আবার একটি ২৩ জানুয়ারি এসে গেল৷ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের আপসহীন ধারার সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী নেতাজি সুভাষচন্দ্রের ১২২তম জন্মদিন৷ দেশের সাধারণ মানুষ, ছাত্রযুবরা গভীর শ্রদ্ধার সাথে আবারও স্মরণ করবে মহান এই বিপ্লবীকে, তাঁর কর্মকাণ্ডকে৷ শপথ নেবে তাঁর অপূরিত কাজ সমাধা করার৷ একই সাথে, সুভাষচন্দ্রের প্রতি মানুষের এই আবেগকে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে, ভোটের স্বার্থে কাজে লাগাতে নেমে পড়বে কেন্দ্রে, রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা দলগুলো তাদের সরকারি ক্ষমতা এবং অর্থভাণ্ডার নিয়ে৷ সেখানে অনেক সমারোহ, অনেক আড়ম্বর হবে, অনেক বক্তৃতা হবে, শুধু খুঁজে পাওয়া যাবে না নেতাজির স্বপ্নকে, আদর্শকে৷ যারা আজ সাধারণ মানুষের স্বার্থকে দু’পায়ে মাড়িয়ে শুধুমাত্র দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থই রক্ষা করে চলেছে, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে দেশের আকাশ–বাতাস ভরিয়ে তুলেছে, মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার দিকে, যাদের জীবনে নেতাজির নীতি–আদর্শের ছোঁয়াটুকুও নেই, বরং আচরণে সম্পূর্ণ তার বিপরীত, সেদিন বক্তৃতায় তাঁদেরই গলা শোনা যাবে সবচেয়ে বেশি৷ দেশের মানুষকে এদের সম্পর্কে সাবধান থাকতে হবে৷ জানতে হবে নেতাজির সত্যিকারের নীতি–আদর্শ, চর্চা করতে হবে তাঁর জীবনসংগ্রামের৷ জানতে হবে, নেতাজি কেমন ভারত চেয়েছিলেন, স্বাধীন ভারতে নেতাজির সেই স্বপ্ন কেন সফল হল না৷
নেতাজি বলেছিলেন, ‘‘স্বাধীনতা সংগ্রামে জনগণ যখন একে অপরের সংগ্রামের সাথী (কমরেড ইন–আর্মস) হয়ে উঠবে, তখন সকলের জীবন একই লক্ষ্যে নতুন প্রেরণায় জাগ্রত হবে এবং এরই সঙ্গে গড়ে উঠবে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, উন্মোচিত হবে এক নতুন দিগন্ত, উন্মেষ ঘটবে এক নতুন দৃষ্টির৷ এই বিপ্লব যেদিন আসবে সেদিন ভারতীয় জনগণ এক পরিবর্তিত জনগণে পরিণত হবে৷ … দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতার ক্যানসার নির্মূল করা …বর্তমান অবস্থায় প্রায় অসম্ভব মনে হতে পারে৷ কিন্তু এই কাজই অনেক সহজ হয়ে যাবে যদি একটি বার আমরা সমগ্র জাতিকে জড়িয়ে বিপ্লবী মানসিকতার বিকাশ ঘটাতে পারি’’৷
সাম্প্রদায়িকতার ক্যানসার নির্মূল করতে সুভাষচন্দ্র যে ‘বিপ্লবী মানসিকতার বিকাশ ঘটানোর’ কথা বলেছিলেন, যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছিলেন, সেটা কী ছিল?
