মান সিংহ? অন্য দিকে রানা প্রতাপের সেনাপতি ছিলেন হাকিমখান সুর। আবার শিবাজি ও ঔরঙ্গজেবের ক্ষেত্রে এক দিকে জয়সিংহ ঔরঙ্গজেবের প্রধান সেনাপতি, অন্য দিকে শিবাজির সেনাপতি ছিলেন মৌলভি হায়দার আলি কোহরি। দক্ষিণ ভারতে মারাঠারা টিপুর রাজ্য আক্রমণ করে হিন্দু মন্দির ধবংস করেছিল, যা মেরামত করতে জগৎগুরু শঙ্করাচার্যকে টিপু সুলতান সাহায্য করেছিলেন। এই তথ্যভিত্তিক বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস এড়িয়ে ছাত্রদের মধ্যে মুসলমান বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে।
একটা সময়ে সাম্রাজ্যবাদী ব্র্রিটিশ ইতিহাসবিদেরা ধর্মবিশ্বাসের প্রশ্নটিকে প্রধান করে তুলে ইতিহাসের যুগবিভাজন করে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ১৮১৮ সালে ব্র্রিটিশ ইতিহাসবিদ জেমস মিল-ই প্রথম ভারতের ইতিহাসকে ‘হিন্দু সভ্যতা’, ‘মুসলমান সভ্যতা’ আখ্যা দেন। উল্লেখ্য যে, তিনি কিন্তু ‘খ্রিস্টান পর্ব’ বলেননি। বলেছিলেন ‘ব্রিটিশ পর্ব’। এভাবে তাঁরা সাম্প্রদায়িক ইতিহাস রচনার কাজ শুরু করেন। ভারতে আসা ব্র্রিটিশ শাসকরা ব্রিটেনের হেইলবেরি কলেজে এ দেশ সম্পর্কে মিলের ইতিহাস পাঠ নিয়েই আসতেন। পরবর্তীকালে ভারতীয় ইতিহাসবিদদের একাংশ ব্র্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের এই ব্যাখ্যা দ্বারা প্রভাবিতও হয়েছিলেন।
উনিশ শতকে ইংরেজ ইতিহাসবিদদের দিয়ে ভারত-ইতিহাস রচনার কাজটি শুরু হয়েছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ধর্মীয় ভাবাবেগ ব্যবহার করেই। এর পিছনে ছিল সাম্রাজ্যবাদীদের গভীর ষড়যন্ত্র। যা পরে তাদের শাসনব্যবস্থার ভিত্তি হয়ে উঠেছিল। আর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে তাত্ত্বিক রূপ দিতে কয়েকজন ইংরেজ ইতিহাসবিদ, প্রত্নতত্ত্ববিদ ও গবেষক মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে চরম নির্যাতন ও মন্দির ধ্বংসের বিরামহীন অভিযোগ এনে তাদের গ্রন্থে চমকপ্রদ বিবরণ দিতে শুরু করেন। এই কাজে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা নিয়েছিলেন তদানীন্তন ভারত সরকারের সচিব এমএইচ এলিয়ট, ১৮৪৯ সালে প্রকাশিত ‘বিবলিওগ্রাফিকাল ইনডে’ টু দ্য হিস্টোরিয়ানস অফ মহামেডান ইন্ডিয়া’গ্রন্থে। এই গ্রন্থে সুলতানি যুগ থেকে শুরু করে মুঘল সাম্রাজ্যের রাজত্বকালে মুসলমান শাসকদের তীব্র ভাবে নিন্দা করে তাদের অমিতাচার ও লাম্পট্যের কাহিনিকে মুখরোচক ভাষায় তুলে ধরা হয়। সঙ্গে এটাও দেখান যে, তারা কী ভাবে হিন্দুদের উপরে অত্যাচার করত। মন্দির ধবংস করা, ধর্মান্তরিতকরণ, হত্যার কাহিনিকে অনৈতিহাসিক ও বিকৃত ভাবে উপস্থাপন করা হয়। এলিয়ট আশা করতেন, হিন্দুরা মুসলিম শাসনের সেই অন্ধকার যুগকে (১২০৬-এর সুলতানি যুগ থেকে ১৭০৭-এর ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু পর্যন্ত) ফিরিয়ে আনার জন্য আর বিলাপ করবে না।
এই ধরনের ব্যাখ্যার আসল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসন ভারতীয়দের কাছে কতটা প্রাসঙ্গিক ও গ্রহণযোগ্য সেটা প্রমাণ করা। যেহেতু এ দেশে মুসলিম শাসকদের অপসারিত করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ক্ষমতা দখল করেছিল, তাই তারা স্বাভাবিক ভাবেই নানা কৌশলে মুসলিম বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। তার উপর ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ ও তাতে বিদ্রোহীদের পক্ষ থেকে মুঘল শাসক বাহাদুর শাহকে দেশের সম্রাট হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা দেখে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ আরও আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। একদিকে দেশের জনসাধারণের উপরে অবর্ণনীয় অত্যাচার ও শোষণের কারণে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজে জন্ম নেওয়া ক্ষোভ প্রশমিত করা, অন্য দিকে দেশের সামন্ততান্ত্রিক জমিদার, নবাব-বাদশাহদের ক্ষমতায় ফিরে আসার আকাঙক্ষা আটকাতে তাদের মুসলিমবিদ্বেষী প্রচার বিশেষ কৌশল হয়ে উঠেছিল। আবার বিশ শতকের প্রথম পর্বে শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের ক্ষোভ অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাতে কোনও ভাবেই মুসলিম জনসাধারণ যাতে অংশ নিতে না পারে তার জন্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি নিয়ে এসেছিল। লর্ড কার্জনের প্রত্যক্ষ মদতে ও আর্থিক সাহায্যে ১৯০৬ সালে ঢাকায় ‘মুসলিম লিগ’ গড়ে উঠল। কার্জন ঢাকা সফরে গিয়ে ঢাকার নবাবকে ব্রিটিশদের ক্ষমতায় আসার পূর্বে তাঁরা যে সম্মান পেতেন তা ফিরিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখালেন। দেশে বিভেদ রাজনীতির বিষবৃক্ষ সার-জল পেয়ে ডালপালা মেলল। সৈয়দ আহমেদ খানের মতো প্রগতিশীল সমাজসংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্বও এর প্রভাবে বিপথে চালিত হলেন। অন্য জাতীয় নেতারাও সাম্রাজ্যবাদী এই কৌশলে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। এই কূট কৌশল নেওয়া হলেও শিক্ষিত মুসলিমদের একাংশ সে দিন বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত আসফাকউল্লাকে বিপ্লবী আন্দোলন থেকে সরানোর জন্য ব্রিটিশ বহু চেষ্টা করেছিল। আসফাকউল্লা বলেছিলেন, তার নেতা রামপ্রসাদ বিসমিল হিন্দুদের জন্য লড়াই করছেন না– হিন্দুস্তানের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছেন, তাই এই সংগ্রামে আমি জীবন দিতে প্রস্তুত। তাঁর চরিত্রের এই মহত্ব সে দিন হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ছাত্র-যুবকদের মধ্যে আলোড়ন ফেলেছিল।
সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের চোখে মধ্যযুগের ভারত ইতিহাস হল হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের এক দীর্ঘ কাহিনি। তারা দেখাতে চায়, হিন্দু ও মুসলমানরা স্থায়ীভাবে স্বতন্ত্র শিবিরে বিভক্ত ছিল, তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল তিক্ত, সন্দি* এবং বৈরিতাপূর্ণ। সচেতন ভাবেই এই ধরনের চিন্তা আজকে ইতিহাসে আনা হচ্ছে। ১৯২৩ সালে সাভারকার ‘হিন্দুত্ব’ গ্রন্থে লিখেছিলেন ‘যে দিন মহম্মদ গজনি সিন্ধুনদ পার হয়েছিলেন, সে দিন জীবন-মরণের সংগ্রাম শুরু হয়েছিল এবং তা শেষ হয়েছিল বলা যায় কি আবদালীর সঙ্গে?’ ওই প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘দিনের পর দিন, দশকের পর দশক, শতাব্দীর পর শতাব্দী, এই বীভৎস সংঘাত চলতে থাকে, এই সংঘাতে গোষ্ঠী, অঞ্চল ও জাত-পাত নির্বিশেষে সমস্ত হিন্দুরা হিন্দু হিসেবে যন্ত্রণা ভোগ করেন। … সমস্ত মুসলিমরা ছিলেন শত্রু এবং শত্রুরা আমাদের হিন্দু হিসেবে ঘৃণা করত’। হিন্দু ধর্মের কথা এনে সরাসরি ধর্মীয় আধিপত্যবাদের বিষয়টিকে সামনে আনা হয়েছে। দেশ কেবল হিন্দু ধর্মের, অন্য কোনও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের চর্চার সংস্কৃতি এখানে কখনও ছিল না, যদিও বা কিছু থেকে থাকে তা তস্করের সংস্কৃতি, অন্য কিছু নয়।
