প্রাণ হাতে যাত্রাই প্রাপ্তি রেলযাত্রীদের

বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম রেলওয়ে নেটওয়ার্কের নাম ভারতীয় রেল৷ তার মন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বলছেন, রেলমন্ত্রী হিসাবে তিনি প্রতি রাতে শুতে যাবার আগে প্রার্থনা করেন যেন কোনও রেলব্রিজ ভেঙে না পড়ে৷

কারণ বহু রেলব্রিজই অনেক পুরনো৷ নরেন্দ্র মোদির ‘ডিজিটাল ভারতের’ ‘আধুনিক’ রেল ব্যবস্থা থেকে এই দুঃস্বপ্নই প্রাপ্তি দেশের মানুষের ১১ জুলাই সংসদে রেল বাজেট সংক্রান্ত বিতর্কের উত্তরে রেলমন্ত্রী এমনই ‘সুরক্ষিত রেলযাত্রার’ আশ্বাস দিয়েছেন৷

অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বাজেট পেশ করার সময়েই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, রেলের বেসরকারিকরণই এখন মোদি সরকারের পাখির চোখ৷ এই সরকার ২০১৪ থেকেই রেলের আলাদা কোনও বাজেট পেশ করছে না, সাধারণ বাজেটেই রেলের বিষয়টি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ এবারের বাজেটকে ঘিরে চূড়ান্ত শঠতা এবং ধূর্তামির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে৷ একদিকে অর্থমন্ত্রী বলছেন, বেসরকারিকরণই লক্ষ্য৷ অন্যদিকে রেলমন্ত্রী তাঁর দপ্তর সংক্রান্ত বিতর্কের জবাবে জানিয়ে দিয়েছেন ‘কোনও বেসরকারিকরণ হচ্ছে না’৷ অবস্থা এমন, এই সরকারের কে ঠিক বলছে তা জানার জন্য রীতিমতো গোয়েন্দা নিয়োগ করতে হবে!

নরেন্দ্র মোদি সরকার দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় বসেই ১০০ দিনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে বলেছিল, এই সময়ের মধ্যেই দেশের শতাব্দী–রাজধানী এক্সপ্রেসের মতো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনকে বেসরকারি হাতে দেওয়া হবে৷ বাজেটে সরকার জানিয়ে দিয়েছে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ রেল কারখানাকে কর্পোরেট কোম্পানিতে রূপান্তরিত করা হবে৷ ইতিমধ্যেই চেন্নাইয়ের ঐতিহ্যপূর্ণ ইন্টিগ্রাল কোচ ফ্যাক্টরিতে ‘বন্দে ভারত’ এক্সপ্রেসের জন্য বিশ্ব মানের কোচ তৈরির অর্ডার সরকার স্থগিত করে দিয়ে বেসরকারি কিছু কোম্পানির সাথে বৈঠক করেছে৷ যাতে রেলকোচ তৈরির দায়িত্ব বেসরকারি হাতেই তুলে দেওয়া যায়৷ ভারতীয় রেলশ্রমিক এবং ইঞ্জিনিয়াররা ঘাম ঝরিয়ে রেল কারখানাগুলিতে যে সমস্ত রেল কামরা এবং ইঞ্জিন তৈরি করেন তা সস্তা এবং উন্নত হওয়ায় বিদেশে সেগুলির ভালই বাজার আছে৷ বেসরকারি মালিকদের এই বাজারটি ধরিয়ে দেওয়ার জন্যই সরকার কারখানাগুলিকে কর্পোরেট কোম্পানিতে পরিণত করে পিপিপি মডেল চাইছে৷ রেলমন্ত্রী বলেছেন, আধুনিক সিগন্যালিং থেকে নতুন লাইন পাতা বা বৈদ্যুতিকীকরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ সব কাজগুলিই হবে বেসরকারি কোম্পানির সাথে হাত মিলিয়ে পিপিপি মডেলে৷ গত বছরের বাজেটেই মোদি সরকার ২৩টি গুরুত্বপূর্ণ রেল স্টেশনকে বেসরকারি হাতে দিয়ে দেওয়া এবং রেলের শতাধিক বছরের পুরনো নিজস্ব প্রেস তুলে দিয়ে টিকিট ছাপা থেকে শুরু করে সমস্ত স্টেশনারি ছাপার কাজ বেসরকারি হাতে দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ ফলে যাত্রীদের সুরক্ষা নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে৷ এর সাথে মিলিয়ে রেলে খাবার পরিবেশন থেকে শুরু করে যাত্রী পরিষেবার প্রায় সবটুকু তুলে দেওয়া হবে বেসরকারি হাতেই৷ রেলের হাতে থাকা জমি বেচে ২৫ হাজার কোটি টাকা নাকি সরকার জোগাড় করেছে৷ সে জমি তো দেশের মানুষের সম্পদ, তা বেসরকারি মালিকদের হাতে সরকার দিয়ে দিল কার স্বার্থে? এখানে কাটমানির কারবারটিও সাধারণ মানুষের জানা৷ রেলমন্ত্রী বলেছেন ২০৩০–এর মধ্যে ৫০ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ বেসরকারি মালিকদের হাত ধরেই আসবে৷ তার জন্য এই মালিকদের বিপুল লাভের ব্যবস্থাও সরকারকে করে দিতে হবে৷ তাহলে বেসরকারিকরণ হচ্ছে না বলে রেলমন্ত্রী সংসদকে ডাহা মিথ্যাটি বললেন কেন?