অষ্টাদশ শতকে ইউরোপের দেশগুলিতে সামন্ততন্ত্র ও রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা এসেছিল৷ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চালু হয় গণতন্ত্র ও পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা৷ ধর্মীয় ভাবধারা ও অতিপ্রাকৃত ভাবধারায় সম্পৃক্ত মূল্যবোধের বিরুদ্ধে আসে সেকুলার তথা ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক ভাবনাধারণা ও মূল্যবোধ৷ ধর্মের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয় যুক্তির শাসন৷ রাষ্ট্র ধর্মকে পরিণত করে নাগরিকদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে৷ ব্যক্তির সামাজিক ক্রিয়াকলাপ ও রাষ্ট্রের উপর থেকে ধর্মের প্রভাবকে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করে৷ সুভাষচন্দ্র চিন্তাগত ক্ষেত্রে ইউরোপীয় আধুনিক এই চিন্তাকেই গ্রহণ করেছিলেন৷ তাঁর লক্ষ্য ছিল স্বাধীন ভারতও এমনই এক সেকুলার রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে উঠবে৷ তাই স্বাধীনতা আন্দোলনের ময়দানে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ‘‘গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়গত খণ্ড চিন্তা নয়, সমগ্র জাতিকে জড়িয়েই চিন্তা করতে ও অনুভব করতে আমাদের শিখতে হবে৷ সামাজিক ও আর্থিক ক্ষেত্রের যে সত্যটি সম্বন্ধে আমাদের নিরক্ষর দেশবাসীর চোখ আমাদেরই খুলে দিতে হবে, তা হল, ধর্ম, জাত ও ভাষার পার্থক্য থাকলেও আর্থিক সমস্যা ও অভিযোগগুলি আমাদের সকলেরই এক৷ … দারিদ্র ও বেকারি, অশিক্ষা ও রোগগ্রস্ততা, কর ও ঋণের বোঝা সব সমস্যাই হিন্দু ও মুসলমান সহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের জনগণকে একইভাবে আঘাত করে এবং এগুলির সমাধানও সর্বাগ্রে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের উপর নির্ভর করে৷’’
সুভাষচন্দ্র নিজে ব্যক্তিগত জীবনে সেকুলার ছিলেন এবং কংগ্রেসকেও সেকুলারিজমের উপর দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, ‘‘ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়া উচিত৷ ধর্ম ব্যক্তি বিশেষের হওয়া উচিত৷ ব্যক্তি হিসাবে মানুষ যে ধর্ম পছন্দ করে তা অনুসরণ করার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে৷ কিন্তু ধর্মীয় বা অতীন্দ্রিয় বিষয়ের দ্বারা রাজনীতি পরিচালিত হওয়া উচিত নয়৷ তা পরিচালিত হওয়া উচিত শুধুমাত্র অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক বিচার বুদ্ধি দিয়ে৷’’ তিনি মনে করতেন, সামন্ততন্ত্র এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াইয়ে সমগ্র জনগণকে যুক্ত করে এমন একটি স্বাধীন সার্বভৌম সেকুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই ভারত সমস্ত ধর্ম–বর্ণ–প্রাদেশিকতার ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে এক অখণ্ড জাতি হিসাবে গড়ে উঠতে পারবে৷ যেখানে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির উপাদানগুলিই লুপ্ত হয়ে যাবে৷ কিন্তু গান্ধীজির নেতৃত্বে কংগ্রেস গণতন্ত্রের এই আধুনিক ধারণাকে গ্রহণ করেনি৷ সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাসনির্ভর বলিষ্ঠ ধারণার বিপরীতে গান্ধীজি এবং কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতৃত্ব জাত–পাত, ধর্ম–বর্ণের সাথে আপস করে চললেন৷ উপরন্তু ধর্মকে জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ প্রচারের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করলেন৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামের কর্মসূচির মধ্যে সামাজিক বিপ্লব ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কর্মসূচিকে মেলাতে সক্ষম হলেন না৷ এর ফলে তাঁরা মানবতাবাদী আদর্শের ভিত্তিতে এক ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসাবে দেশবাসীকে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলেন৷ রাজনীতিগতভাবে ভারতীয়রা একটা আধুনিক জাতি হিসাবে গড়ে উঠলেও ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি ও আচারকে ভিত্তি করে দেশের জনসাধারণ বিচ্ছিন্ন ও আলাদা আলাদা কমিউনিটি হিসাবেই থেকে গেল৷ আবার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সাথে আপস করে চলার ফলে দেশজুড়ে বিপ্লবী সংগ্রামও গড়ে তুলতে পারলেন না৷ গান্ধীজির ‘রামরাজত্ব’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের ব্যাপক সংখ্যায় আকৃষ্ট করতে পারল না৷ কংগ্রেসের নেতৃত্ব মূলত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাতে থাকায় তা নিম্নবর্ণের হিন্দুদেরও এই আন্দোলন আকৃষ্ট করতে পারল না৷ স্বাধীনতা আন্দোলনের এই দুর্বলতার মধ্যেই রয়ে গেল জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা ও বিভাজনের বীজ৷ স্বাধীনতার পর কংগ্রেস ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটির ইতিহাস–সৃষ্ট অর্থকে বিকৃত করে দাঁড় করাল সমস্ত ধর্মে সমান উৎসাহদান৷ দীর্ঘদিন ধরে কংগ্রেস এই দুর্বলতাটিকে তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে ব্যবহার করেছে৷ এখন বিজেপি সেটিকেই নগ্নভাবে ব্যবহার করছে৷ দেশে হিন্দু ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ভিত্তি করে হিন্দুরাষ্ট্রের দাবি তুলছে৷ দাবি করছে, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কথাটিকেই সংবিধান থেকে বাদ দিতে হবে৷পশ্চিমবাংলা সহ রাজ্যে রাজ্যে পেটিবুর্জোয়া দলগুলিও আজ ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সব ধর্মের রীতিনীতি, আচার–ব্যবহার এবং কুসংস্কারগুলিকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উৎসাহ দিয়ে চলেছে৷
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সেকুলার গণতন্ত্রের যে ধারণা সুভাষচন্দ্র এ দেশে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, গান্ধীজি সহ বাকি কংগ্রেস নেতারা তার চর্চা করলেন না কেন, কেনই বা সুভাষচন্দ্রের সে কাজে তাঁরা বাধা হয়ে দাঁড়ালেন?
এর কারণটি সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এ যুগের অন্যতম মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক, এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর প্রতিষ্ঠাতা কমরেড শিবদাস ঘোষ৷তিনি দেখালেন, ‘‘ভারতে পুঁজিবাদের বিকাশ ও জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সৃষ্টি এমন একটা সময়ে যখন বিশ্বপুঁজিবাদ তার সমস্ত প্রগতিশীল চরিত্র হারিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদে পর্যবসিত হয়েছে৷ভারতীয় জাতীয় পুঁজিবাদ তখন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হলেও ওই ক্ষয়িষ্ণু বিশ্বপুঁজিবাদী ব্যবস্থারই অংশবিশেষ৷ তাই পুঁজিবাদী বিপ্লবের যুগে পুঁজিবাদের যে বিপ্লবী চরিত্র ছিল, ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের যুগে ভারতীয় পুঁজিবাদের সেই বিপ্লবী চরিত্র আর ছিল না৷ তাই ভারতের জাতীয় বুর্জোয়ারা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিলেও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া শ্রেণির অংশ হিসাবে তাদের বিপ্লবী চরিত্র ছিল না, তারা মূলত হয়ে পড়েছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংস্কারপন্থী বিরুদ্ধবাদী (reformist oppositional)৷ফলে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে আমরা বুর্জোয়া মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী দু’টি ধারা দেখতে পাই৷একটি সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রের সাথে আপসমুখী এবং গোটা আন্দোলনে এইটিই মুখ্য ধারা ছিল৷অপরটি ছিল সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের ধারা৷’’ গান্ধীজি এবং কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে ভারতের জাতীয় বুর্জোয়াদের এই সংস্কারপন্থী বিরুদ্ধবাদী দৃষ্টিভঙ্গিই প্রকাশ পেয়েছিল৷ অন্য দিকে পেটিবুর্জোয়া বিপ্লববাদের প্রতিনিধি হিসাবে সুভাষচন্দ্র সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন রাজনৈতিক সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন৷
