সবদিক থেকে আয়োজনটা তৈরিই ছিল। কেবল অপেক্ষা ছিল একটু সুযোগের। গত ২৬ জুলাই মণিপুর নিয়ে লোকসভা ও রাজ্যসভায় একটানা গণ্ডগোলের মধ্যে সেই সুযোগটি নিয়েছে বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার। কোনও আলোচনার সুযোগ না দিয়েই বন (সংরক্ষণ) বিল-২০২৩ সংসদের উভয় কক্ষেই পাশ করিয়ে নিয়েছে তারা। আর তা আইনে পরিণত হওয়ার সাথে সাথেই এর আসল উদ্দেশ্য— আদিবাসী ও চিরাচরিত বনবাসীদের ভূমিহীন করার ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রটি দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে।
আইন পাশ হওয়ার পরে পরেই ১২ আগস্ট ওড়িশার রায়গড়া জেলার সিজিমালি পাহাড়ে বেদান্ত গোষ্ঠী অন্যায়ভাবে বনভূমির দখল নিতে উদ্যোগী হয়। রায়গড়া ও কালাহাণ্ডি জেলার কুত্রুমালি পাহাড়ে আদানি গোষ্ঠীও একইভাবে বনভূমির দখল নিতে যায়। গ্রামবাসীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রতিবাদী আদিবাসী যুবকদের উপর পুলিশ অত্যাচার করে এবং তাদের বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের করে। এই দুটি প্রকল্প গড়ে তুলতে ১৮০টি গ্রামের প্রায় দুই লক্ষ আদিবাসী মানুষকে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হবে। উল্লেখ্য, পূর্বপ্রস্তুতি হিসাবে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ওড়িশা সরকার গ্রামসভার সম্মতি না নিয়েই অন্যায়ভাবে এই বনভূমির লিজ অনুমোদন করে রেখেছিল।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপ অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। ইতিপূর্বে কেন্দ্রীয় সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রক গত বছর ২৮ জুন ‘বন সংরক্ষণ রুলস-২০২২ক্স-এর বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল। এই বিধি অনুযায়ী বন ও পরিবেশ মন্ত্রক গ্রামসভার অনুমতি ছাড়াই জঙ্গলের জমি অন্য কাজে ব্যবহারের জন্য শিল্পপতিদের হাতে তুলে দিতে পারবে। সাথে সাথে ক্ষতিপূরণ বাবদ শিল্পপতিদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে পারবে। তারপর কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারকে জমি ও জঙ্গলের অধিকার সংক্রান্ত প্রশ্নের মীমাংসা করতে বলবে। বহুকাল ধরে চলে আসা গ্রামসভার অধিকারকে কেন্দ্রীয় সরকার এর মধ্য দিয়ে সুকৌশলে এড়িয়ে গেছে। সাথে সাথে অরণ্যের অধিকার আইন-২০০৬-কে শক্তিহীন করে দিয়েছে। বন সংরক্ষণ রুলস-২০২২-এর পর বন সংরক্ষণ আইন-২০২৩ পাশ করার মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ‘অরণ্যের অধিকার আইন-২০০৬’-কে একেবারে সমাধিস্থ করার উদ্যোগ নিয়েছে।
জঙ্গলের অধিকার আইন-২০০৬ একটি দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল। সকলেই জানেন, ভারতবর্ষের দীর্ঘদিনের ইতিহাস বেদনাদায়ক ভাবে আদিবাসী, বনবাসী ও গরিব শোষিত মানুষকে বঞ্চনার ইতিহাস। স্বাধীনতার আগে থেকেই আদিবাসী ও গরিব শোষিত মানুষ জল, জমি, জঙ্গল রক্ষার আন্দোলন করে এসেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি লাভের পরথেকে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত ইংরেজ যখন জঙ্গলমহল সহ ছোটনাগপুরের মালভূমি অঞ্চলে এবং রাজমহল এলাকাতে থাবা বসাতে চেয়েছে তখনই আদিবাসী ও ওই এলাকার গরিব শোষিত মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে। সেই সময় রাজমহল এলাকাতে পাহাড়িয়া বিদ্রোহ, ভাগলপুর অঞ্চলে তিলকা মাঝির নেতৃত্বে বিদ্রোহ, জঙ্গলমহলে চুয়াড় বিদ্রোহ, ভূমিজ বিদ্রোহ, ছোটনাগপুরে কোল বিদ্রোহ ও সিংভূমে হো বিদ্রোহ প্রভৃতি সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে জমিদার, মহাজন, আড়কাঠি, ঠিকাদার ও ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ১৮৫৫-৫৬ সালে সাঁওতাল পরগণা এলাকাতে সংঘবদ্ধ লড়াই হয়েছিল, যা ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ বা ‘হুল’ নামে পরিচিত। এই লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই সাঁওতাল পরগণার উদ্ভব। এই লড়াইয়ের ফলে ইংরেজ সরকার ওই এলাকার সাঁওতাল সহ আদিবাসীদের জমি রক্ষার জন্য যে সব আইনি সংস্কার শুরু করতে বাধ্য হয়েছিল তারই ধারাবাহিকতাতে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ১৯৪৯ সালে সাঁওতাল পরগণা টেন্যান্সি অ্যাক্ট প্রণীত হয়।