ইতিমধ্যেই ‘প্রিমিয়াম তৎকাল’, ‘সুবিধা’ ইত্যাদির নামে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে লাগামছাড়া হারে৷ আগে কালোবাজারিরা মানুষের জরুরি প্রয়োজনে শেষ মুহূর্তে টিকিট কাটার নিরুপায় অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে বাড়তি টাকা রোজগার করত যে পথে, সরকারও একই ভাবে যাত্রীদের সাথে কালোবাজারিদের মতোই আচরণ করছে৷ তার উপর গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনগুলির দায়িত্ব ধীরে ধীরে বেসরকারি হাতে ছাড়ার সাথে তাদের হাতে পরিষেবা খরচের নামে টাকা আদায়ের ক্ষমতাও দেওয়া শুরু হয়েছে৷ এরপর ধরেই নেওয়া যায় তা আরও বিস্তৃত হবে৷ রেলমন্ত্রী যেটা বলেননি, রেল কোম্পানি ইতিমধ্যেই ঘুরপথে বিপুল ভাড়াবৃদ্ধির ব্যবস্থা করে রেখেছে আর এক ফন্দিতে৷ টিকিট কাটার সময়েই রিকুইজিশন ফর্মে জানতে চাওয়া হচ্ছে বর্ষীয়ান নাগরিকরা তাঁদের কনসেশন ছেড়ে দিতে রাজি আছেন কি না অন্য যাত্রীদেরও ‘ভর্তুকি’ ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানানো হচ্ছে ইন্টারনেট বা কাউন্টার টিকিটের ফরমে৷ যাঁরা এতে রাজি হবেন, তাঁদের রিজার্ভেশনে রেল অগ্রাধিকার দেবে৷ ভাবখানা এমন যে সরকার যেন ভর্তুকি দিয়ে রেল চালাচ্ছে বাস্তবটা কী? এবারের রেল বাজেটে সরকার দেখিয়েছে গত আর্থিক বছরে রেলের মোট আয় ১ লক্ষ ৯৭ হাজার ২১৪ কোটি টাকা এবং খরচ ১ লক্ষ ৯১ হাজার ২০০ কোটি টাকা৷ অর্থাৎ নেট লাভ ৬ হাজার ১৪ কোটি টাকা৷ বাজেটের হিসাব দেখিয়েছে প্রতি ১০০ টাকা আয়ে রেলের খরচ ৯৬.২ টাকা (ইন্ডিয়ান রেলওয়েস ডট গভ ডট ইন)৷ এই আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশ আসে মালগাড়িতে পণ্য পরিবহণ থেকে৷ সেক্ষেত্রে আগে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলির মাশুলে রেল যে ছাড় দিত এখন তা প্রায় উঠে গেছে৷ রেলে পণ্য পরিবহণ দিন দিন অতি দামী এবং ঝামেলার হয়ে ওঠার ফলে রেলে পণ্য চলাচল এমনিতেই কমছে৷ একমাত্র কয়লা, খনিজ আকরিক ইত্যাদি কিছু পণ্য ছাড়া বাকি সবকিছুতে সড়ক পরিবহণই বেশি বাড়ছে৷ যেটুকু ভোগ্যপণ্য বা কৃষিপণ্য রেলে যায় তার বেশিরভাগ অংশটাই এখন প্রাইভেট কুরিয়ার কোম্পানি, বহুজাতিক খুচরো ব্যবসার চেনের মালিক ইত্যাদিদের হাতে লিজে তুলে দিয়েছে রেল৷ এর ফলে একদিকে যেমন পণ্য পরিবহণে খরচ বেড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে, অন্যদিকে রেলকর্মচারী নিয়োগ কমছে৷ সমস্ত দিক থেকেই আক্রমণটা এসেছে সাধারণ মানুষের উপরই৷ যাত্রী খাতেও রেল কোনও ভর্তুকি দেয় না৷ এসি প্রথম শ্রেণি থেকে এসি চেয়ার কারের মতো উচ্চশ্রেণির ক্ষেত্রে ভর্তুকি তো দূরের কথা মাঝে মাঝে ‘প্রিমিয়াম তৎকালের’ জেরে এর ভাড়া বিমান ভাড়াকে ছাপিয়ে যাচ্ছে৷ সাধারণ স্লিপার শ্রেণির জন্যও নানা অজুহাতে বাড়তি ভাড়া চাপিয়ে দিয়ে রেল যথেষ্ট লাভ করছে৷  এখন মেল–এক্সপ্রেস ট্রেনগুলিতে দ্বিতীয় শ্রেণির সাধারণ কামরা কমতে কমতে প্রায় বিরল হয়ে উঠেছে৷ সেই সব কামরায় মানুষকে যেভাবে গাদাগাদি করে যাতায়াত করতে হয়, তাতে এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, সরকার তথা রেল কর্তৃপক্ষ এঁদের আদৌ মানুষ বলে গণ্য করেন কি না শহরতলির ট্রেনে ডেইলি টিকিট এবং মান্থলি টিকিটে ক্রশ সাবসিডি বা এক জায়গার লাভ থেকে অন্য জায়গায় ভর্তুকি দেওয়ার কথা রেল বলে থাকে৷ এ ক্ষেত্রে কোনও জনমুখী সরকারের কী দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত? এ দেশের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ শহরতলির ট্রেনে করে কর্মক্ষেত্রে যান, মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় সবজি, মাছ ইত্যাদি এই লোকাল ট্রেনে স্থানীয় বাজার থেকে শহরে পৌঁছায়৷ লোকাল ট্রেনে সহজে এবং কিছুটা সস্তায় এই শ্রমজীবী মানুষ যাতায়াত করতে না পারলে গ্রাম–শহরের অর্থনীতিই ভেঙে পড়বে৷ শহর তার কাজের লোক পাবে না৷ মানুষের রোজগার কমে বাজারের সংকট আরও বাড়বে৷ এই পরিস্থিতিতে যে কোনও জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রে সরকারের কর্তব্য শহরতলির রেল, মেট্রো রেলের মতো পরিষেবা যথাসম্ভব সস্তা, দ্রুত করে তোলা এবং যাত্রীস্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করা, যাতে যাতায়াত করতে গিয়েই শ্রমজীবী মানুষের প্রাণশক্তি নিঃশেষিত হয়ে না যায়৷ বিজেপি সরকারের রেলবাজেটের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক এর বিপরীত৷

