সম্প্রতি ৬০০ জনেরও বেশি আইনজীবীরপ্রধান বিচারপতিকে লেখা একটি চিঠি অনেককে চমকে দিয়েছিল। তাঁরা বিচারব্যবস্থার সুনাম রক্ষার্থে সক্রিয় পদক্ষেপ করার জন্য প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ করেছেন। গণতন্ত্রের এক স্তম্ভস্বরূপ বিচার ব্যবস্থার সংহতি বজায় রাখতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, বিচারবিভাগের অখণ্ডতাকে ক্ষুণ্ন করতে সচেষ্ট স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সম্পর্কে উদ্বেগও তাঁরা প্রকাশ করেছেন। চিঠিতে বলা হয়েছে, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী তাদের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডার উপর ভিত্তি করে আদালতের সিদ্ধান্তের একপেশে সমালোচনা বা প্রশংসা করে। ‘বেঞ্চ ফিক্সিং’-এর অভিযোগ করে, এমনকি বিচারকদের সরাসরি আক্রমণও করে। তলিয়ে না দেখলে অনেকেরই মনে হতে পারে, তবে কি বিজেপি আমলে বিচারব্যবস্থার উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার যে অভিযোগ উঠছে এই আইনজীবীরা তার প্রতিকার চাইছেন?
কিন্তু পত্রলেখকদের পরিচয় জানলে বোঝা যায় ব্যাপারটা এত সরল নয়। বিশেষত যে বিজেপি সরকার বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতায় বারবার আঘাত করছে, সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী যখন এই চিঠি নিয়ে আগ বাড়িয়ে তাঁর সমর্থনসূচক মন্তব্য ছড়িয়ে দেন, তখন ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতেই হয়! এই আইনজীবীদের মধ্যে রয়েছেন হরিশ সালভে, আদিশ আগরওয়ালা, পিঙ্কি আনন্দ প্রমুখ। হরিশ সালভে বিজেপির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত এবং হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে সরকার পক্ষে মামলা লড়েন। গত বছর লন্ডনে তাঁর তৃতীয় বিয়ের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ললিত মোদী এবং বিজয় মাল্যের মতো পলাতক ব্যক্তিরা। নির্বাচনী বন্ড মামলায় তিনি ছিলেন এসবিআই-এর আইনজীবী। তিনি প্রবল চেষ্টা করেছিলেন যাতে বন্ড প্রাপকদের তালিকা প্রকাশিত না হয়।
আদিশ আগরওয়ালা হলেন নরেন্দ্র মোদির জীবনীর সহ-লেখক। তিনি সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি যিনি নির্বাচনী বন্ড বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় নাকচ করার জন্য ভারতের রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লিখেছিলেন এবং তাঁর এই কাজকে সুপ্রিম কোর্ট বারের কার্যনির্বাহী কমিটি নিন্দা করেছিল।
পিঙ্কি আনন্দ ২০০৭ থেকে ২০১০ পর্যন্ত বিজেপির আইনি সেলের জাতীয় আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বিজেপির সর্বভারতীয় জাতীয় কার্যনির্বাহী সদস্য ছিলেন। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, চিঠিটির পিছনে বিজেপির মাথা আছে। ঘটনাপ্রবাহ বলে, এটা লেখা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্যই। বিশেষত নির্বাচনী বন্ড নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় বিজেপিকে বিপাকে ফেলার পরেই এই চিঠির লেখকদের পরিচয় জানলে এই সন্দেহটাই গাঢ় হয়। বিজেপির উদ্বেগ হল, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ এবং সিএএ-র মতো আরও অনেক রায় এখনও সুপ্রিম কোর্টে বিবেচনাধীন রয়েছে। নির্বাচনের আগে যে কোনও বিরূপ রায় বেরোলে অবশ্যই তা প্রধানমন্ত্রী মোদির ভাবমূর্তিকে প্রভাবিত করবে।
