বিজেপির চরম শিক্ষাস্বার্থ বিরোধী নীতিতেই সিলমোহর দিল তৃণমূল সরকার

রাজ্যের শিক্ষানীতির প্রতিবাদে কলেজ স্ট্রিটে ছাত্রবিক্ষোভ। ৯ সেপ্টেম্বর

পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ৯ সেপ্টেম্বর ‘গেজেট নোটিফিকেশন’-এর মাধ্যমে রাজ্যের শিক্ষানীতি ঘোষণা করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে গত তিন বছর ধরে মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীরা গোল গোল কথায় অর্থহীন কিছু বিরোধিতা করে রাজ্যের জন্য আলাদা শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার কথা বলে রাজ্যে পর পর দু’টি শিক্ষা কমিটি গঠন করেছিল। প্রথম কমিটির রিপোর্ট কী তা কেউই জানতে পারলেন না। তারপর কেন আরেকটি কমিটি গঠনের প্রয়োজন পড়েছিল তাও খোলসা করে সরকার বলেনি। শেষ পর্যন্ত যে শিক্ষানীতি রাজ্য সরকার ঘোষণা করল তা কথার সামান্য কিছু হেরফের ছাড়া কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতিরই কার্বন কপি।

রাজ্যের শিক্ষানীতিতে দেখা যাচ্ছে, স্কুলশিক্ষাকে তারা ৫+৪+২+২ হিসাবে ভাগ করেছে। প্রথম ৫ বছরের স্তরটি হল সরকারি বা বেসরকারি প্রাক-প্রাথমিকের এক বছর সহ চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত, দ্বিতীয় স্তর পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। নবম, দশম ও একাদশ, দ্বাদশ চারটি শ্রেণি নিয়ে শেষ দুটি স্তর। কেন্দ্রের শিক্ষানীতিতে স্কুলস্তরকে ৫+৩+৩+৪ হিসাবে ভাগ করা হয়েছে। সেই স্তরগুলি হল, অঙ্গনওয়াড়িতে তিন বছর বয়সে ভর্তি হয়ে তিন বছর সেখানে কাটিয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি পড়বে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এইটি হল পাঁচ বছরের ভিত্তিস্তর। তৃতীয় থেকে পঞ্চম এবং ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি হল পরের দু’টি স্তর। নবম থেকে দ্বাদশ হল চতুর্থ স্তর। কেন্দ্রের শিক্ষানীতি অনুযায়ী একজন শিক্ষার্থীকে দ্বাদশ শ্রেণি পাশ করতে ১৫ বছর লাগবে। রাজ্য সেই ভাগকে একটু অন্যরকম করে ৫+৪+২+২ বললেও অঙ্গনওয়াড়ি শিক্ষায় শিশুর তিন বছর বয়সে ভর্তি হয়ে দু’বছর কাটানোর কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রেও দ্বাদশ শ্রেণি পাশ করতে সেই ১৫ বছরই লাগবে। বড় বড় বিশেষজ্ঞদের দিয়ে দু’দুটি কমিটি করার পর যে শিক্ষানীতি তারা ঘোষণা করেছেন, তাতে এইটুকু পার্থক্য তারা করাতে পেরেছেন!

কলেজ স্তরের শিক্ষা কিংবা শিক্ষার বেসরকারিকরণের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার কেন্দ্রের সাথে কোনও পার্থক্যই রাখেনি।

ঘোষিত রাজ্য শিক্ষানীতির বৈশিষ্ট্যগুলি হল,

* শিক্ষার সমস্ত ক্ষেত্রে সরকারের প্রত্যক্ষ আর্থিক দায় অস্বীকার করে বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণকে উৎসাহিত করা। গবেষণা ও শিক্ষার জন্য সরাসরি বেসরকারি মালিকদের উপর নির্ভরশীলতা। কেন্দ্রের মতোই শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি ব্যয় কমিয়ে পিপিপি মডেল বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে উৎসাহ, যা বেসরকারিকরণকেই ত্বরান্বিত করবে।