যাত্রী সুরক্ষার অবস্থা কী? রেলমন্ত্রী তো রাত্রে প্রার্থনা করেই খালাস৷ কিন্তু রেলযাত্রা যে আক্ষরিক অর্থেই প্রাণ হাতে করে যাত্রা হয়ে উঠেছে তা সাধারণ রেলযাত্রী মাত্রেই জানেন৷ মন্ত্রীমশাই পরিসংখ্যান দিয়ে বলেছেন, বিগত বছরে রেল অ্যাক্সিডেন্ট কমে বছরে মাত্র ১০০টিতে দাঁড়িয়েছে৷ মন্ত্রীমশাই এই হিসাব নিয়ে সুখে থাকতে পারেন, কারণ তাঁকে তো আর ট্রেনে যাতায়াত করতে হয় না৷ এবারের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় সরকার দেখিয়েছে ২০১৮তে একটিও সংঘর্ষ হয়নি৷ অথচ এই সময়ের মধ্যেই যে একাধিক ট্রেন বেলাইন হয়ে শতাধিক যাত্রীর মৃত্যু ঘটেছে তা চেপে গেছে সরকার৷ রেলের লাইন পেরোতে গিয়ে, বা অরক্ষিত লেভেল ক্রশিংয়ে গত তিন বছরে ৫০ হাজার লোকের মৃত্যু হয়েছে (নিউজ ১৮, অক্টোবর ২৩, ২০১৮)৷ ১৬০০–র বেশি মানুষ রেলভ্রমণকালে অসুস্থ হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন৷ সরকার এগুলি উল্লেখই করেনি৷ রেলকামরায় ডাকাতি, চুরি, পকেটমারি, মহিলাদের শ্লীলতাহানি কত হয়েছে সে তথ্য সরকার দিচ্ছে না৷ যদিও যাত্রীদের অভিজ্ঞতা বলছে এসব বেড়েছে মারাত্মকভাবে৷ অর্থাৎ পুরো দৃষ্টিভঙ্গিটাই অস্বচ্ছতা এবং শঠতায় ভরা৷ রেলমন্ত্রী ৫ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা রেলসুরক্ষা খাতে বরাদ্দের কথা বলেছেন৷ অথচ তিনি উল্লেখ করলেন না যে, ২০১৭ সালে অরুণ জেটলির বাজেটে ১ লক্ষ কোটি টাকা এবং ২০১৮তে নতুন করে যে ২০ হাজার কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় রেল সুরক্ষা তহবিল জনগণের ঘাড় ভেঙে তোলার কথা বলা হয়েছিল সে টাকা কোথায় গেছে? কার সুরক্ষায় লেগেছে সে টাকা?

