ব়্যাট হোল মাইনারঃ শ্রমিকের দু’টি হাতের কোনও বিকল্প নেই

‘মানুষের সাথে মানুষের মতো ব্যবহার করা হোক। দেশে ভালবাসা-সম্প্রীতি বজায় থাকুক।’ মহম্মদ ইরশাদের স্বপ্ন বা চাওয়া এটুকুই। পঁয়তাল্লিশ বছরের মহম্মদ ইরশাদ সেই বারো জন ব়্যাট হোল শ্রমিকের একজন, যাঁরা নিজের জীবন বাজি রেখে উত্তরাখণ্ডে সিল্কিয়ারার সুড়ঙ্গে আটকে পড়া শ্রমিক ভাইদের মৃত্যুমুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন।

নিজস্ব একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই আজও হয়নি ইরশাদের। কয়েক বছর আগে মিরাট থেকে সপরিবারে দিল্লি চলে এসেছেন বেসরকারি সংস্থার সাথে চুক্তি শ্রমিক হিসাবে কাজ করবেন বলে। আর পাঁচজন বাবার মতোই ইরশাদও চান, ছেলেমেয়েরা একটু ভালো করে পড়াশুনা শিখুক, নিজের পায়ে দাঁড়াক। কিন্তু এত বড় সাফল্যের পর কী চাইছেন, এই প্রশ্নের উত্তরে সংবাদমাধ্যমের কাছে নিজের জন্য বাড়ি-ঘর-টাকাপয়সার কথা বলেননি ইরশাদ, বলেছেন মানুষে মানুষে ভালোবাসা সম্প্রীতির কথা।এই বারোজনের দলটির বেশিরভাগ শ্রমিক ধর্মে মুসলমান, কিছুজন দলিত সম্প্রদায়ের।মূলত এসেছেন উত্তরপ্রদেশের নানা প্রান্ত থেকে।ধর্ম বা জাতিগত পরিচয়ের ঊর্ধ্বে মানুষকে শুধুমাত্র মানুষ হিসাবেই দেখা, কিংবা সুস্থভাবে সসম্মানে বাঁচতে দেওয়ার পরিবেশ– এসবই যে শাসক শ্রেণি দেশে সুপরিকল্পিত ভাবে ধ্বংস করছে, সে কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতিদিনের জীবনযন্ত্রণা মথিত করে উঠে আসা সেই দীর্ঘশ্বাসই ধরা পড়েছে ইরশাদের কথায়।

সংকীর্ণ বিপদসংকুল জায়গায় বিশেষ প্রক্রিয়ায় সরু সুড়ঙ্গ খুঁড়ে তার মধ্যে ঢুকে কাজ করতে হয় ব়্যাট-হোল শ্রমিকদের। মারাত্মক ঝুঁকির কারণে এ পেশা খাতায় কলমে নিষিদ্ধ হলেও এই মানুষগুলোর জীবনযুদ্ধে সেই নিষেধাজ্ঞার কোনও প্রভাব পড়েনি। পেট চালানোর জন্য দিনের পর দিন এই ঝুঁকির কাজই করে যেতে বাধ্য হন তাঁরা। সুড়ঙ্গে চাপা পড়া একচল্লিশ জন শ্রমিক যখন মৃত্যুর প্রহর গুনছেন, বিদেশ থেকে আসা সুড়ঙ্গ-বিশেষজ্ঞ, প্রযুক্তিবিদরা যখন রীতিমতো ফেল, মেশিন দিয়ে বারবার নানা ভাবে গর্ত খুঁড়েও মানুষগুলোর কাছাকাছি পৌঁছানো যাচ্ছে না, তখনই ডাক পড়েছিল এই শ্রমিকদের। অন্ধকূপে মরতে বসা একচল্লিশটি প্রাণকে তারা ফিরিয়ে এনেছেন আলোয়, লোকসঙ্গীতের কিংবদন্তী শ্রমিক-চরিত্র জন হেনরির মতোই যেন হয়ে উঠেছেন ‘মেশিনের প্রতিদ্বন্দ্বী’। দু-দিনের জন্য এই ব়্যাট হোল শ্রমিকদের ছবি ছাপা হয়েছিল সংবাদপত্রে। সরকারি নেতা-মন্ত্রীরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন মিডিয়ার সামনে তাদের সাথে ছবি তোলার জন্য। কিন্তু এই বারো জন অসাধ্য সাধনের পুরস্কার কী চান? তাঁদের রুজিরুটির লড়াইতে কি কোনও বদল আসবে এর পরেও?

পঁয়ত্রিশ বছরের মহম্মদ কুরেশি সহজ করে বলেছেন সার সত্যি কথাটি। ‘শ্রমিক ভাইয়েরা এখানে বাঁচিয়ে এনেছে শ্রমিক ভাইদের।’ এক অসম্ভব রূপকথার মতো শুনতে লাগে তাদের অভিজ্ঞতার কথা। বারো জন শ্রমিক মিলে ছাব্বিশ ঘণ্টা লাগাতার কাজ করেছেন, সুড়ঙ্গের ধ্বংসস্তূপ ঠেলে এগোনোর জন্য ৮০০ মিলিমিটার সরু পাইপের মধ্যে দিয়ে গর্ত খুঁড়ে পথ তৈরি করেছেন। বিদেশ থেকে আনা যন্ত্র দিয়ে যে কাজ হয়নি, এই বারো জন শ্রমিকের অসামান্য দক্ষ হাত হাতুড়ি-শাবল-ছেনি চালিয়ে তা করে দেখিয়েছে।

প্রশ্ন উঠেছে, সিল্কিয়ারার ঘটনা কি অনিবার্য ছিল? পরিবেশবিদ এবং বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা, পরামর্শ অগ্রাহ্য করে, পরিবেশের ক্ষতি করে প্রধানমন্ত্রীর সাধের চারধাম প্রকল্প গড়ে তুলে দেশের সাধারণ মানুষের কোন মঙ্গলসাধন করতে চাইছে বিজেপি সরকার? এতজন শ্রমিককে যে ঝুঁকি নিয়ে সুড়ঙ্গে নামতে হল এবং ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আটকে থাকতে হল এতদিন, এর দায় এবং দায়িত্ব কার? ওই একই সময়ে লক্ষ কোটি টাকা ব্যয়ে যখন দেশজুড়ে বিশ্বকাপের উদযাপন চলছে, প্রধানমন্ত্রী বা তার দলের নেতা-মন্ত্রীরা কতবার এসে দাঁড়িয়েছেন ওই মরণকূপের সামনে? কতবার ছুটে গেছেন বিপন্ন শ্রমিকদের পরিবার-পরিজনদের কাছে? উদ্ধারকাজের আলোচনার ভিড়ে প্রায় হারিয়ে যাওয়া এই জরুরি প্রশ্নগুলো ফিরে এসেছে বারো জনের দলের আরেক সদস্য ফিরোজ কুরেশির কথায়।

টেনেটুনে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা দৈনিক রোজগারে বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী, তিন সন্তানের ভরণপোষণ চালাতে হয় ফিরোজকে। সরকারের কাছে তাঁর কাতর অনুরোধ– এই ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে, কোনও শ্রমিক ভাইকে যেন এমন পরিস্থিতিতে আর কখনও পড়তে না হয়। ‘ডাকলেই আমি আসব। আমার ভাইদের যখনই দরকার পড়বে ছুটে আসব। কিন্তু চাইলে এমন ঘটনা আটকানো যায়, আটকানো উচিত।’ আটকানো যে যায় এবং আটকানো যে উচিত, ফিরোজের মতো সাধারণ মানুষ তার বাস্তব জ্ঞান এবং মানবিকতাবোধে এ কথা বুঝলেও সরকারের কানে এই আবেদন পৌঁছাবে, তা দুরাশা। শ্রমিকের জীবন বিপন্ন করে, সাধারণ মানুষের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সরকারি উদ্যোগের বাস্তবায়ন হচ্ছে, দেশে রাজ্যে এমন উদাহরণ কম নেই। বারবার প্রমাণ হয়েছে, যাদের অনুগ্রহে সরকারি কোষাগার ফুলে-ফেঁপে ওঠে, যারা টাকা ঢেলে প্রচার করে বড় বড় দলকে গদিতে বসায়, সেই পুঁজিমালিকদের স্বার্থরক্ষার জন্যই সরকার দায়বদ্ধ, তাতে পরিবেশই ধ্বংস হোক আর শ্রমিকরাই মরুক। অথচ যে মানুষগুলো নিজেদের জীবন বিপন্ন করে ডুবতে বসা উদ্ধারকার্য সফল করলেন, তাঁদের বেশিরভাগের মাথার ওপর একটা পাকা বাড়ির ছাদও নেই। ঊনত্রিশ বছরের মনু কুমার এসেছেন উত্তরপ্রদেশের আখতিয়ারপুর গ্রাম থেকে।মনু শুধু নিজের জন্য কিছু চাননি, বলেছেন তাঁর গ্রামের বেহাল দশার কথা।মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ যদি একটা পাকা রাস্তা করে দেন বড় ভালো হয়।

