এক বছর হয়ে গেল নোট বাতিলের৷ ৮ নভেম্বর বর্ষপূর্তি৷ ২০১৬ সালের এই দিনটিতে হঠাৎই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নোট বাতিলের ঘোষণা করেছিলেন৷ বলেছিলেন, এর দ্বারা কালো টাকা উদ্ধার হবে, জাল নোট বন্ধ করা যাবে, আর সন্ত্রাসবাদীদের হাতে টাকা যাওয়া বন্ধ হবে৷
শতাধিক প্রাণহরণ, রাজস্বের বিপুল ক্ষতি, প্রবল হয়রানি ইত্যাদির সত্ত্বেও মানুষ আশা করেছিল হয়ত এই সমস্যাগুলির সমাধান হবে৷ কিন্তু কী পেল তামাম ভারতীয় জনগণ? গত বছর নোট বাতিলের পর প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন– ১) মাত্র ৫০ দিন সময় দিন৷ এই ৫০ দিন কষ্ট করলে তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে৷ ২) জাপান সফর থেকে ফিরেই গোয়ায় বলেছিলেন, ‘যদি ৫০ দিন পরও পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, তা হলে দেশের যে কোনও চৌরাস্তায় দাঁড় করিয়ে আমাকে জনতা শাস্তি দিতে পারে’৷ ৩) মোরাদাবাদে বলেছিলেন, ‘এই যে এটিএম আর ব্যাঙ্কের কাউন্টারে লাইন পড়েছে এটাই ভারতের সর্বশেষ লাইন’৷ ৩০ ডিসেম্বর ’১৬–র পর ‘ভারতে আর কোনও ব্যাপারেই লাইন দিতে হবে না’৷ ৪) গাজিপুরের সমাবেশে বলেছিলেন, ‘কালো টাকা, জাল টাকা, দুর্নীতি, ঘুষ এসব আর থাকবে না’৷
প্রধানমন্ত্রীর কথা বিশ্বাস করলে রেশন, ব্যাঙ্ক, ট্রেনের টিকিট কাউন্টার, ডাকঘর, কোনও পরিষেবার জন্যই আর লাইন দেওয়ার কথা নয়৷ দেশ থেকে নির্মূল হয়ে যাওয়ারকথা কালো টাকা, জাল টাকা, দুর্নীতি, অসততা, ঘুষের রাজত্ব৷ ২০১৭ সালে ভারতের সত্যিকারের সেরা এক রাষ্ট্রে হয়ে যাওয়ার কথা৷ এগুলির কটা বাস্তবায়িত হয়েছে?
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় ৯৯ শতাংশ নোট কোষাগারে ফিরে এসেছে৷ এখনও না কি সমবায় ব্যাঙ্কগুলিতে জমে থাকা বাতিল টাকা গোনা হয়নি৷ বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, মোট কালো টাকার মাত্র ছয় শতাংশ নগদে জমানো থাকে৷ তা হলে বাকি ৯৪ শতাংশ কালো টাকা– যা নগদে জমা নেই, তা কী করে বাজেয়াপ্ত হবে নোট বাতিলের দ্বারা? এ প্রশ্ন সেদিনই উঠেছিল৷ অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, আজ পর্যন্ত কত কালো টাকা উদ্ধার হয়েছে তার কোনও তথ্য নেই৷ বরং এই সুযোগে অনেক কালো টাকা সাদা করে নিয়েছে কালো টাকার মালিকরা৷ এ ছাড়া নতুন নোট জালের ভুরি ভুরি নজির আজ সর্বসমক্ষে রয়েছে৷ জঙ্গি হানার কোনও সুরাহা হয়েছে বলে তো দেশের মানুষের জানা নেই৷ তা হলে নিট ফল শূন্য–ও নয়, মাইনাসে পৌঁছে গেছে৷