নেতাজির অদম্য প্রয়াস সত্ত্বেও ভারত প্রকৃত অর্থে একটি সেকুলার রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে উঠতে পারেনি৷ ভারতবাসী একটি অখণ্ড জাতিসত্তা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি৷ দেশের পেটিবুর্জোয়া বিপ্লববাদের প্রতিনিধি হিসাবে নেতাজির মধ্য দিয়ে একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল যখন হরিপুরা কংগ্রেসে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হলেন৷ হরিপুরা কংগ্রেসের ভাষণে নেতাজি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে পূর্ণ স্বরাজের দাবিতে দেশজুড়ে ব্যাপক আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করলেন৷ একদিকে দেশে শিল্পায়ন গড়ে তোলার পরিকল্পনা ঘোষণা করলেন, অন্য দিকে জমিদারি প্রথা বিলোপের দাবি জানিয়ে শ্রমিক ও কৃষকদেরও কংগ্রেসের আন্দোলনে যুক্ত করার কথা ঘোষণা করলেন৷ তাঁর চিন্তার মধ্যে সদ্য ঘটে যাওয়া রাশিয়ায় লেনিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং পরবর্তীকালে স্ট্যালিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার সমাজের বিরাট অগ্রযাত্রার প্রভাব কাজ করেছিল৷
কিন্তু কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতৃত্ব, যাঁরা জাতীয় বুর্জোয়াদের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন, তারা ভীত হয়ে নেতাজিকে কংগ্রেসের নেতৃত্ব থেকে হঠানোর তৎপর হন এবং পরের বছর ত্রিপুরী কংগ্রেসে নেতাজির কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়ানোর বিরোধিতা করেন৷ গান্ধীজির সমর্থন নিয়ে তাঁরা নেতাজির বিরুদ্ধে পট্টভি সীতারামাইয়াকে প্রার্থী করেন৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও নেতাজি দ্বিতীয়বার কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন৷ এরপরই শুরু হয় এক ষড়যন্ত্র৷ যার পরিণতিতে সুভাষচন্দ্রকে শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়৷ এই ষড়যন্ত্রে কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতাদের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন বামপন্থীরাও, যাঁদের মধ্যে ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়ের Radical Humanist, সোস্যালিস্ট পার্টি এবং সিপিআই৷ ফলে পন্থ–প্রস্তাব গৃহীত হয়ে যায়৷ আপসহীন পথে পূর্ণ স্বরাজ অর্জনের যে সুযোগটি সৃষ্টি হয়েছিল, তা তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি সহ বামপন্থীদের বিশ্বাসঘাতকতায় হারিয়ে যায়৷
আজকের বিজেপি, যার জন্ম আর এস এস এবং হিন্দু মহাসভা থেকে, তারা আজ হঠাৎ মহা জাতীয়তাবাদী সেজেছে৷ অথচ স্বাধীনতা আন্দোলনে এই দলটির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত কলঙ্কজনক৷ এই দলটি সেদিন ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইটাকে জাতীয়তাবাদ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে স্বাধীনতা আন্দোলনেরই বিরোধিতা করেছিল৷ আর এস এস নেতা গোলওয়ালকর লিখেছিলেন ‘‘ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ এবং সাধারণ বিপদের তত্ত্বকে ভিত্তি করে আমাদের যে জাতিতত্ত্ব গঠিত হয়েছে সেটা কার্যত আমাদের হিন্দু জাতিতত্ত্বের সার্থক ও প্রেরণাদায়ক মর্মবস্তু থেকে বঞ্চিত করেছে এবং স্বাধীনতা আন্দোলনকে কার্যত ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে পর্যবসিত করেছে৷ ব্রিটিশ বিরোধিতার সাথে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদকে সমার্থক করা হয়েছে৷ এই প্রতিক্রিয়াশীল ধারণা সমগ্র স্বাধীনতা আন্দোলন, তার নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ মানুষের উপর সর্বনাশা প্রভাব ফেলেছে’’, (উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড)৷ অর্থাৎ আর এস এসের দৃষ্টিতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা নয়, মুসলিম বিরোধিতা ও হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টাই ছিল একমাত্র দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ৷ আরএসএসের এই তত্ত্বের তীব্র বিরোধী ছিলেন নেতাজি৷ এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেছিলেন, ‘‘হিন্দুরা ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে হিন্দু রাজের ধ্বনি শোনা যায়৷ এগুলি সর্বৈব অলস চিন্তা৷ … শ্রমসিক্ত জনসাধারণ যে সব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন, সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি তার কোনওটির সমাধান করতে পারবে কি? কীভাবে বেকারত্ব, নিরক্ষরতা, দারিদ্র্য প্রভৃতি সমস্যার সমাধান হবে সে সম্বন্ধে তাহারা কোনও পথ নির্দেশ করিয়াছে কি?’’ স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দু মহাসভার ভূমিকায় অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে নেতাজি ঝাড়গ্রামের এক সভায় বলেছিলেন, ‘‘সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের ত্রিশূল হাতে হিন্দু মহাসভা ভোট ভিক্ষার জন্য পাঠিয়েছেন৷ ত্রিশূল আর গেরুয়া বসন দেখলে হিন্দুমাত্রেই শির নত করে৷ ধর্মের সুযোগ নিয়ে, ধর্মকে কলুষিত করে হিন্দু মহাসভা রাজনীতির ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে৷ … এই বিশ্বাসঘাতকদের আপনারা রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে সরিয়ে দিন৷ তাঁদের কথা কেউ শুনবেন না, আমরা চাই দেশের স্বাধীনতাকামী নরনারী এক প্রাণ হয়ে দেশের সেবা করুক’’৷ এই হিন্দু মহাসভারই বিজেপি আজ আরও উগ্রতার সাথে ধর্মান্ধতাকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ঘটিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে রাজনীতিকেই আরও কলুষিত করছে৷ এদের হাতে নেতাজির গলায় মালা পরানো কি মেনে নেওয়া যায়৷
ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের অদম্য স্পৃহা নেতাজির জীবনের সংগ্রামকে তীব্র থেকে তীব্রতর করেছিল৷ তাঁর চিন্তাও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞানকে জানার মধ্য দিয়ে পরিণত হয়ে উঠেছিল৷ ক্রমেই তিনি উপলব্ধি করছিলেন সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ অর্জনই মানবজাতির একমাত্র লক্ষ্য৷ তাই তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমার ছেলেবেলায় আমি ব্রিটিশকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়াই সবচাইতে বড় কর্তব্য বলে মনে করতাম৷ পরে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেছি যে, ব্রিটিশকে তাড়ালেই আমাদের কর্তব্য শেষ হয়ে যাবে না৷ ভারতবর্ষে নতুন সমাজব্যবস্থা চালু করার জন্য আর একটি বিপ্লবের প্রয়োজন৷’’ এই আর একটি বিপ্লব যে অবশ্যই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব তা-ই বলেছেন বারীন ঘোষকে লেখা চিঠিতে– ‘‘এতকাল স্বাধীনতা বলতে আমরা শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথাই বুঝিয়েছি৷ কিন্তু এখন থেকে আমাদের ঘোষণা করতে হবে যে, আমরা জনসাধারণকে শুধু রাজনৈতিক দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে চাই না, সমস্ত প্রকার বন্ধন থেকেই মুক্ত করতে চাই৷ স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক এই তিন ধরনের শোষণেরই অবসান৷ যখন সকল শৃঙ্খলের অবসান ঘটবে, তখনই আমরা সাম্যবাদের ভিত্তিতে একটি নতুন সমাজ গড়তে অগ্রসর হতে পারি৷ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান লক্ষ্য একটি মুক্ত এবং শ্রেণিহীন সমাজ গড়ে তোলা’’৷ আজ ব্রিটিশ নেই, ক্ষমতায় রয়েছে জাতীয় পুঁজিপতি শ্রেণি৷ নেতাজি কথিত আজকের আর একটি বিপ্লব তাই রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা জাতীয় পুঁজিপতি শ্রেণির বিরুদ্ধে৷ আজ নেতাজিকে সত্যিকারের শ্রদ্ধা জানানোর একটিই রাস্তা, তা হল তাঁর অপূরিত স্বপ্নকে সফল করা, বিপ্লবী আন্দোলনের কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়া৷ আসুন, ২৩ জানুয়ারি সর্বত্র যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে নেতাজি জন্মদিবস পালনের মধ্য দিয়ে সেই কর্মকাণ্ডে আত্মনিয়োগ করি৷