প্রত্যাশার ব্রিগেড সম্ভাবনার ব্রিগেড (পাঠকের মতামত)

 

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্রিগেড সমাবেশকে কেন্দ্র করে শেষ কয়েক দিন ধরে যারা শহর কলকাতায় উপস্থিত হতে শুরু করেছিলেন দলের পক্ষ থেকে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল শহরের বিভিন্ন প্রান্তে। এদের মধ্যে দক্ষিণ ভারত থেকে আসা কর্মী, সমর্থক, নেতৃত্বের থাকার ব্যবস্থা হয় দক্ষিণ কলকাতার উত্তীর্ণ সভাগৃহে। আমি এবং আমার অফিসের কয়েকজন বন্ধু স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে উপস্থিত ছিলাম সেখানে। আমার জন্য এই অভিজ্ঞতা ছিল সম্পূর্ণ নতুন। এর আগে কোনও রাজনৈতিক দলের ক্যাম্পে থাকার সুযোগ এবং ইচ্ছে কোনওটাই আমার হয়নি। আমার বন্ধুদের জন্যও এই অভিজ্ঞতা ছিল নতুন।

এ প্রসঙ্গে আর একটি কথা না বললেই নয়। আমার এই বন্ধুরা যে আমাদের দলের আদর্শের প্রতি অনুরক্ত এমনটা একেবারেই নয়। বরং সবাই অন্য রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তারা এসেছিল আমার বিশেষ অনুরোধে। এদের মধ্যে একজন আবার ঘোরতর হিন্দুত্ববাদী। এক সময় কলকাতায় একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজও করেছে। সব মিলিয়ে বন্ধুদের নিয়ে আমি বেশ কিছুটা দ্বিধা, দ্বন্দ্ব এবং সংশয়ের মধ্যে ছিলাম। এমনও ভেবেছিলাম ওরা হয়তো কয়েক ঘণ্টা পরেই ক্যাম্প ছেড়ে চলে যেতে চাইবে। বাস্তবে ঘটল ঠিক উল্টো। ক্যাম্প ছেড়ে চলে যাওয়া দূরের কথা, ওরা সবার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছে। ক্যাম্পের সমস্ত অনুশাসন মেনে চলেছে, নেতৃত্বের নির্দেশ পালন করেছে।

ব্রিগেড সমাবেশ শেষে আমি যখন আমার হিন্দুত্ববাদী বন্ধুটির কাছে জানতে চাইলাম তাঁর উপলব্ধির কথা। সে জানাল, কিশোর বয়স থেকে বিভিন্ন বামপন্থী দলকে সে যতটুকু দেখার সুযোগ পেয়েছে, মাঠে ময়দানে তাদের বত্তৃতা, আলোচনা শুনেছে, টিভিতে, খবরের কাগজে তাদের কথা জেনেছে, পড়েছে তাতে বামপন্থী দলগুলোর প্রতি তার মনে ঘৃণা ও বিদ্বেষই জন্মেছে। কিন্তু এই প্রথমবার সে তার আগের অবস্থান থেকে বেশ কিছুটা সরে আসতে বাধ্য হচ্ছে। তাঁর নিজের কথায়– লাল পতাকা হাতে নিলেই যে সবাই এক নয় এটা তার প্রথম বার মনে হচ্ছে। তার মনে হয়েছে এসইউসিআই দল অন্য বামপন্থী দলগুলোর থেকে অনেক আলাদা, এরা সত্যিকার লড়াই-আন্দোলনে থাকা দল। শিবিরে উপস্থিত নেতৃত্বের সহজ সরল ব্যবহার, আর পাঁচজন সাধারণ সমর্থকের মতো নেতৃত্বের থাকা খাওয়ার আয়োজন তাকে শুধু মুগ্ধ করেনি, বামপন্থী আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। ব্রিগেডে সাধারণ সম্পাদকের বত্তৃতা শুনে মনে হয়েছে এসইউসিআই ভোটের দল নয়, তা না হলে শিয়রে লোকসভা ভোট থাকা সত্ত্বেও কেউ হাজার হাজার কর্মী সমর্থককে ভোটের কথা না বলে পুঁজিবাদী শাসক শ্রেণির উচ্ছেদের কথা বলে, গণআন্দোলনকে শক্তিশালী করার কথা বলে। এমনটা নয় যে আমার এই বন্ধু ৫ আগস্টের পর থেকেই বামপন্থী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হয়ে উঠবে, তবে একজন সক্রিয় হিন্দুত্ববাদী কর্মী, ঘোরতর বামপন্থা বিরোধী মানুষ যে কিছুটা হলেও বামপন্থার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে এটা একটা বড় প্রাপ্তি।

আমার আর এক বন্ধু, যে বয়সে আমার থেকে অনেকটাই বড, যার বয়স পঞ্চাশের বেশি, শিবিরে উপস্থিত নেতৃত্ব, কর্মী সমর্থকদের সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবন দেখে সে তাঁর নিজের ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ করেছে। তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে আসামের দরং জেলার চা বাগানে। বাবা ছিলেন চা বাগানে কর্মরত এবং একজন সৎ বামপন্থী কর্মী। এসইউসিআই দলের নেতা কর্মীদের দেখে তাঁর বার বার নিজের বাবার কথা মনে পড়েছে। কথা প্রসঙ্গে আমাকে জানিয়েছেন ইদানিং কালে এসইউসিআই দল ছাড়া অন্য কোনও রাজনৈতিক দলে এমন সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবনে অভ্যস্ত রাজনৈতিক নেতা, কর্মী সে দেখেনি। তার মনে হয়েছে পারলে এই দলটাই পারে সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করতে। সেই সাথে এটাও জানিয়েছে যে এই ধরনের সমাবেশ সে প্রথম দেখল যেখানে নেতাদের বত্তৃতায় কোনও প্রতিশ্রুতি নেই, কোনও চমক ধমক নেই। ভোটে জিতে ক্ষমতায় এলে কী কী করবে এমন কথাও নেই। যা বলা হয়েছে তাতে দেশের বর্তমান আর্থ সামাজিক অবস্থার কথাই ফুটে উঠেছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সামগ্রিক অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবই মানুষের শোষণমুক্তির একমাত্র পথ সে কথা বলা হয়েছে। এমন ধারার কথা তথাকথিত বামপন্থী দলগুলোর বত্তৃতায় আজ আর তেমন একটা শোনা যায় না– এ কথাই তার বার বার মনে হয়েছে। তাই একদিকে সে যেমন অবাক হয়েছে আবার অন্যান্য দলগুলোর থেকে এসইউসিআই দলের পার্থক্য তার চোখের সামনে ফুটে উঠেছে। সাথে সাথে তাঁর মনে এই প্রশ্নও এসেছে– কেন এই দলের খবর সংবাদপত্রের পাতায়, টিভির পর্দায় আসে না। সম্ভবত এই প্রশ্ন শুধু আমার বন্ধুটির নয় আরও অসংখ্য মানুষের। এ ভাবেই অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন জাগিয়ে, সম্ভাবনা আর প্রত্যাশার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে ৫ আগস্টের ব্রিগেড সমাবেশ।

জিশু সামন্ত

খানাকুল, হুগলি