২০০৬ সালে সুইস ব্যাঙ্ক অ্যাসোসিয়েশনের রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছিল, সুইস ব্যাঙ্কে ভারতীয় কালো টাকার পরিমাণ ১, ৪৫, ৬০০ কোটি ডলার৷ এই পরিমাণটা অন্যান্য সব দেশের মিলিত আমানতের চেয়ে বেশি৷ এটা দেশের বৈদেশিক ঋণের ১৩ গুণেরও বেশি৷ ৬৩৪ জন ব্যক্তির বিদেশে সঞ্চিত কালো টাকার মোট পরিমাণ ভারতীয় সম্পদের দ্বিগুণ৷ সেই কালো টাকা কি সরকার উদ্ধার করেছে? উদ্ধার দূরের কথা, সুপ্রিম কোর্ট কালো টাকার কারবারিদের নাম প্রকাশ করতে বলেছিল, সরকার তাতেও রাজি হয়নি৷ আমরা গণদাবীতে সেদিনই বলেছিলাম, এটি জনগণের সাথে মোদি সরকারের এক চরম প্রতারণা৷ কালো টাকা তৈরি হয় একটা প্রক্রিয়ায়৷ দুর্নীতিগ্রস্ত এই পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতি মুহূর্তে কালো টাকার জন্ম দিয়ে চলেছে৷ সেই প্রক্রিয়া বন্ধ না করে, নোট বাতিলের মাধ্যমে কালো টাকা বন্ধ করা যায় না৷ এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটিকে টিকিয়ে রেখে, তার রক্ষণাবেক্ষণের সমস্ত ব্যবস্থা করে কোনও সরকারের পক্ষেই কালো টাকা নির্মূল করা সম্ভব নয়৷ কালো টাকার বিরুদ্ধে বিজেপির স্লোগান তাই একটা রাজনৈতিক চমক ছাড়া আর কিছুই নয়৷ সে কথা আজ সত্য প্রমাণিত হয়েছে৷ প্রমাণিত হয়েছে, কালো টাকা ধরা নয়, প্রধানমন্ত্রীর আসল উদ্দেশ্য ছিল, তাঁর সরকারের সার্বিক ব্যর্থতা–পশাসন থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য চমক তৈরি করা৷
কালো টাকার উদ্ধারই যদি সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য হয়, তা হলে রাঘববোয়াল কালো টাকার মালিকদের একজনকেও তারা গ্রেপ্তার করল না কেন? এই প্রশ্ণে আগের সরকারগুলির সঙ্গে বিজেপি সরকারের কোনও ফারাক আছে কি? ১২ হাজার কোটি টাকা খরচ করে নতুন টাকা ছাপানোর বিপুল অর্থ ব্যয়, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির বিপুল রাজস্ব ক্ষতি, মানুষের সীমাহীন হয়রানি সর্বোপরি শতাধিক মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে কী পেল দেশের মানুষ? রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি থেকে প্রায় ৮ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে শোধ করেনি আম্বানি, রুইয়া, আদানি, বিজয় মালিয়া, ললিত মোদির মতো সব ধনকুবেররা৷ সরকার গ্রেপ্তার করে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করল না কেন? সরকার যে আদৌ কালো টাকা, ঋণখেলাপিদের টাকা উদ্ধার করতে চায় না, তা সরকারের একের পর এক পদক্ষেপেই পরিষ্কার৷ এই সব রাঘববোয়ালদের থেকে ঋণ ফেরত চাওয়া দূরের কথা, তারা যাতে আবার ঋণ নিতে পারে তার জন্য সরকার শুকিয়ে যাওয়া ব্যাঙ্কগুলিতে আরও ২.১১ লক্ষ কোটি টাকা মূলধন হিসাবে জোগাচ্ছে৷ এই টাকা তো জনগণেরই টাকা৷ সেই টাকাই ব্যাঙ্কগুলিতে নতুন করে ঢালছে সরকার৷ অথচ দেশের কৃষকরা ঋণ শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করছে, সরকারের কাছে ঋণ মকুবের দাবি জানাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিচ্ছে৷