দেশে মহিলা ভোটার কমবেশি ৫০ শতাংশ৷ এদের ভোট পাওয়ার জন্য সংসদীয় দলগুলি মহিলাদের ক্ষমতায়নের কথা বলছে৷ বিজেপি, কংগ্রেস উভয় দলই পার্লামেন্টে মহিলাদের জন্য ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে৷ যদিও এই দুই দলের কেউই নিজেদের প্রার্থী তালিকায় মহিলাদের জন্য ৩৩ শতাংশ আসন বরাদ্দ করেনি৷ বহু ক্ষেত্রেই দলীয় নেতাদের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য প্রার্থী হিসাবে মহিলারা বিবেচিত হন না৷ আবার পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতে আজও মহিলাদের দুর্বল হিসাবে ভাবার, দেখার মানসিকতা রয়েছে৷ যে কারণে নারীর ক্ষমতায়নের দাবিও উঠেছে৷ প্রশ্ন হল, ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করে দিলেই কি নারীর ক্ষমতায়ন হবে?
ক্ষমতায়নের আক্ষরিক অর্থ হল নারীকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে স্বাবলম্বী করা৷ তাঁদের মর্যাদাসম্পন্ন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা৷ এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য কী? গত নির্বাচনে বছরে ২ কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁর এমন ল্যাজে– গোবরে অবস্থা যে, এবার চাকরির কথা বলতেই তিনি সাহস পাচ্ছেন না৷ নরেন্দ্র মোদি সরকার কর্ম ও কর্মী–সংকোচনের যে নীতি নিয়ে চলছে তাতে শুধু পুরুষরাই নয়, কাজ হারাচ্ছেন মহিলারাও৷ অথবা চাকরির সম্ভাবনা শুধু পুরুষদেরই সঙ্কুচিত হচ্ছে তা নয়, সঙ্কুচিত হচ্ছে মহিলাদেরও৷ দেশে লক্ষ লক্ষ মহিলা পরিচারিকার কাজ করেন৷ আজও কেন্দ্র–রাজ্য কোনও সরকারই এঁদের শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি৷ এরা যখন বলে মহিলাদের ক্ষমতায়ন, তখন তা মহিলাদের প্রতি নিষ্ঠুর বিদ্রুপ ছাড়া আর কী!
নারীর ক্ষমতায়নের পাশাপাশি চাই নারীর নিরাপত্তা– সরকার কি তা নিশ্চিত করতে পেরেছে? দেশের সর্বত্র নারী–আন্দোলনের অন্যতম দাবি মদ নিষিদ্ধ করা৷ কেন্দ্র–রাজ্য কোনও সরকার কি এই দাবির প্রতি মর্যাদা দিয়েছে? সরকার মদের ব্যাপক লাইসেন্স দিয়ে রাজস্ব বাড়াচ্ছে৷ হাজার হাজার নারী–শিশু পাচার হয়ে যাচ্ছে৷ অর্থলোভী একদল মানুষ অভাবগ্রস্ত পরিবারের মেয়েদের কাজ দেওয়ার নাম করে শহরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে৷ এঁদের কি নিরাপত্তা দিতে পেরেছে সরকার? কতটুকু ভূমিকা নিয়েছে পাচার হওয়া নারীদের উদ্ধারের ক্ষেত্রে? আবার যাঁরা উদ্ধার হয়েছেন, তাঁদের অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে কী ভুমিকা নিয়েছে? প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা চুড়ান্ত নিষ্ক্রিয়তার৷
এছাড়া মাদকাসক্ত সমাজবিরোধী চক্র খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, পাচার– এই সব কাজে যুক্ত, ভোটের সময় তাদের বেশিরভাগই শাসকদলের আশ্রয়ে৷ শাসকদল এদের নিয়ে সন্ত্রাস কায়েম করে জনমতকে জোর করে নিজেদের বাক্সে ভরায়৷ শাসকদলের কাছে এরা অপরিহার্য বলে, এরা খুন ধর্ষণে অভিযুক্ত হলে পুলিশ সহজে গ্রেপ্তার করে না৷ গণআন্দোলনের চাপে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হলেও অপরাধ অনুযায়ী ধারায় মামলা করে না, যাতে সহজেই ছাড়া পেয়ে যায়৷ প্রতিটি ক্ষেত্রে যে সরকারের এই ভূমিকা, সেই সরকারের কাছে মানুষ কী আশা করতে পারে?
কংগ্রেসের বদলে সিপিএম, সিপিএমের বদলে তৃণমূল, তৃণমূলের বদলে বিজেপি, আবার বিজেপির বিরুদ্ধে রাহুল–প্রিয়াঙ্কা– এই গোলকধাঁধাঁ থেকে বেরোতে না পারলে নারী, পুরুষ কারওরই কোনও মুক্তি নেই৷ পুঁজিবাদী মিডিয়া, বিশেষ করে টিভি চ্যানেলগুলি মানুষের ভাবনাকে বারবারই এই বৃত্তের মধ্যে আটকে দিচ্ছে৷ তাতে কোনও একটা দলের জয়পরাজয় নির্ধারিত হতে পারে– কিন্তু জনজীবনের সংকটের কোনও সমাধান নেই৷
পঞ্চায়েত, পৌরসভায় ৩৩ শতাংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত৷ সেখানে কি সত্যিই নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে? আসলে আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত এই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় তাঁদের স্বাধীন, নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়ার কি কোনও সুযোগ আছে? ফলে এই পচা–গলা ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে নারীর ক্ষমতায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া, ভোটবাজ দলগুলির ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়৷