* প্রাক প্রাথমিক পর্যায়ের তিন বছর বয়স থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ইউনিক আইডেন্টিটি কার্ড চালু করা হবে। তাতে শৈশব থেকে কোন শ্রেণিতে ছাত্রছাত্রীর শিক্ষার কেমন মান ছিল তার উল্লেখ থাকবে। তার ফলে গরিব ঘরের সন্তান – যারা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে ভর্তি হয়ে প্রথম জীবনেই নিম্নমানের শিক্ষা নিতে বাধ্য হবে। তারা পরবর্তীকালে ভাল ফল করলেও ইউনিক আইডেন্টিটি কার্ডে উল্লেখিত সেই নিম্নমানের বোঝা তাকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।

* স্কুল ও কলেজ উভয় ক্ষেত্রেই প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে পূর্ণাঙ্গ পরিকাঠামো তৈরি না করে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে ক্লাস্টার গঠনের কথা বলা হয়েছে। স্কুল স্তরে সারা রাজ্যে ১,৩১৩টি ভাল স্কুলকে চিহ্নিত করে এক একটি ভাল স্কুলের সাথে কাছাকাছি এলাকার ১০টি করে স্কুলকে জুড়ে দেওয়া হবে। তারা ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরি, খেলার মাঠ, জিমন্যাসিয়াম, শিক্ষক ও অন্যান্য সম্পদ ভাগাভাগি করে ব্যবহার করবে। ফলে শিক্ষক, অশিক্ষক কর্মচারী, ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরি, শ্রেণিকক্ষ বা অন্যান্য সরঞ্জামের অভাব পূরণের নামে ছাত্র-ছাত্রীদের এবং শিক্ষক শিক্ষাকর্মীদের ক্লাস্টার ধরে নানা প্রতিষ্ঠানে ছোটাছুটি করে পড়াশোনার কাজ চালাতে হবে। অভিভাবকদেরও তাদের সন্তানদের নিয়ে নিজ-স্কুল ছেড়ে এই স্কুল-সেই স্কুলে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। ফলে শিক্ষার নতুন পরিকাঠামো তৈরির দায়িত্ব কার্যত অস্বীকার করে হয়রানি বাড়ানোর ব্যবস্থাই রাজ্যের শিক্ষানীতিতে করা হয়েছে।

* বিজেপির পথ অনুসরণ করেই এই শিক্ষানীতিতে ত্রিভাষা সূত্রের প্রয়োগ চেয়ে কৌশলে হিন্দি চাপানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।

* বিদ্যালয়ের উচ্চ প্রাথমিক স্তরে অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণি থেকেই সেমিস্টার পদ্ধতি চালু হবে। স্কুলস্তরে সেমিস্টার পদ্ধতির প্রয়োগ বিভিন্ন মৌলিক বিষয়ে সুসংবদ্ধ জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে।

* শিক্ষার মূল্যায়ন সম্পর্কে রাজ্য শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে– বর্তমান মূল্যায়ন ব্যবস্থা পরীক্ষা, চাপ ও উদ্বেগের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু পাশ-ফেল প্রথা ফিরিয়ে আনার কোনও কথা এতে নেই। বোঝা যায় জাতীয় শিক্ষানীতির সুরেই পাশ-ফেল প্রথাবিহীন মূল্যায়নের কথাই বলা হয়েছে একটু ঘুরিয়ে

* এই রাজ্য শিক্ষানীতি ঘোষণার আগেই পরিকাঠামোর কোনও রকম উন্নতি না করে এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ না করে কলেজ স্তরে চার বছরের ডিগ্রি কোর্স আগেই রাজ্য সরকার চালু করেছে। তিন বছরের অনার্স সহ ডিগ্রি কোর্সের জায়গায় সরকার চার বছরের কোর্স করে ছাত্রদের ঘাড়ে একটি বছর বাড়তি চাপিয়ে দিয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে বর্ণিত চার বছরের ডিগ্রিকোর্সে যা যা বলা হয়েছে অর্থাৎ মাল্টিডিসিপ্লিনারি কোর্স, মাল্টিপল এন্ট্রি ও এক্সিট, অ্যাকাডেমিক ব্যাঙ্ক অফ ক্রেডিটের উদ্ভট ব্যবস্থা সবই রাজ্য বহাল রেখেছে। এর ফলে শিক্ষার শৃঙ্খলা পুরোপুরি বিনষ্ট হবে।