রেলের ১৪ লক্ষ কর্মচারী, তাঁদের পরিবারের প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষের ভবিষ্যৎও আজ মারাত্মক বিপদের মধ্যে পড়েছে৷ এ দেশে রেলব্যবস্থাকে বিশ্বমানের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার যে দাবি সরকার করছে, তার যতটুকু বাস্তবে হয়েছে, সে কাজ করেছেন কারা? রেলের এই কর্মচারীরাই তো অথচ তাঁদের বিদায় দিয়ে চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী কর্মচারী এবং বেসরকারি কন্ট্রাক্টররাই এখন সরকারের ভরসা৷ তাদের দায়বদ্ধতা কোথায়? আমাদের দেশে সড়ক নির্মাণে এই কন্ট্রাক্টর প্রথা এবং তার নিম্নমান কি কোনও অজানা বিষয়? বহুজাতিক যে কোম্পানিগুলি রেলের জমিকে কাজে লাগিয়ে অপটিক্যাল ফাইবার কেবল কিংবা শপিং মলে বিনিয়োগ করবে তাদেরও দায়বদ্ধতা থাকার কোনও প্রশ্নই নেই৷ তারা টাকা ঢালবে, লাভ তুলে নিয়ে পাততাড়ি গোটাবে৷ বিপন্ন হবে দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থ৷

বিজেপি সরকারের শঠতাপূর্ণ রেল বাজেট থেকে একমাত্র এই বিপন্নতাই প্রাপ্তি হয়েছে মানুষের৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা)