খবরের কাগজে কোনও না কোনও জেলায় বোমা ফেটে মানুষের প্রাণহানির খবর নেই এমন একটা দিন পাওয়া এখন পশ্চিমবঙ্গবাসীর অসাধ্য৷ গত কয়েক মাসে কত শিশু যে বল ভেবে বোমায় হাত দিয়ে প্রাণ হারিয়েছে অথবা চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছে তার সংখ্যা সঠিকভাবে কে বলবে? এই বেআইনি বোমার বিস্ফোরণের আওয়াজই যে এ রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোটের আগমনী সূচিত করছে তাতে রাজ্যবাসীর সন্দেহ নেই৷
এরই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শাসক এবং হরেক বিরোধী দলের নেতা–নেত্রীদের আস্ফালন৷ কেউ বলছেন গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেব, কেউ হাত–পা কেটে নেওয়ার নিদান দিচ্ছেন৷ এর মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর মুখে শোনা গিয়েছিল বেআইনি অস্ত্র এবং বোমা ধরার জন্য তিনি পুলিশকে দল বিচার করতে বারণ করেছেন৷ বলেছিলেন, সমস্ত বোমা ও অস্ত্রের ভাণ্ডার নির্মূল করতে হবে৷ এইরকম একটি রুটিন কাজ করার জন্য পুলিশ মুখ্যমন্ত্রীর জনসমক্ষে দেওয়া বিশেষ নির্দেশের দিকে চেয়ে বসে থাকবে কেন, সে প্রশ্ন না হয় আপাতত সরিয়ে রাখা যাক৷ কিন্তু নির্দেশ যাই হোক, তা শুনতে যতই ভাল লাগুক প্রতিদিন যে পরিমাণ বেওয়ারিশ বোমা, বা অসতর্কতায় ফেটে যাওয়া বোমার স্তূপের কথা জানা যাচ্ছে, তাতে ওই ভাণ্ডারের পর্বতপ্রমাণ চেহারাটা ভাবলেও আতঙ্ক হয়৷ এই ভাণ্ডারের অনেকটা যেমন ব্যবহার হবে বিরোধীদের উপর, আবার শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বেও তা কাজে লাগছে৷ পুলিশ জানে গদিতে যাঁরা থাকেন, তাঁদের জনসমক্ষে অনেক কথা বলতে হয়, কিন্তু তার পিছনের ইঙ্গিতটি একেবারে না বুঝে সত্যি সত্যি শাসকদলের অস্ত্র এবং বোমার ভাণ্ডারে হাত দেওয়ার মতো আহাম্মকি দেখাবেন–এমন ওসি থেকে আইপিএস স্তরের অফিসার খুঁজে পাওয়া অসম্ভব৷ এমনটি হলে তাঁর আর পুলিশে চাকরি করা চলে না৷ এ সত্য মনে প্রাণে জানেন এবং মন্ত্রের মতো জপ করে থাকেন সব জমানার সব রাজ্যের পুলিশ কর্তারা৷ খুব বাড়াবাড়ি কিছু ঘটে গেলে তাঁরা কদিন দৌড়োদৌড়ি করে জনরোষ চাপা দেবার চেষ্টা করেন, তারপর সব থিতিয়ে গেলে যা চলছিল চলতেই থাকবে৷ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেখা গেছে বীরভূমের বগটুইতে৷ অতীতে সিপিএম জমানা কিংবা তার আগের কংগ্রেস জমানার উদাহরণগুলিও রাজ্যবাসী এখনও ভুলতে পারেননি৷ সিপিএম রাজত্বে নেতাই নন্দীগ্রামের গণহত্যার কথা বহু আলোচিত হলেও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার নানা জায়গা বিশেষত কুলতলি জয়নগরের গ্রামে গ্রামে প্রথমে কংগ্রেস এবং তারপর সিপিএম কীভাবে বেআইনি অস্ত্র, বোমা ও সমাজবিরোধীদের মুক্তাঞ্চল বানিয়ে সন্ত্রাস ও খুনের রাজনীতি চালিয়েছে, পুলিশকে ব্যবহার করে যথেচ্ছ মিথ্যা মামলায় নির্দোষীদের বছরের পর বছর জেল খাটিয়েছে তা খবরের কাগজওয়ালার সবসময় বলেন না৷ ওই জেলা এবং অন্য জেলা মিলিয়ে দুশোর বেশি এস ইউ সি আই (সি) কর্মী, নেতা, সমর্থকের প্রাণ গেছে সে সময়৷ পরবর্তী তৃণমূল জমানাতে অতীতের সেই সমস্ত কংগ্রেস এবং সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীরা যথারীতি শাসক দলের ছাতার তলায় ভিড় করেছে৷ ফলে এখনও একই ট্র্যাডিশন চলেছে৷
গত বছরের পঞ্চায়েত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে সন্ত্রাসের ব্যাপারে তৃণমূল কোনও রাখঢাক করতে রাজি নয়৷ জেলার পর জেলায় বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত গড়তে তারা মনোনয়ন করতে না দেওয়ার রাস্তা নিয়েছিল৷ বিরোধীদের গুড়–বাতাসা দিয়ে আপ্যায়নের হেঁয়ালির স্রষ্টা এবং পুলিশকে বোমা মারার নিদান হাঁকা তৃণমূল নেতা এখন জেলে থাকলেও এর কোনও পরিবর্তন হবে এমন আশা করা মুশকিল৷ যদিও শাসকদলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক এবারে বলেছেন, পঞ্চায়েত নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে৷ কিন্তু গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে এবং তার পরেও তাঁর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে ডায়মন্ডহারবার লোকসভা এলাকা জুড়ে সন্ত্রাসের যে রূপ সাধারণ মানুষ দেখেছে তারপর এ সব কথায় ভরসা রাখার কোনও কারণ আছে বলে কেউ বিশ্বাস করবেন কি? সমস্যা হচ্ছে সাধারণ মানুষ এর প্রতিবাদ করবেন কি, পুরনো সিপিএম জমানার সাথে মিলিয়ে তাঁরা ধরেই নিচ্ছেন এমনটাই স্বাভাবিক৷ এটাই নাকি রাজনীতি বড়জোর কে বেশি কে কম এ নিয়ে চায়ের দোকান কিংবা তাসের আড্ডায় আলোচনা চলে৷ পঞ্চায়েত, মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচনে বিরোধীশূন্য বোর্ড করতে সিপিএম সন্ত্রাসের যে ধারা নিয়েছিল তা কখনও সূক্ষ্ম, কখনও সরাসরি পিস্তল, বোমার কারাবার ছিল৷ খোদ কলকাতা শহরে কর্পোরেশন নির্বাচনে পিস্তল নিয়ে রাস্তার উপর দাপাদাপি মানুষ দেখেছে৷ গ্রামে গ্রামে বিরোধী দলের সম্ভাব্য প্রার্থীর স্ত্রীর কাছে সাদা থান পৌঁছে দেওয়া, হুমকি দিয়ে বিরোধী পরিবারগুলিকে গ্রামে একঘরে করা বা গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করা ইত্যাদি নানা ছক তাদের ছিল৷ অসংখ্য বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত তৈরির জন্য তৃণমূল কংগ্রেস যে যুক্তি দিচ্ছে, আশ্চর্য হলেও তা হুবহু সিপিএমের সাথে মিলে যাচ্ছে– বিরোধীরা প্রার্থী না পেলে আমরা কি দিয়ে দেব? প্রশাসন এবং পুলিশ এ ব্যাপারে তখন যেমন জড় পদার্থের রূপ নিয়েছিল, এখনও তাই৷
সারা ভারতেই দলদাস পুলিশ এবং প্রশাসন এই কথাটা শুনতে শুনতে যেন মানুষের কান অভ্যস্ত হয়ে গেছে৷ মানুষ ধরেই নিয়েছে এমনটা ঘটেই চলবে৷ এ ব্যাপারে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে যতই লাফাক তাদের রাজত্বে ত্রিপুরার পঞ্চায়েত নির্বাচনের সন্ত্রাসের ছবি কি মানুষ ভুলে যাবে? উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, আসাম সহ বিজেপি শাসিত সমস্ত রাজ্যের চিত্রই প্রায় এক৷ বিজেপি নেতারা বললেই পুলিশ সুপার পর্যন্ত সেখানে বুলডোজার দিয়ে বিরোধী কিংবা সরকারের অপছন্দের লোকেদের ঘরবাড়ি ভাঙার কাজে নেমে পড়েন৷ এখন পশ্চিমবঙ্গে তারা গণতন্ত্র নিয়ে গলা ফাটাচ্ছে৷ ভারতে আজ গণতন্ত্রের যা চেহারা তাতে শাসক দল যেমন মনে করে তারাই জনগণের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, একইভাবে প্রশাসনের আমলা পুলিশের কর্তারাও জানেন কেমন করে শাসকদের তোয়াজ করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতে হয়৷ জনগণ মরল না বাঁচল এ নিয়ে এই দু’পক্ষের কারওরই কোনও মাথাব্যথা নেই৷
আজকের দিনে যখন এ রাজ্যের শহর–গ্রাম–মফস্বল একের পর এক বোমায় শিশুরা প্রাণ হারাচ্ছে, রাজনৈতিক হানাহানিতে নিতান্ত সাধারণ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে, সে সময় শুধু অসহায় আক্ষেপই কি আমরা করে যাব? এর সমাধানের একটাই রাস্তা– সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ৷