‘জনস্বার্থে নির্বাচনকে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে হবে’৷
যখন নির্বাচনী প্রচারে কথার ফুলঝুরি ছুটছে রঙ–বেরঙের দলের নেতাদের মুখে, তার মধ্যে খুব সাদামাটা একটি বাক্য৷ কী দাম আছে এর কোনও খবরের কাগজের হেডিং খুঁজলে পাওয়া যাবে না, টিভি চ্যানেলের নামী–দামি অ্যাঙ্করদের সান্ধ্য তর্ক–আসরেও তার ঠাঁই নেই৷ বড় বড় ঝকমকে নেতাদের সভা কাঁপানো লাউড স্পিকারের ঝড়েও তার ঠাঁই হওয়ার নয়৷ তবু এই একটি শব্দ–বন্ধই আলোড়ন তুলছে, স্পন্দন জাগাচ্ছে মানুষের বিবেকে৷ যে মনুষ্যত্বকে শত চেষ্টাতেও শাসকশ্রেণি নির্মূল করে দিতে পারেনি, তারই দরবারে আবেদন নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে এই কথাগুলি৷
এস ইউ সি আই (সি)–এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের আবেদন সংবলিত পুস্তিকার এই শিরোনামটাই হয়ে উঠছে বহু জায়গার আলোচ্য বিষয়৷ হাজার হাজার কর্মীর চেষ্টায় সে বই পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের হাতে হাতে৷ ট্রেন ধরার তাড়ায় ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটা অফিসযাত্রীও তাই একটু থামছেন, নিয়ে যাচ্ছেন বই৷ আবার বাড়িতে বাড়িতে যাঁরা সংসারের সকলের মঙ্গলের সাধনায় দিন–রাত এক করে ফেলেন, সেই মা–কাকিমারা, যাঁরা নিতান্তই গৃহবধূ, হাতে তুলে নিচ্ছেন এই বই৷ তন্ন–তন্ন করে খুঁজছেন নির্বাচনী ডামাডোলের মাঝে গুলিয়ে যাওয়া সত্যের পথ৷ খাস কলকাতার ডালহৌসি পাড়া থেকে একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামের খেতে খামারে, কারখানার গেটে, হাটে–গঞ্জে এমন করেই হাতে হাতে পৌঁছে যাচ্ছে সে বই৷ কখনও লোকাল ট্রেনের কামরায় কখনও বা ভরা বাজারের চাপ–চাপ ভিড়ের ফাঁকে ফাঁকেও একটু কান পাতলেই প্রায়ই শোনা যাচ্ছে এই গুঞ্জন৷ যেমন দেখা গেল এপ্রিলের প্রথম শনিবারেই মধ্য কলকাতার লেবুতলা এলাকার ন্যাড়া গির্জার বাজারে৷ এস ইউ সি আই (সি) কর্মীরা বই বিক্রি করছিলেন৷ চায়ের দোকানে তখন আলোচ্য– ‘রাজ্যে ৪২টা আসনেই এস ইউ সি লড়ছে’? এক ছাত্রকর্মীকে ডাকলেন বর্ষীয়ান একজন৷ ‘বাড়িতে এস, তোমরা ৪২টা আসনেই লড়ছ বিরাট খরচ, এত পাবে কোথায়? কিছু টাকা নিয়ে যেও৷’ দিয়েছেন তিনি যথাসাধ্য৷ এমন অভিজ্ঞতা একটি নয়, সারা রাজ্য জুড়ে এমনই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছেন অক্লান্ত প্রচারে ব্যস্ত দলের কর্মী–সমর্থকরা৷
নির্বাচন একটি রাজনৈতিক সংগ্রাম৷ তাতে গুরুত্বপূর্ণ বিচার্য কী? রকমারি দলের ওজনদার, নানা তকমাধারী চটকদারি কথা? নাকি জনজীবনের সমস্যা সম্পর্কে সে দলের দৃষ্টিভঙ্গিটা ঠিক কী? এটা বুঝতে চাওয়াটাই যে সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন৷ এই কথাটাই ভোটবাজ দলগুলি ভুলিয়ে দিতে চায় মানুষকে৷ আর নির্বাচনের মুখে ঠিক সেই প্রশ্নটাই তুলে ধরছে এস ইউ সি আই (সি)৷ স্বাধীনতার ৭২ বছরে ১৬ বার পার্লামেন্টে প্রতিনিধি পাঠাতে ভোট দিয়েছে মানুষ৷ পরিণামে কী পেয়েছে তারা? সরকার এসেছে, সরকার গেছে, গদিতে আসীন দলের নাম ঝান্ডার রঙের পরিবর্তন হয়েছে৷ মানুষের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলির কী সমাধান হয়েছে? কেন হল না? কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে সেই প্রশ্নটাই তুলেছে কমরেড প্রভাস ঘোষের বই৷ তাই মানুষের বিবেককে তা নাড়া দিয়েছে৷ সে কারণেই দলের ৪৮ লেনিন সরণির দপ্তরের ফোন নম্বর জোগাড় করে কলকাতার হরিদেবপুর থেকে ফোন করেছেন এক মহিলা৷ বইটি পড়েছেন তিনি৷ জীবন সম্পর্কে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পেয়ে অভিভূত৷ দলের সাথে নিবিড় যোগাযোগ চান৷ বাঁকুড়া শহরের এক ব্যস্ত ডাক্তারবাবু বইটা নিজে পড়ার পর ডেকে পাঠিয়েছেন, দলের সংগঠককে৷ তিনি পৌঁছতেই তাঁর প্রথম প্রশ্ন, ‘সাথে বইটা বেশি করে এনেছেন? আমার সব পেশেন্টদের বাড়ির লোককে দিন৷ আমি চাই সকলে পড়ুক৷’
পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়া থেকে কলকাতার গার্ডেনরিচে কাজের সূত্রে আসা একজন দীর্ঘদিন সিপিএম করেছেন৷ খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন বামপন্থার যথার্থ স্বর৷ বইটি হঠাৎ করে পেয়েছেন এক রাস্তার মোড়ে৷ নিঃশেষে পড়েছেন সবটা৷ পরদিন গার্ডেনরিচের একপ্রচার টেবিলের কাছে এসে বলে গেছেন, আপনারাই আজ একমাত্র বামপন্থী৷ আপনাদের পাশেই আজ থাকা দরকার৷ আপনাদের কর্মীরা যেন আমার বাড়িতে যোগাযোগ করে৷
পিজি হাসপাতালের গেটে দাঁড়িয়ে বই বিক্রি করতে গিয়ে এক ছাত্রী কর্মীর অভিজ্ঞতা মন ছুঁয়ে যায়৷ এক মধ্যবয়স্ক মানুষ এসেছিলেন স্ত্রীর গুরুতর রোগের চিকিৎসা করাতে৷ বই নেওয়ার জন্য তাঁকে অনুরোধ করতে দাঁড়ালেন৷ নিজের পরিচয় দিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের এক সিপিএম সমর্থক হিসাবে৷ বইটা হাতে নিয়ে একটু যেন থমকে দাঁড়িয়ে ভাবলেন কিছু, তারপর বললেন, আমি অন্য দল করি কিন্তু মনে করি বামপন্থী রাজনীতিতে এসইউসিআই(সি)একটা বিশিষ্ট মর্যাদার দাবি রাখে৷ বামপন্থার ঝান্ডাটা আপনারাই শেষ পর্যন্ত তুলে ধরে আছেন৷ বইয়ের সাথে গণদাবীর ৭১ বর্ষ, ৩১ সংখ্যাটিও নিলেন৷ ওই সংখ্যায় সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের সাংবাদিক সম্মেলনের বক্তব্যের সাথে ছাপা হয়েছিল তাঁর একটি ছবি৷ স্ত্রী কাগজটা ভাঁজ করে ব্যাগে ঢোকাতে যেতে বাধা দিয়ে বললেন, দাঁড়াও ভাল করে একটু মুখটা দেখি৷ বহুক্ষণ তাকিয়ে আছেন ছবির দিকে, অস্ফূটে বলছেন শোনা গেল– ভরসা লাগে৷ সিপিএম হয়ত তোমাদের থেকে ভোট বেশি পাবে, দু–চারটে সিটও পেতে পারে, কিন্তু এখন বামপন্থার ভরসা তোমরাই৷