* বিজেপির রাস্তাতেই স্কুলস্তর থেকে বৃত্তিমূলক শিক্ষার উপর জোর দেওয়ায় কোনও বিষয়ে তত্ত্বগত জ্ঞান অর্জন, বিষয়ের গভীরে ঢোকা ইত্যাদি কোনও কিছুই হবে না, যা শিক্ষার প্রাণসত্তাকে ধ্বংস করে দেবে।

* কেন্দ্রের মতোই রাজ্য শিক্ষানীতিতে অনলাইন, ডিজিটাল, অ্যাপভিত্তিক ও দূরায়ত শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ফলে গরিব ছাত্রছাত্রীরা আর্থিক কারণে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে এবং ফোনে নিয়মিত রিচার্জ করতে শিক্ষার্থীদের উপর বিপুল পরিমাণে আর্থিক বোঝা চাপবে।

এই সমস্ত বিষয়ের সাথে যুক্ত হয়েছে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে রাজ্য সরকার এবং রাজ্যপালের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের নগ্ন দলবাজি। পরিস্থিতি এত অবনমিত হয়েছে যে, দু’পক্ষই অতি নিকৃষ্ট শব্দ প্রয়োগ করে একে অপরকে আক্রমণ করছে। এই আক্রমণ, প্রতি-আক্রমণে ক্ষতি হচ্ছে শিক্ষার। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে আচার্য হিসাবে রাজ্যপালের ভূমিকা সুনির্দিষ্ট। কিন্তু রাজ্যপাল কখনও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, কখনও অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস, কখনও প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতাবিহীন অধ্যাপককে উপাচার্য পদে নিয়োগ করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ব্যতিরেকেই। রাজ্যপাল এই সুযোগ পাচ্ছেন, কারণ এই পরিবেশ তৃণমূল কংগ্রেস সরকারই তৈরি করেছে। তৃণমূল সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় আইন ও উপাচার্য নিয়োগ সংক্রান্ত আইনের একের পর এক যে সংশোধনীগুলি বিধানসভায় পাশ করেছে তার সুযোগ নিচ্ছেন রাজ্যপাল তথা বিজেপি। তৃণমূল কংগ্রেস সরকার বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধন করে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে যে দলীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চেয়েছিল, কেন্দ্রীয় সরকার তথা বিজেপির স্বার্থসিদ্ধি করতে রাজ্যপাল সেই আইনের অপব্যবহার করছেন। দুই পক্ষের ভূমিকাতেই বিশ্বদ্যালয়গুলিতে চরম অব্যবস্থা ও অচলাবস্থা চলছে। এদিকে এই অজুহাতেই রাজ্য সরকার রাজ্যপালের পরিবর্তে মুখ্যমন্ত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদে বসানোর প্রচেষ্টায় আইন সংশোধন করেছিল। যদিও তা এখনও রাজ্যপালের অনুমোদন পায়নি। এর বিরুদ্ধে রাজ্য জুড়ে প্রবল প্রতিবাদ হয়। বুদ্ধিজীবী শিক্ষাবিদরাও তাতে সামিল হন। কেন্দ্র না রাজ্য কোন ক্ষমতাসীন দল তা নিয়ন্ত্রণ করবে তা নিয়ে উভয়পক্ষ নোংরা যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাধিকার ধ্বংস করতে দু’পক্ষই তৎপর। শিক্ষার্থীদের ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ এখানে সম্পূর্ণ গৌণ।

শিক্ষাক্ষেত্রে এই চরম অব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক শিক্ষা চালুর দাবিতে এস ইউ সি আই (সি) এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। এ রাজ্যের ছাত্র-শিক্ষক, অভিভাবক সহ সকল শিক্ষানুরাগী মানুষকে শিক্ষাকে ধবংস করার বিপুল এই সরকারি আয়োজনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে