২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গুজরাটের গোধরায় একটি যাত্রীবাহী ট্রেনে রহস্যজনক অগ্নিসংযোগের ঘটনায় অযোধ্যা ফেরত ৫৯ জন করসেবকের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার পরপরই গুজরাট জুড়ে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড শুরু হয়৷ সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর শুরু হয় অবর্ণনীয় হামলা৷ যা গণহত্যা নামে আন্তর্জাতিক স্তরে কুখ্যাতি লাভ করে৷ এই সাম্প্রদায়িক গণহত্যার পরেই তদন্তের উদ্দেশ্যে কমিশন ঘোষণা করে সরকার৷
২০০২ সালে ৬ মার্চ সরকারি ঘোষণার দ্বারা নিযুক্ত করা হয় সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নানাবতীর নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন৷ ইতিমধ্যে বহু বেসরকারি তদন্ত ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যে প্রকাশ পেয়েছে কীভাবে পরিকল্পনা করে হত্যা করা হয়েছে গুজরাটের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের৷ পুলিশ অফিসারদের মুখ থেকে প্রকাশ পায় কীভাবে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অঙ্গুলিহেলনে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রেখে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল৷
ঘটনার ১৭ বছর পর গত ১১ ডিসেম্বর গুজরাটের বর্তমান বিজেপি সরকার বিধানসভায় রিপোর্টটি পেশ করেছে৷ যে মুখ্যমন্ত্রী মোদির বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ ছিল, তিনি বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী৷ সর্বোপরি এমন একটা পরিস্থিতি ও পরিবেশে রিপোর্ট প্রকাশ করা হল, যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহরা সুপ্রিম কোর্ট, প্রশাসন সহ সমস্ত কিছুকে কুক্ষিগত করে দেশজুড়ে হিন্দুত্ববাদের স্টিমরোলার চালাচ্ছে৷ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ৩৭০ ধারা বিলোপ, অযোধ্যা রায় বা এনআরসি–ক্যাব প্রভৃতির মধ্য দিয়ে বিভেদ সৃষ্টি করে মানুষের মৌলিক অধিকারগুলিকে শুধু পিষে মারাই নয়, সমগ্র দেশকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করার হীন ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে৷ এই পরিবেশেই বিচারের নীতিকে ছাপিয়ে উঠেছে ধর্মবিশ্বাস৷ অযোধ্যা রায়ে উল্লসিত হিন্দুত্ববাদীরা৷ এই প্রেক্ষাপটে কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত থেকেই পরিষ্কার, রায় কী হতে পারে৷ ঠিক তাই দেখা গেল৷ নরেন্দ্র মোদিকে পুরো নির্দোষ ঘোষণা করা হল৷
এতবড় একটা হত্যাকাণ্ড ঘটল, এক হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হল– যাদের বেশিরভাগই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত– সেখানে সরকারের ভূমিকা কী ছিল তা একটা সঙ্গত প্রশ্ন৷ অথচ এর সঠিক উত্তর সামনে না এনে, এর সমস্ত দায় স্থানীয় কিছু পুলিশ অফিসারের উপর চাপিয়ে সরকার ও তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকে ‘ক্লিনচিট’ দেওয়া হল কমিশনের রিপোর্টে৷ তৎকালীন তিন আইপিএস অফিসার সঞ্জীব ভাট, রাহুল শর্মা ও আর বি শেখরকুমার কমিশনে যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তাতে এই দাঙ্গার সাথে সরকারি মন্ত্রী ও কর্তাব্যক্তিদের সম্পূর্ণরূপে অবহিত থাকার বিষয়টি বার বার সামনে এসেছে৷ কমিশন এই তিন জনের রিপোর্টকেই উদ্দেশ্যমূলক বলে বাতিল করে দিয়েছে৷
ঘটনায় হত্যা করা হয় এহসান জাফরি নামে কংগ্রেসের এক প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে৷ তিনি যে ঘটনার পূর্বেই আশঙ্কিত অবস্থায় নরেন্দ্র মোদির দ্বারস্থ হয়েছিলেন, সেই বিষয়টিও জাফরির স্ত্রীর বয়ানে সামনে আসে৷ কমিশন এই বিষয়গুলিকেও নস্যাৎ করে দিয়েছে৷ শুধুমাত্র তৎকালীন জেসিপি, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত এ কে ট্যান্ডনের বিরুদ্ধে কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগ আনা হয়েছে৷ শ্রী ট্যান্ডন ঘটনা শুরুর ঠিক আগে এলাকা ছেড়ে চলে যান এবং শেষে ফিরে আসেন– ফলে তিনি যথাযথ ভূমিকা নিতে পারেননি৷ ট্যান্ডন কি নিজেই এলাকা ছেড়ে চলে যান, নাকি কারও নির্দেশ ছিল– সেই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য দেওয়া হয়নি৷
এই প্রেক্ষাপটে উল্লেখযোগ্য, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, বিজেপির শীর্ষ নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ীর উক্তি৷ গুজরাটে মোদিকে পাশে বসিয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাজপেয়ী বলেছিলেন, সরকারকে রাজধর্ম পালন করতে হবে৷ ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে দেশের মানুষকে রক্ষা করতে হবে৷ এ কথা স্পষ্ট ছিল যে, মোদির উদ্দেশেই প্রধানমন্ত্রী সেদিন এ কথা বলেন৷ কেন বলেছিলেন বোঝাই যায়৷ রাজধর্ম পালনে অবহেলা সত্ত্বেও নানাবতী কমিশন তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রীর কোনও দায় খুঁজে পেল না, এটাই বিস্ময়কর৷
আজ, দেশ জুড়ে যখন ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবেশকে ধ্বংস করার দক্ষযজ্ঞ চলছে, তখন নানাবতী কমিশনের এই রায় নিয়ে খুব বেশি হইচই হয়ত হবে না বরং নরেন্দ্র মোদি–অমিত শাহদের আরও মসীহা করে তুলবে৷ কিন্তু ইতিহাস একদিন জবাব চাইবেই৷