আবার ১৮৯৫-১৯০০ ব্যাপী ছোটনাগপুর এলাকা জুড়ে বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলন ‘উলগুলান’-এর ফসল হিসাবেই ১৯০৮ সালে ছোটনাগপুর টেন্যান্সি অ্যাক্ট চালু হয়। ১৮৯০ সালে জঙ্গল আইন-১৮৭৮-এর প্রতিবাদের মধ্য দিয়েই বিরসা মুন্ডার ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূচনা। এই বিদ্রোহগুলিকে ইংরেজ সরকার নির্মমভাবে দমন করে। এই শোষিত গরিব ও আদিবাসী মানুষ বাংলার তেভাগা আন্দোলনেও বীরত্বের সাথে অংশগ্রহণ করেছিল, শহিদের মৃত্যুবরণ করেছিল।
আদিবাসীদের আইনি অধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারের ভূমিকা
১৯৮৮ সালে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার রিজার্ভ ফরেস্ট অ্যাক্ট চালু করার ফলে দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ উচ্ছেদের সম্মুখীন হয়েছিল। ২০০২ সালে বিজেপি সরকারের কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রক এক নির্দেশিকায় জঙ্গলের জমিতে বংশপরম্পরায় বসবাসকারীদের ‘দখলকারী’ অ্যাখ্যা দিয়েপ্রায় এক কোটি আদিবাসী ও চিরাচরিত বনবাসী মানুষকে উচ্ছেদের কথা বলেছিল। সমস্ত গণতান্ত্রিক ও মানবতাবাদী সংগঠনগুলির সংগঠিত প্রতিবাদের মুখে পড়ে ২০০৩ সালে প্রাক্তন বিচারপতি বি এন কৃপালের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার ন্যাশনাল ফরেস্ট কমিশন গঠন করে। এই কমিশনের সুপারিশক্রমে ‘ফরেস্ট রাইটস অ্যাক্ট-২০০৬ক্স তৈরি হয়। আইনে বলা হয় ১৩ নভেম্বর ২০০৫ অবধি যারা জঙ্গলের জমিতে বসবাস করছেন বা জঙ্গলের জমি চাষবাস করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তাদের ওই জমির পাট্টা দেওয়া হবে। কিন্তু এই আইনটি কার্যকর করে পাট্টা দেওয়ার কোনও উদ্যোগই নেয়নি কেন্দ্রের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার।
এই গুরুত্বপূর্ণ আইনটি প্রণয়নের পরেও পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম পরিচালিত বামফ্রন্ট সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিল। ত্রিপুরাতে ছিল আরও কয়েক বছর। তারাও এই আইন প্রয়োগ করে বনবাসীদের জমির পাট্টা দেওয়ার ব্যবস্থা করেনি।
কেবল তাই নয়, ১৯৯৪ সালে এ রাজ্যের সিপিএম সরকার তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের পরিচিতি ও সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে যে সমস্ত আইন করে তার পরিণামে এই জনগোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের সমস্ত অধিকার থেকে চূড়ান্ত ভাবে বঞ্চিত করার চক্রান্ত শুরু হয়। এই সমস্ত পরিবারগুলির কাছ থেকে জমির তিন পুরুষ আগের সরকারি নথি চাওয়া হতে থাকে যেখানে জাতি (সাব কাস্ট)-এর উল্লেখ আছে। এই ধরনের নথি দেওয়া যে বাস্তবে তফসিলি জাতি ও উপজাতি জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয় সেটা সরকার ভালোভাবেই জানত। সেই সময় থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বিরাট অংশের মানুষকে কাস্ট সার্টিফিকেট থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ফলে শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ সহ অর্থনৈতিক বিভিন্ন প্রকার বরাদ্দ থেকে তাদের বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় ধরে এই অংশের দরিদ্র মানুষকে বাঁচার দাবিতে লড়াই করতে হচ্ছে।
