বিশ্বে ৭৮ কোটি মানুষ অনাহারী। অর্থাৎ প্রতি দশ জনে একজন মানুষের ভরপেট খাওয়া জোটে না। সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্য সংস্থা বিশ্ব খাদ্য প্রকল্পের কার্যনির্বাহী প্রধান সিন্ডি ম্যাকেন নিরাপত্তা পরিষদে বিশ্ব জুড়ে এই ভয়াবহ খাদ্য সংকটের কথা জানিয়েছেন। তিনি আরও জানিয়েছেন, এদের মধ্যে ৩৪ কোটিরও বেশি মানুষের খাদ্যের কোনও নিরাপত্তা নেই। বিশ্ব খাদ্য প্রকল্পের নিজস্ব হিসাব অনুযায়ী ৫০টি দেশে ৪ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ এখন দুর্ভিক্ষের ঠিক আগের অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন। পাঁচ বছরের কমবয়সি ৪ কোটি ৫০ লক্ষ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের কর্তারা এর দায় কোভিড অতিমারি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ– ইত্যাদির উপর চাপিয়েছেন। অবশ্যই অতিমারি ও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ অবস্থা অনেক ঘোরালো করে তুলছে। কিন্তু এই ক্ষুধা পরিস্থিতি কোভিড-অতিমারির আগেও ছিল। অপেক্ষাকৃত ধনী দেশগুলির যে অনুদান দেওয়ার কথা, তা না দেওয়ায় রাষ্ট্রপুঞ্জের কোষাগারও শুকিয়ে আসছে। ফলে খাদ্য সরবরাহে তাদের কাটছাঁট করতে হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে যা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা। বিশ্বের এই সংকট দীর্ঘমেয়াদী। একেই তারা ‘নিউ নরমাল’ পরিস্থিতি বলে গা সহা করতে চাইছেন। কিন্তু পেট বড় বালাই। ক্ষুধার কামড়ে যে ঘুম আসে না!
কিন্তু কেন মানুষ খেতে পায় না? বিশ্বে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ কি প্রয়োজনের তুলনায় কম? তথ্য বলছে ঠিক উল্টো কথা– গোটা বিশ্বে মোট যা খাদ্য উৎপাদিত হয়, পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে প্রতিদিন ভরপেট খাওয়ালেও তা থেকে উদ্বৃত্ত থাকবে। তা হলে এত মানুষ অনাহারী কেন? আসলে বিশ্বের একটা বড় অংশের মানুষের খাবার কেনারই সংস্থান নেই। মানুষে মানুষে প্রবল আর্থিক বৈষম্যই এর জন্য দায়ী যা দেশে দেশে কায়েম হয়ে থাকা শোষণমূলক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিশ্ব থেকে অনাহার দূর করতে হলে শোষণমূলক এই ব্যবস্থাটিকেই দূর করা দরকার, যার উল্লেখ করা রাষ্ট্রপুঞ্জ বা বিশ্ব খাদ্য সংস্থার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তারা নানা টোটকার আশ্রয় নিচ্ছে।
এই ক্ষুধা-সংকট দূর করতে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা বেসরকারি বহুজাতিক সংস্থাগুলিকে অনুদানের হাত বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছেন। অর্থাৎ বিশ্বজোড়া এই ভয়ঙ্কর সমস্যা দূর করতে তাঁরা মুনাফা-লুটেরা মালিকদের দান-খয়রাতি তথা মানবিকতার আশ্রয় নিতে চেয়েছেন। কিন্তু ক্ষুধাসমস্যা সমাধানের এই রাস্তা আদৌ বাস্তবসম্মত?
এই সংকট দূর করতে বড় বড় শিল্পপতি অর্থাৎ বহুজাতিক সংস্থাগুলি কি আদৌ এগিয়ে আসবে? আজ বিশ্বপুঁজিবাদ বাজার সংকটে দিশেহারা। সংকট থেকে বেরোতে তারা অর্থনীতির সামরিকীকরণ করছে। যুদ্ধাস্ত্র বিক্রির জন্য যুদ্ধোন্মাদনা তৈরি করা, নানা অজুহাতে স্থানীয় যুদ্ধ বাধানো, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে কোনও না কোনও পক্ষ নিয়ে যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি সহ দেশের বাজারে ঢোকার চেষ্টা, এ সবই তার ব্যবসা বাড়ানোর অদম্য আকাঙক্ষা থেকে। মনে রাখা দরকার, ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতিতে আফ্রিকার দেশগুলিতে গম সরবরাহ মারাত্মক ভাবে বিঘ্নিত হয়েছে, যা সেখানকার বড় সংখ্যক মানুষকে অনাহার-অর্ধাহারের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তা সত্তে্বও যুদ্ধ বন্ধের পরিবর্তে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পুঁজিবাদী শাসকরা খুবই উৎসাহী।
খাদ্যসংকটের আরও একটি কারণ, সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দেশগুলি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউ টি ও)-র মাধ্যমে খাদ্যপণ্যে ভর্তুকি বন্ধের ফতোয়া। ভারতের মতো দেশে কর্পোরেট কোম্পানির হাতে বেশি বেশি করে খাদ্য ব্যবসা তুলে দেওয়া হচ্ছে। এই একচেটিয়া মালিকরা খাদ্যসংকট দূর করবে, নাকি খাদ্যপণ্যের ব্যবসা থেকে আরও মুনাফার ছক কষবে?
এই প্রশ্নে ভারতের অবস্থান ঠিক কোন জায়গায়? পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ায় পঞ্চম অর্থনীতির দেশ হয়ে ওঠার সাফল্যের বড়াই করে চলেছে কেন্দ্রের মোদি সরকার। কিন্তু কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো মানবিক সূচকগুলো একদম তলানিতে। আর্থিক বৈষম্য ক্রমশ বাড়ছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর সি রঙ্গরাজনের বক্তব্য,‘পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতি’ দেশ, চিত্তাকর্ষক ঠিকই, সেই সঙ্গে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিও জরুরি। অর্থাৎ জিডিপি-র নিরিখে ভারতের অর্থনীতি যতই সমৃদ্ধ হয়ে উঠুক, সেই সমৃদ্ধি শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিরই, তার সঙ্গে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক-কর্মচারীর জীবনের কোনও সম্পর্ক নেই। তাই বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের ২০২২ সালের হিসাবে ১২১টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০৭। অর্থাৎ এ দেশেও একটা বিরাট অংশের মানুষ দিনের পর দিন অনাহারে কাটাচ্ছেন। আয় বাড়া দূরের কথা, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আয় ক্রমাগত কমছে।
সাধারণ মানুষের আয় বৃদ্ধির বহু প্রতিশ্রুতি এ দেশের সরকারি অর্থনীতিবিদ থেকে অর্থমন্ত্রী প্রতি বছর দিয়ে যাওয়া সত্তে্বও তা বাড়ছে না কেন? কেন্দে্র নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে থেকেই যে আর্থিক অগ্রগতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার কথা বলেছিলেন, তার একটাও কি তিনি পালন করেছেন? সাধারণ মানুষের আর্থিক উন্নতি ঘটাতে গেলে যে আর্থিক নীতি গ্রহণ করতে হয়, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সেবাদাস হিসাবে কাজ করে তা আজ কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিজস্ব প্রক্রিয়াতেই সম্পদ ক্রমাগত মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির কুক্ষিগত হচ্ছে। তাই দেশের ৭০ শতাংশ সম্পদের মালিক আজ ১ শতাংশ পুঁজিপতি। জনসংখ্যার সবচেয়ে নিচের ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ সম্পদ। এ দেশে ক্ষুধার্ত মা তার সন্তানকে হাটে বিক্রি করতে বাধ্য হয়।
খেতে না পেয়ে অনাহারে মৃত্যু সরকারি নথিতে পাওয়া না গেলেও বাস্তবে এ এক নির্মম সত্য। গত ২৭ জুলাই সরকারি সংস্থা নীতি-আয়োগের রির্পোটই বলছে, ভারতের ৭৪.১ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যকর খাবার কিনতে পারেন না। এই মর্মান্তিক সত্য আজ আর পরিসংখ্যানে আটকে নেই। যত দিন যাচ্ছে পুঁজিবাদের নির্মম শোষণে বিশ্ব জুড়ে ক্ষুধিত মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার বন্ধ করতে হলে এই পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অবসান চাই।