প্রশ্ন জাগে, বিজেপিপন্থী আইনজীবীরা কি রূপকথার ‘রিপভ্যান উইংকল’-এর মতো দীর্ঘ ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ দেখলেন, বিচারব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে? তাঁরা কি ভুলে গেলেন যে, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টের চার বিচারপতি দিল্লিতে সাংবাদিক সম্মেলন করে ভারতের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রকে অভিযুক্ত করেছিলেন বিশেষ বিশেষ মামলা, বিশেষ বিশেষ সুবিধাজনক বেঞ্চে পাঠানোর জন্য। ইঙ্গিত ছিল সরকারি ক্ষমতাকে খুশি করার জন্য এমনটা করা হতে পারে– সে দিকেই।
উল্লেখ্য, বিচারপতি দীপক মিশ্র অবসর নেওয়ার পরেই তাঁকে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। রঞ্জন গগৈ, যিনি আইন, সংবিধানের ওপরে বিশ্বাসকে স্থান দিয়ে বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণে রায় দেওয়ার বেঞ্চেও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, অবসর নেওয়ার পরে তাঁকে রাজ্যসভার সদস্যপদ দেওয়া হয়েছিল। বিচারপতি এস আব্দুল নাজির, যিনি রাম মন্দির রায় সংক্রান্ত বেঞ্চের অংশ ছিলেন, তাঁকে অবসরের পরেই অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্যপালও করা হয়েছিল। এ রকম ‘ভালো কাজের পুরস্কার’-এর আরও অনেক উদাহরণ আছে। সালভে মহাশয়রা এ সব উদাহরণ জানেন না তা নয়। তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন ইতিমধ্যেই বহু বিশিষ্ট আইনবিদ, প্রাক্তন বিচারপতি এর থেকে বিচারব্যবস্থাকে মুক্ত করার জন্য বহুবার মুখ খুলেছেন।
আলোচ্য চিঠির উদ্দেশ্য আরও প্রকট হয়ে যায় ২৬ জানুয়ারি ইউটিউবে পোস্ট করা সুপ্রিম কোর্টের একজন বিশিষ্ট আইনজীবী দুষ্মন্ত দাভের সাক্ষাৎকারটি শুনলে, যা সুপ্রিম কোর্টের ভিতরের ছবিটা প্রকাশ করে। তাঁর উত্থাপিত প্রশ্নগুলির উত্তর আজও পাওয়া যায়নি। ওই ৬০০ জন আইনজীবী বলতে চেয়েছেন, তথাকথিত বিভিন্ন গোষ্ঠীর অযাচিত চাপের কারণে সুপ্রিম কোর্ট ন্যায়সঙ্গত আচরণ করছে না। অথচ ভারতীয় বিচারব্যবস্থা সম্বন্ধে এতটুকু খোঁজ রাখা যে কোনও মানুষ বলবেন, আসলে বিচারব্যবস্থাকে সরকারের তাঁবেদার করতে চাইছে কারা? বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে কলেজিয়ামের সুপারিশকে বারবার পাল্টানোর জন্য চাপ দেওয়া, সরকারের অপছন্দের বিচারপতিদের ট্রান্সফার করার জন্য চাপ সৃষ্টি, অপছন্দের বিচারপতিদের প্রমোশন আটকানো ইত্যাদি কাজে বিজেপি সরকার কংগ্রেসের থেকেও বেশি দক্ষতা অর্জন করেছে! এ কথা ঠিক, বুর্জোয়া ব্যবস্থারই অন্যতম স্তম্ভ বিচারব্যবস্থার ওপরই শুধু নির্ভর করে থাকলে আজকের দিনে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করার কোনও গ্যারান্টি থাকে না। বিচারব্যবস্থাকেও অন্তত আপাত নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাখতে গেলে জনগণের সচেতন সংঘবদ্ধ গণআন্দোলন এবং আন্দোলনমুখী পরিবেশ দেশে প্রয়োজন। না হলে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা কখনও কখনও জনগণের পক্ষে রায় দিলেও তার ধারাবাহিকতা থাকে না। জনগণের সক্রিয়তাই মূল শক্তি।