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো বর্তমানে তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকারের ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্টের সচিব নির্দেশ জারি করেছেন, সিডিউল ট্রাইব সার্টিফিকেটগুলি নির্দিষ্ট পদবির ভিত্তিতে পুনর্বিবেচনার জন্য শুনানি করতে হবে। বলা হয়েছে, পদবিগুলি (সারনেম) বিশেষ জনজাতি গোষ্ঠীর জন্য নির্দিষ্ট কিনা, ১৫ দিনের মধ্যে মিলিয়ে দেখতে হবে। মহকুমা শাসকেরা বিভিন্ন এলাকার মানুষকে ডেকে কাগজপত্র দাবি করতে থাকেন। এই অন্যায় এবং বেআইনি নির্দেশিকার ফলে রাজ্য জুড়ে বিরাট আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রথমত, তফসিলি জাতি-উপজাতি ইত্যাদি অংশের মানুষের জন্য নির্দিষ্ট কোনও পদবি সরকারিভাবে কখনও নির্ধারিত ছিল না, এখনও নেই। একই সাব-কাস্টের অন্তর্ভুক্ত মানুষের বিভিন্ন ধরনের পদবি আছে। একই এলাকায় একই রাজ্যে এবং বিভিন্ন রাজ্যে এর তারতম্য বিশাল। দ্বিতীয়ত, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী যে কোনও ব্যক্তি এফিডেভিটের ভিত্তিতে নিজের পদবি পরিবর্তন করতে পারেন। এতে তাঁর সাব-কাস্ট পরিবর্তিত হয়ে যায় না। তাই পদবির ভিত্তিতে সাব-কাস্টের পর্যালোচনা সম্পূর্ণ আইনবিরুদ্ধ কাজ। তৃতীয়ত, কোনও আধিকারিকের মনগড়া সন্দেহের বশে সাংবিধানিক অধিকারের ভিত্তিতে দীর্ঘকাল চলে আসা সাব-কাস্ট সম্পর্কিত কোনও তথ্য কারও কাছ থেকে চাওয়া যায় না। সন্দেহের বশে এক বিশাল জনতার সার্টিফিকেট বাতিলের নির্দেশ বাস্তবে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, অবহেলিত, গরিব মানুষের কাছ থেকে জোর করে কাস্ট সার্টিফিকেট এবং তার ভিত্তিতে প্রাপ্য অধিকারগুলি কেড়ে নেওয়ার সামিল। ফলে ন্যায়সঙ্গতভাবেই দাবি উঠেছে, সার্কুলারটি অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে এবং এর ভিত্তিতে হওয়া শুনানিগুলি অবিলম্বে বাতিল ঘোষণা করতে হবে।
বিজেপি সরকার ঠিক এরই অনুসারী পদক্ষেপ নিচ্ছে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে। তারা ২০১৪ সালে ক্ষমতায় বসেই নতুন রুল এনে এমন শর্ত জুড়ে দেয় যাতে আদিবাসী ও চিরাচরিত বনবাসীদের পাট্টা পাওয়াই অসম্ভব হয়ে পড়ে। নতুন রুলে তারা বলে যে, জমির পাট্টা পেতে হলে তিন প্রজন্ম ধরে বসবাসের প্রমাণ দিতে হবে। তিন প্রজন্ম মানে ৭৫ বছর। এই নথি দরিদ্র মানুষ পাবে কোথায়? শিক্ষাবঞ্চিত, আইনকানুন সম্পর্কে ধারণাহীন এই মানুষগুলির কাছ থেকে এই নথি পাওয়া বাস্তবে অসম্ভব। তাছাড়া তাদের ভাঙা ঘরে ঝড়, বৃষ্টি, কীটপতঙ্গ প্রভৃতির হাত থেকে নথি রক্ষা করার উপযুক্ত ব্যবস্থাটুকুও নেই। এটা সরকার ভালো করেই জানে।
এতদসত্ত্বেও আদিবাসী, চিরাচরিত বনবাসী ও গরিব মানুষের জঙ্গলকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকার যে চিরাচরিত অধিকার ছিল, তার উপর আরও একটা আক্রমণ তারা এনেছে আদালতকে ঢাল করে। ‘অরণ্যের অধিকার আইন-২০০৬’ সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের এক মামলার রায়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ উচ্ছেদের সম্মুখীন হয়। ২৯ জানুয়ারি ২০১৬ সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ে বলা হয়, কোনও বনবাসী মানুষের কোনও আবেদন ‘দক্ষ আধিকারিক’ দ্বারা ‘যোগ্য নয়’ বলে বিবেচিত হলে, আবেদনকারীর নাম পাট্টা বা এই আইনের অন্য অধিকার প্রাপকদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে এবং তাকে জমি থেকে উচ্ছেদ করা বা তার বিরুদ্ধে অন্য আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর পরেও সুপ্রিম কোর্ট ২০১৮ ও ২০১৯-এ দু’বার উচ্ছেদের উপর জোর দেয়। এই রায় হতে পেরেছে সরকারের ভূমিকার জন্যই। সরকার কার্যত এই রায়ই চেয়েছিল। সেই পথেই তারা মামলা না করলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে এইরকম বিপদে পড়তে হত না।
কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদকেও লঙ্ঘন করেছে
এই প্রশ্নে সরকারের ভূমিকা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদেরও বিরোধী। মানবাধিকার সনদে বলা আছে, প্রত্যেক পরিবারের সমানাধিকার থাকবে। বলা হয়েছে, আদিবাসীরা যে সকল জমি, এলাকা এবং সম্পদ চিরাচরিতভাবে এবং বংশানুক্রমে অধিকার করে আছেন, দখল করে আছেন বা ব্যবহার করে আসছেন তা রক্ষা করতে হবে। আরও বলা হয়েছে, জীববৈচিত্র্য রক্ষার ক্ষেত্রে আদিবাসীদের জ্ঞান সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও রিও-এর পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ঘোষণাতে বলা হয়েছে, পরিবেশ রক্ষায় আদিবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এই ঘোষণাগুলির অন্যতম স্বাক্ষরকারী দেশ ভারত। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি একদিকে নতুন নতুন সংশোধনী বা রুলস এনে আদিবাসী, চিরাচরিত বনবাসী ও গরিব শোষিত মানুষের খানিকটা হলেও স্বার্থরক্ষাকারী আইন ‘অরণ্যের অধিকার আইন-২০০৬’, ‘ছোটনাগপুর টেন্যান্সি অ্যাক্ট’, সান্তাল পরগণা টেন্যান্সি অ্যাক্টক্স দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে ক্ষমতাহীন করছে। অপরদিকে জনবিরোধী ও কর্পোরেটদের স্বার্থরক্ষাকারী ‘অরণ্য (সংরক্ষণ) আইন-১৯৮০’ এর অধিনিয়ম-২০২২ ও সংশোধনী-২০২৩ এনে তাকে আরও কর্পোরেটের স্বার্থরক্ষার পরিপূরকভাবে শক্তিশালী করেছে।
প্রতিরোধের প্রস্তুতি ঘরে ঘরে
অল ইন্ডিয়া জন অধিকার সুরক্ষা কমিটি জন্মলগ্ন থেকেই এই সকল জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছে। বন (সংরক্ষণ) সংশোধনী আইন-২০২৩ ও বন (সংরক্ষণ) অধিনিয়ম-২০২২ বাতিলের দাবিতে গত ২৩ আগস্ট সারা ভারত প্রতিবাদ সংগঠিত হয়। এর পর বন (সংরক্ষণ) সংশোধনী আইন-২০২৩ ও বন (সংরক্ষণ) অধিনিয়ম-২০২২ বাতিল এবং অরণ্যের অধিকার আইন-২০০৬ সম্পূর্ণরূপে চালু করার দাবিতে দেশ জুড়ে রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে পোস্টকার্ডে স্বাক্ষর সংগ্রহ এবং ব্লক ও জেলা স্তরের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি পালিত হয়েছে। ইতিমধ্যেই নানা সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা, যারাই জঙ্গলের দখল নিতে যাচ্ছে আদিবাসী, বনবাসী ও গরিব শোষিত মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছে, প্রতিরোধ গড়ে তুলছে।
পরিবেশ সচেতন নাগরিক সমাজও এই সকল আন্দোলনকে সমর্থন করছেন, সর্বতোভাবে সাহায্য করছেন। ইতিপূর্বে ওড়িশার সিমলিপালে উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলন হয়েছে, ঝাড়খন্ডের হাজারিবাগ জেলার বড়কাগাও এবং ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত, আসাম ইত্যাদি রাজ্যে উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম ও পুরুলিয়া জেলাতে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে ও পাহাড়-জঙ্গল রক্ষার দাবিতে আন্দোলন গড়ে উঠেছে। দেউচা পাঁচামিতে খোলামুখ কয়লাখনির প্রতিবাদে এবং উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও যথাযথ পুনর্বাসনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে উঠেছে।
অপরদিকে অযোধ্যা পাহাড়ে জঙ্গল ও পরিবেশ ধ্বংস এবং গরিব বনবাসী ও আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে উঠেছে। দক্ষিণ ২৪ পরগণায় কর্পোরেটদের স্বার্থে সুন্দরবন ধ্বংস করে গরিব মানুষের সর্বনাশ করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং সারা রাজ্যে বংশ পরম্পরায় বসবাসকারীদের অবিলম্বে পাট্টা প্রদানের দাবিতে গণ কমিটি গঠিত হচ্ছে।
এই প্রতিবাদ, প্রতিরোধ স্বাভাবিক, যুক্তিসঙ্গত ও ন্যায়সঙ্গত। এই আন্দোলন আপামর জনসাধারণের অধিকার ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার আন্দোলনের পরিপূরক। তাই সকল শোষিত মানুষ ও সর্বস্তরের গণতন্ত্রপ্রিয় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকদের এই আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও সর্বাঙ্গীন সহযোগিতার মধ্য দিয়ে অধিকার রক্ষা ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার এই লড়াইকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন।