সম্প্রতি এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি শেখর কুমার যাদব বলেছেন, গোরক্ষা হিন্দুদের মৌলিক অধিকার। এমন কথা কোনও অজ্ঞ মূর্খ ধর্মান্ধ ব্যক্তি বললে তার প্রতি করুণা প্রদর্শন করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। কিন্তু এমন কথা যখন কোনও হাইকোর্টের বিচারপতি বলেন, তখন বিষয়টি চিন্তার উদ্রেক করে বৈকি। ভাবতে অবাক লাগে খাদ্যের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, চাকরির অধিকার, চিকিৎসার অধিকার এসব আজ আর হিন্দুদের ‘মৌলিক অধিকার’ হিসেবে বিবেচিত হয় না।
বিচারপতি যাদব নিশ্চয়ই সংবিধান পড়েছেন। ‘মৌলিক অধিকার’ বলতে কী বোঝায় তিনি তা জানেন না, এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। ভারতের সংবিধান স্বীকৃত ছয়টি মৌলিক অধিকারের স্বরূপ দেখলেই বোঝা যায়, যে অধিকারের অস্তিত্বহীনতায় নাগরিকের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়, সেই অধিকারগুলোই মৌলিক অধিকার। সেক্ষেত্রে কর্তাভজা ছাড়া আর কোন যুক্তিতে গোরক্ষা মৌলিক অধিকারের তালিকায় স্থান পেতে পারে বোঝা দায়।
ছোটবেলায় ছাত্রছাত্রীদের রচনা লেখার মতো বিচারপতি যদি বলতেন, গোরু উপকারী জীব, গোরুর দুধ-গোবর-চামড়া মানুষের কাজে লাগে। তাহলে কোনও প্রশ্ন ছিল না। গোরুর দুধে সোনা পাওয়া যায়, এমন কৌতুকে আমোদ প্রকাশ না করেও গোরুর উপকারিতা রচনাটিকে আরও সমৃদ্ধ করা যায় একথা যুক্ত করে যে, গরুর মাংসও খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বেশ কিছু রাজ্যে গোমাংস অন্যতম খাদ্য। ইতিহাস চর্চায় জানা যায়, একসময় বৈদিক ঋষিরাও গোমাংস ভক্ষণে অভ্যস্ত ছিলেন।
ইতিহাস এ কথাও বলে, যে কোনও কৃষিপ্রধান দেশে কৃষির সাথে যুক্ত পশু একটা বিশেষ কদর পায়। সে হিসেবে এদেশে! গোরুও কদর পায়। কিন্তু আজ কৃষিতে হাল-বলদের ব্যবহার অনেক কমে এসেছে। সেক্ষেত্রে গোমাতার যে সন্তানেরা গোরুকে উপকারী জীব থেকে ‘সাম্প্রদায়িক জীবে’ পরিণত করেছে, তাদের গোরুর প্রতি প্রকৃতই যে কোনও দরদবোধ নেই, তা উত্তরপ্রদেশ সহ দেশের গোশালাগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এদেশে গোরক্ষার নামে ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করা যায়, আবার গোরু জবাই বন্ধ করে বিদেশে গোরু চালান দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা মুনাফা করা যায়। ফলে বিজেপি-আরএসএস গোরু বা কোনও ধর্মের প্রতি ভক্তি থেকে নয়, তাদের নোংরা রাজনীতির অঙ্গ হিসেবে গোরুকে প্রচারের ইস্যু করে।
এ একরকম বোঝা যায়, কিন্তু একজন হাইকোর্টের বিচারপতি যখন যুক্তিহীন অন্ধ ধর্ম-ব্যবসায়ীদের সুরে কথা বলেন, তখন সামাজিক সংকটকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলতেই সাহায্য করা হয়। বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে কখনও বিচারব্যবস্থা চলতে পারে না। ব্যক্তিবিশেষের বা সম্প্রদায়ের ভাবাবেগকে ভিত্তি করে আইনের বিচার হলে তা ন্যায়বিচার হতে পারে না। জীব রক্ষা করার অজুহাতে মানুষের জীবনের অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না। বিজেপি-আরএসএস পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষা করার দায় বা দায়িত্ব নেই, ‘নিরপেক্ষ’ বিচারপতিরও কি নেই?
বিচারপতি যাদব আরও বলেছেন, ‘গোরু ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ, সরকারের উচিত সংসদে বিল এনে গোরুকে জাতীয় পশু ঘোষণা করা।’ শুধু এলাহাবাদ হাইকোর্ট নয়, চার বছর আগে এমন পরামর্শ দিয়েছিল রাজস্থান হাইকোর্টও। বিচারপতি মহেশচন্দ্র শর্মা গোরুকে ‘মাতা’ বলে বর্ণনা করে বলেছিলেন, ‘গোহত্যার চেয়ে বড় অপরাধ আর কিছুই হতে পারে না।’ সেদিন প্রশ্ন উঠেছিল, এ অপরাধ কি মানুষ হত্যার চেয়েও বড়? আসলে, বারবার এ হেন মন্তব্যে বিচারকদের নিরপেক্ষতা নিয়েই বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছে। বিজেপি-আরএসএসের মার্গদর্শনকারী হিন্দুত্ববাদী নেতাদের ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’র ব্যাখ্যার সুরে সুর মিলিয়ে বিচারপতিদের কথাগুলো শুনতে শুনতে তাঁদের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ জাগা অস্বাভাবিক কি? হিন্দু আচার, হিন্দু বিশ্বাস পালনই যে ভারতীয় সংস্কৃতি, এ তো ইতিহাসের অপলাপ, বিকৃতি ছাড়া কিছু নয়! ভারত শুধুমাত্র সংবিধানের প্রস্তাবনা অনুসারে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ নয়, এ দেশ বিদ্যাসাগর, শরৎচন্দ্র, ভগৎ সিং, নেতাজির পথ বেয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার মহান আদর্শকে বহন করে। সেদেশে হিন্দু ধর্ম-সম্প্রদায়ভিত্তিক সংস্কৃতিই একমাত্র সংস্কৃতি, এ বিশ্বাস জোর করে চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়। চিন্তায় ও কর্মে রাষ্ট্র্র ধর্মনিরপেক্ষ থাকতে না পারলে, তা মনুষ্যত্বের অবমাননা। এর দায় তথাকথিত ‘নিরপেক্ষ’ বিচারপতিরাও এড়িয়ে যেতে পারেন না।