সেই সুন্দরবনের কোলে পাথরপ্রতিমার গ্রাম থেকে কলকাতায় রঙের কাজ করতে এসে সরশুনাতে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকা এক শ্রমিকের মুখেও সেই একই কথা৷ গড়িয়াহাটে সিগন্যালে থামা মিনিবাসের ড্রাইভার–কন্ডাক্টর–, রবিবারের হরিসাহা হাটের হকার, খান্না মোড়ের বাসড্রাইভার নিজের থেকে ডেকে চেয়ে নিয়েছেন বই৷ এমন দৃশ্য দেখা যাচ্ছে বহু জায়গায়৷
কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশক থেকে শুরু করে ঠনঠনিয়ার বাসিন্দা চাকুরিজীবী প্রত্যেকের মুখ থেকেই শোনা কথাগুলির নির্যাস এক– এই রাজনীতিটাকে বড় করে তোলাটাই আজ সবচেয়ে জরুরি কাজ৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার আশেপাশে দলের কাজে নিযুক্ত এক এসইউসিআই(সি) কর্মীকে এক প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার বলে দিয়েছেন, ‘তোমরা জিতবে কি জিতবে না, সেটা বড় কথা নয়৷ বড় কথা হল তোমাদের এই রাজনীতির শক্তিটাকে বাড়ানো৷ এটাই আজ আমাদের সকলের কর্তব্য৷’
বাঁকুড়ার সোনামুখির এক অঙ্কের অধ্যাপক বলেছেন তাঁর নিজস্ব অঙ্কের ভাষায়৷ বই কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন সকালে, পড়ে শেষ করার পর রাত ১১টায় ফোন করেছেন দলের এক সংগঠককে৷ বললেন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি– ‘‘আমি অঙ্ক শেখাতে ক্লাসে ছাত্রদের বলি ‘নানা মুনির নানা মত, অঙ্কের কিন্তু সোজা পথ’ অর্থাৎ অঙ্ক কারও মুখ দেখে চলে না৷ সোজা সাপ্ঢা সত্যটাই তুলে ধরে৷ আপনাদের বইও অন্য সব কথাকে চাপা দিয়ে সত্য কথাটা সোজা ভাবে বলে দিয়েছে৷ এটাই সঠিক কথা৷ তিনি আরও বই চেয়ে পাঠিয়েছেন, অন্যদের দেওয়ার জন্য৷ বাঁকুড়ার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মী রাস্তা থেকে বই নিয়ে গিয়ে পড়েছিলেন৷ পরদিন ডেকে পাঠিয়েছেন দলের এক পরিচিত সংগঠককে৷ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁর ব্যাঙ্কের সমস্ত সহকর্মীদের বই দিয়েছেন৷
কলকাতার টালিগঞ্জ এলাকার এক প্রাক্তন সিপিএম সমর্থকের কথায়– প্রকৃত বামপন্থী না হলে কেউ এমন কথা লিখতে পারে না৷ রাজারহাটের বাসিন্দা এক উচ্চপদস্থ ইঞ্জিনিয়ার নিজে বইটি পড়ার পর আরও ১০০ কপি চেয়ে পাঠিয়েছেন৷ বলেছেন, ‘পরিচিত সকলকে দেব’৷ তিনি ছাত্রাবস্থা থেকে সিপিআই–সিপিএম রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকেছেন৷ ছাত্রজীবনে শুনেছিলেন, বামপন্থী রাজনীতিকে উচ্চ–আদর্শের তারে বাঁধতে কমরেড শিবদাস ঘোষের সংগ্রামের কথা৷ একদিন কৌতুহলী হয়ে কমরেড শিবদাস ঘোষ যেখানে থাকতেন সেই টালা কমিউন দেখতে চলেও গিয়েছিলেন৷ সঠিক বামপন্থী আদর্শের খোঁজ করেছেন সারা জীবন৷ আশা ছিল ভুল বুঝে সিপিএম আবার বামপন্থার পথে ফিরবে৷ আজ বুঝছেন তা সম্ভব নয়৷ তাই প্রকৃত বামপন্থার খোঁজ করতে গিয়ে নতুন করে সন্ধান করছেন এস ইউ সি আই (সি)–র আদর্শকে৷
৬ এপ্রিল সরশুনাতে বাইক থামিয়ে অনেকক্ষণ মাইকের প্রচারের কথা শুনছিলেন এক যুবক৷ কিছুক্ষণ পর গিয়ে দাঁড়ালেন টেবিলে বসা কর্মীদের সামনে৷ ‘আপনারা যা বলছেন, তা সত্যিই ভিতর থেকে বলছেন? এমন করে ভাবেন আপনারা? এই নির্বাচনী ব্যবস্থায় বামপন্থীরা যেভাবে হোক কিছু সিট বেশি পেলেই বামপন্থী আন্দোলনের কোনও লাভ হবে কি? এ আমারও প্রশ্ন৷ সিটের লোভে আদর্শ বিসর্জন দিলে মানুষের জন্য কিছুই করা যাবে না৷ এ কখনও বামপন্থার লক্ষ্য হতে পারে’ পরিচয় দিয়ে জানালেন, তিনি মধ্য কলকাতার এক ওয়ার্ডের সিপিএমের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআইয়ের সম্পাদক৷ সিপিএমকে আর বামপন্থী বলতে মন চাইছে না৷ বই নিয়েছেন, ফোন নম্বর ঠিকানা দিয়ে যোগাযোগ করতে বলে গেছেন৷ ওই সরশুনাতেই দাঁড়িয়ে প্রচারের কথাগুলি শুনছিলেন আরেক যুবক৷ এগিয়ে এসে বললেন, ‘মদ নিষিদ্ধ করার দাবি তুলছে কোনও রাজনৈতিক দল, তা আগে শুনিনি৷’ বলেছেন, আপনাদের সাথে থাকব৷
একটি অনন্য অভিজ্ঞতার স্বাদ পেলেন বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে প্রচার এবং বই বিক্রির কাজে মগ্ন কিছু ছাত্র–ছাত্রী কর্মী৷ ৫ এপ্রিল সারা দিন ধরে প্রচার করছিলেন তাঁরা৷ সন্ধ্যার শুরুর দিকেই এসে দাঁড়ালেন এক প্রৌঢ়া৷ বই নিলেন, কিন্তু প্রশ্ন তোমরা কী পাচ্ছ? অল্পবয়সী ছাত্রীটি মিষ্টি হেসে উত্তর দিয়েছে– আদর্শের স্বাদ, একটা মর্যাদাময় জীবনের স্বপ্ন, এ কি কম পাওয়া কাকিমা প্রৌঢ়ার কৌতূহল গেল বেড়ে, জনে জনে জিজ্ঞাসা করছেন, কী পাবে তুমি? কত বেশি, কত বড় সেই পাওনা, যার জন্য শরীরপাত করে, ক্লান্ত দেহেও তোমাদের বিরাম নেই? এবার এগিয়ে এল আর একটি মেয়ে, মানুষের মতো মাথা উঁচু করে বাঁচবার পথ পাব বলে এই রাজনীতিতে এসেছি, বলুন আর কত বেশি চাইব? এর থেকে বড় কী চাইতে পারি? আর কোনও পথ কি তা আমায় দিতে পারত?
একটু চুপ থেকে প্রৌঢ়ার অনুরোধ, তোমাদের এই কথাগুলি ভিডিওতে তুলতে চাই৷ আবার বলবে? এবার অবাক হওয়ার পালা দলের কর্মীদের৷ কেন? বললেন, আমার শ্বশুর মশাইকে দেখাব৷ তাঁর ৯০ বছর বয়স, এক সময় জ্যোতি বসুর সাথে রাজনীতি করেছেন৷ বামপন্থী রাজনীতির অবক্ষয় দেখে খুবই ব্যথা পান৷ আজকের ছেলেমেয়েরা এমন করে আদর্শের কথা বলছে শুনলে উনি শেষ বয়সে একটু শান্তি পাবেন৷ তাঁকে এই উপহারটুকু তোমাদের মাধ্যমে দিতে চাই৷
তুললেন প্রচারের ভিডিও৷ কয়েকজন কর্মীর বক্তব্য রেকর্ড করলেন৷ এদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ–ডিগ্রির অধিকারী হয়েও কেরিয়ারের বদলে সর্বক্ষণের রাজনীতির পথই বেছে নিয়েছে শুনে তাঁর চোখে মুখে অদ্ভুত তৃপ্তি৷ যাবার সময় বলছেন, আমার ছেলে বিদেশে থাকে৷ স্বামীর সাথে আমিও মুম্বইয়ের বাসিন্দা৷ কলকাতায় এসেছি বৃদ্ধ শ্বশুরমশাইয়ের কিছুদিন দেখভাল করার জন্য৷ এখান থেকে যা নিয়ে গেলাম তা শুধু তাঁকে দেখাব তাই নয়, ছেলেকে আর স্বামীকে পাঠিয়ে দিচ্ছি৷ তিনি যেন বলতে চান– দেখ এমন ছেলে মেয়েরাও এদেশেই জন্মায়৷ সমস্যা ওদের হার মানাতে পারে না৷ ওদের এই মহৎ স্বপ্ন দেশটাকে বড় করবেই একদিন৷ বলে গেলেন, ‘ভরসা পেলাম’৷