মনুর মতোই এক দলিত যুবক পঁচিশ বছরের অঙ্কুর, বাড়ি ফিরছেন উদ্ধার পাওয়া শ্রমিকদের দেওয়া চকলেট আর ফল নিয়ে। অঙ্কুর চেয়েছেন, সব শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি আর বিমার ব্যবস্থা করুক সরকার। বারো জনের দলটির নেতৃত্বে থাকা ওয়াকিল হাসানের মনে পড়ে, লোহার স্তূপ জমে আটকে থাকা শেষ দু-মিটার পথ পরিষ্কার করতে কী ভয়ঙ্কর কষ্ট করতে হয়েছে। সে পথের শেষে এক শ্রমিক ধরেছেন আরেক শ্রমিকের হাত। হাসানের চোখ চকচক করে খুশিতেঃ ওদের বের করতে পেরে যে আনন্দ পেয়েছি, এমন আনন্দ ঈদেও পাই না। বত্রিশ বছরের নাসির আহমেদও সহকর্মী ইরশাদের মতোই চেয়েছেন মানুষের মর্যাদা– ‘নায়ক হওয়ার দরকার নেই, মানুষের মতো ব্যবহারটুকু যেন পাই।’ আরেক শ্রমিক দেবেন্দ্রকে তার স্ত্রী আসতে দিতে চাননি সিল্কিয়ারায়। কিন্তু কাগজে আটকে পড়া শ্রমিকদের ছবি দেখে আর স্থির থাকতে পারেননি দেবেন্দ্র। ‘মনে হচ্ছিল সুড়ঙ্গের ও প্রান্ত থেকে যেন ওরা ডাকছে আমায়। এই মানবতার ডাকে সাড়া দিয়েই দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে গেছেন বারো জন শ্রমিক, রক্তের সম্পর্কের টানে বা কোনও পুরস্কারের লোভে নয়। উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী মাথা পিছু পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন, বারোজনের কেউই সেই লোকদেখানো পুরস্কার নিতে চাননি। দলের কিছুজনকে আলাদা করে পুরস্কার দেওয়া বা দলের নেতাকে বিশেষ পুরস্কার দেওয়ার কথাও বলেছিল সরকার। শ্রমিকরা মেরুদণ্ড সোজা রেখে সেই পুরস্কারও প্রত্যাখ্যান করেছেন, বিভেদ তৈরির কোনও ষড়যন্ত্রের পা দেননি। শত অভাব-অনটন-বঞ্চনার মাঝেও মানবিক মূল্যবোধ আর আত্মমর্যাদাকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছেন এই মেহনতি মানুষগুলো। সিল্কিয়ারার ঘটনা প্রমাণ করেছে, ক্ষমতার রাজনীতি যতই বিভেদ-বিদ্বেষের দেওয়াল তুলে মনুষ্যত্বকে নষ্ট করার চেষ্টা করুক, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ এভাবেই পরস্পরকে ভালোবেসে বাঁচতে চান। (সূত্রঃ দি হিন্দু, ২৯ নভেম্বর, ২০২৩)