ভারত ইতিহাসের সাম্প্রদায়িক সমস্যাকে মূলত হিন্দু-মুসলমানের সমস্যা হিসেবে দেখানো হয়। অথচ ইতিহাসে এটা বার বার দেখা গিয়েছে–ধর্মমত যাই হোক না কেন বেশিরভাগ শাসকই ধর্ম নির্বিশেষে অধীনস্থ প্রজাদের উপরে নির্যাতন চালাতেন। অত্যাচার, লুণ্ঠন ও লুণ্ঠিত দ্রব্যের ভাগবাটোয়ারাকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব সর্বদাই চলেছে। এই আক্রমণ ও লুণ্ঠনের সঠিক কারণগুলিকে প্রায়শই এড়িয়ে যাওয়া হয়। কেন মন্দির বেশি আক্রান্ত হয়েছে মসজিদ নয়, তার বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা দেওয়া হয় না। মুসলিমদের দ্বারা যেমন মন্দির ধ্বংস হয়েছে তেমনই কাশ্মীরে, দক্ষিণ ভারতে হিন্দু রাজাদের হাতে মন্দির ধ্বংস হওয়ার উদাহরণও খুব কম নয়।
যদি রাজনৈতিক ইতিহাসের কথা বাদও দেওয়া হয়, তবুও সংস্কৃতির বিকাশে মুঘল যুগ ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে। মুঘল যুগে চিত্রশিল্পে অভূতপূর্ব উন্নতি, আবুল ফজলের ‘আকবরনামা’ ও আইন-ই-আকবরি, বাবরের ‘তুজুক-ই-বাবরি, গুলবদন বেগমের ‘হুমায়ুননামা’, সুরদাস, তুকারাম, তুলসীদাস প্রমুখের গ্রন্থ এর প্রমাণ দেয়। ওয়াকিয়াৎ-ই-বাবুরিতে উল্লিখিত বাইশ জন শিল্পীর মধ্যে মাত্র তিন জন ছিলেন মুসলমান। আবুল ফজল যে সতেরো জন শিল্পীর নাম উল্লেখ করেছিলেন, তার মধ্যে চার জন মাত্র মুসলমান ছিলেন। সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও আমরা জানি, সেতার যন্ত্রটি হিন্দু ও মুসলমানদের দুই ধরনের যন্তে্রর সমন্বয়। এসরাজ, সুরবাহার, সারেঙ্গি হিন্দু-মুসলমানের সাধনার ফসল। ভারতীয় রাগ হিন্দোল ও পারসিক রাগ মোকাম মিলিয়ে ইমন রাগের সৃষ্টি। খসরু থেকে তানসেন মুসলিম সঙ্গীত শিক্ষকদের নাম জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা, ঠুংরি-র ব্যবহারে ভারতীয় সঙ্গীতের সমৃদ্ধিতে মুসলিমদের অবদানকে অস্বীকার করলে তা হবে সচেতন ভাবে ইতিহাসের বিকৃতি। হিন্দু-মুসলিম সংযোগের মধ্য দিয়েই উর্দু ভাষার সৃষ্টি ও বিকাশ মূঘল যুগেই হয়েছিল। মুঘল পূর্ববর্তী যুগের ভারতীয় সভ্যতা প্রায় এক শতাব্দী বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এ যুগেই সেই সংযোগ পুনরায় স্থাপিত হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় ঐক্যের সূচনা এ যুগেই গড়ে উঠেছিল। এই যুগ আরও গুরুত্বপূর্ণ এ কারণেই যে, ১৫২৬ থেকে শুরু করে ১৭০৭-এ ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু পর্যন্ত দেশে কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেনি। মুঘলদের এড়িয়ে যে, চৌহান, পরিহার, শোলাঙ্কি প্রভৃতি রাজবংশের ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে, আজও তাঁদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু দাসবংশ, খলজিবংশ, তুঘলকবংশ, লোদিবংশ এমনকি মুঘলরাও আজ ভারতীয় জীবনের মূল ধারার সঙ্গে মিশে গিয়েছে। তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় আজ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বহুত্ববাদ ও সমন্বয়ের বৈচিত্রে্যর সাধনা মুঘল যুগেই ঘটেছিল– আজ যা রাষ্ট্র পরিচালকরা অস্বীকার করে বিকৃত ইতিহাসকে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইতিহাস হল একটি জাতির স্মৃতি। সেই স্মৃতি যদি লোপ পায় তবে সেই জাতি বিকারগ্রস্ত ও উন্মাদ হয়ে উঠবে। আজ যাঁরা মুঘল যুগকে ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়ার কথা বলছেন, তাঁরা নিজেদের জাতিকেও সেই বিপদের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। যদিও আশার কথা, দেশের বরেণ্য ইতিহাসবিদরা ইতিমধ্যে এর প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। অধ্যাপক ইরফান হাবিব সহ প্রথম শ্রেণির আড়াইশো জন ইতিহাসবিদদের প্রতিবাদের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিতও হয়েছে। বিকৃত ইতিহাস চর্চার বিরুদ্ধে দেশের গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন নাগরিকদেরও সচেতন এবং ক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।