‘দেশের ছাত্রছাত্রীরা সরস্বতী পুজোর দিন থেকে সংশোধিত ইতিহাস পড়তে শুরু করবেন’৷ কিছুদিন আগে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রীর এই ঘোষণায় সারা দেশে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে৷ সম্প্রতি বিহারের সাসারামে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব হিস্টোরিকাল রিসার্চ এবং আরএসএস অনুমোদিত অখিল ভারতীয় ইতিহাস সংকলন যোজনা আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে এই মন্তব্যটি করেছেন ধর্মেন্দ্র প্রধান৷
বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একজন মন্ত্রীর এই ঘোষণা হঠাৎ নয়৷ তাঁরা নয়া জাতীয় শিক্ষানীতিতে দেশের ইতিহাস পুনর্লিখনের নামে যে পরিবর্তনগুলো নিয়ে আসছেন সেটাকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে তাঁদের পরিকল্পনা কত গভীর, তা বোঝা যাবে৷ তাদের যুক্তিগুলি থেকে মনে হবে, দেশের মানুষের সামনে এতদিন সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা হয়নি৷ স্বভাবতই বিষয়টি নিয়ে দেশ জুডে শিক্ষাবিদ, গবেষক, অধ্যাপক, ছাত্র ও নাগরিকদের মধ্যে আশঙ্কা ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে৷
২০২০-র ২৯ জুলাই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রয়াণ দিবসে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও বিতর্কের সুযোগ না দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মন্ত্রিসভার অনুমোদন দিয়ে নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি (এনইপি ২০২০) গ্রহণ করে৷ ২৯ জুলাই এই শিক্ষানীতি প্রণয়ন করলেও ভারতীয় নবজাগরণের পার্থিব মানবতাবাদের বলিষ্ঠতম প্রতিনিধি, যিনি এ দেশে আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ, বৈজ্ঞানিক ও গণতান্ত্রিক শিক্ষার বিস্তারে আজীবন প্রাণপাত পরিশ্রম করেছেন, সরকারি দলিলে ভুলেও তাঁর নাম উল্লেখিত হয়নি৷ এই শিক্ষানীতির সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালের পর থেকে৷ ২০১৮ সালে এক সরকারি প্রবক্তা বলেছিলেন, ‘… ভারতীয় ইতিহাসের সত্যিকারের রং হল গৈরিক৷ এবং সংসৃক্তির ক্ষেত্রে কোনও পরিবর্তন আনতে হলে আমাদের ইতিহাস নতুন করে লিখতে হবে’৷ এই শিক্ষানীতির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খুঁটিয়ে লক্ষ করলে বোঝা যায়, কেন তাতে বিদ্যাসাগরের নাম উল্লেখিত হয়নি৷
নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি কার্যকর করতে গিয়ে ‘রাশনালাইজেশন’ এর নামে এবং ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে অপ্রাসঙ্গিক’ এই প্রশ্ণ তুলে, করোনা পরবর্তী সময়ে সিলেবাসের বোঝা কমানোর অজুহাতে, সম্প্রতি এনসিইআরটি ও ইউজিসি স্কুল স্তর থেকে কলেজ স্তর পর্যন্ত ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে৷ যার মধ্যে ইতিহাসের সিলেবাসের পরিবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও লক্ষণীয়৷ বিষয়টি নিয়ে শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী ও ইতিহাসবিদদের মধ্যে প্রতিবাদের ঝড উঠেছে৷ পুনর্লিখনের নামে কী ধরনের পরিবর্তন ইতিহাসের সিলেবাসে আনা হচ্ছে তা এবার দেখা যাক৷
পাঠ্যবইতে বাদ বর্ণাশ্রম প্রথা
ষষ্ঠ শ্রেণির সিলেবাসে ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে বাদ দেওয়া হয়েছে৷ যেমন বৈদিক সভ্যতার সময়ে এবং পরবর্তীকালে বিশেষত প্রাচীন ও মধ্যযুগে মনুসংহিতাকে ভিত্তি করে কঠোর চতুর্বর্ণ বা জাতিভেদ প্রথা জারি ছিল, যার প্রভাব আজও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ও রাজ্যে রাজ্যে অত্যন্ত প্রকট৷ জন্মসূত্রে চার ভাগে বা বর্ণে বিভক্ত ছিল বৈদিক বা হিন্দু সমাজ– ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র৷ উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ পুরোহিত ও ক্ষত্রিয় রাজারা নিম্নবর্ণের বিশেষত শূদ্রদের ওপর নির্মম শোষণ ও নির্যাতন চালাত৷ কৃষিব্যবস্থার ক্রমবিকাশের পর্যায়ে যেভাবে শূদ্রদের দাস-দাসী হিসেবে এবং কর্মকারদের ক্রীতদাসের মতো নির্মমভাবে খাটানো হত, তা পরিকল্পিতভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে৷ যাতে ভারতীয় ভূখণ্ডের এই প্রকৃত ইতিহাস ছাত্ররা জানতে না পারে৷ বর্ণাশ্রম প্রথা অনুযায়ী শূদ্ররা এবং মহিলারা শিক্ষার কোনও সুযোগ পেত না শুধু তাই নয়, বৈদিক শাস্ত্র শোনাও তাদের ক্ষেত্রে পাপ ও অপরাধ বলে গণ্য হত৷ পৌরাণিক কাহিনিগুলোতে এ সবের বহু বর্ণনা আছে৷ ইতিহাসের সিলেবাসে এইগুলি বাদ দেওয়া হয়েছে৷ সপ্তম এবং অষ্টম শ্রেণিতে শুধুমাত্র ‘টিকা’র আকারে বিষয়টিকে শ্রমবিভাজন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এর ফলে স্কুল ছাত্রছাত্রীরা প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূণ আধায় যথা, সামাজিক রূপান্তর (Social Transformation), ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগ (Hierarchy) ও বৈচিত্র্য (Diversity) সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যাবে৷
বৌদ্ধ ধর্মের উৎকর্ষ নস্যাৎ করার প্রয়াস
এই সিলেবাসে লক্ষণীয়ভাবে একটি পরিচ্ছেদের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে৷ ‘সম্রাট অশোক যুদ্ধ ত্যাগ করলেন’–এর পরিবর্তে ‘রাজা থেকে সম্রাট’৷ বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে সম্রাট অশোক রক্তক্ষয়ী কলিঙ্গ যুদ্ধের পর ‘চণ্ডাশোক’ থেকে ‘ধর্মাশোক’–এ পরিবর্তিত হলেন৷ তাঁর আমলেই বৌদ্ধধর্ম ভারত ভূখণ্ডের সীমানা পেরিয়ে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল৷ তাঁর নির্দেশ এবং অনুশাসন তৎকালীন সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিল৷ স্বাধীনতার পর ভারতের সরকারি সিলমোহর অশোকস্তম্ভে সম্রাট অশোকের এই নির্দেশ এবং অনুশাসনের কিছু শিক্ষা খোদাই করা আছে৷ হিন্দুত্ববাদীদের অভিযোগ সম্রাট অশোককে ইতিহাসে অহেতুক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং তার ‘নির্দেশনুশাসন’ রাজনৈতিক প্রচার ছাডা আর কিছু নয়৷ এই অভিযোগে তা বর্তমান সিলেবাস থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে পাছে তৎকালীন সমাজে সনাতন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের তুলনায় বৌদ্ধধর্মের মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্বের উৎকর্ষতা প্রমাণিত হয়৷
নবম দশম শ্রেণিতে প্রাচীন চিন, মিশরীয়, মেসোপটেমিয়া ও গ্রিসের সভ্যতা সম্পর্কে যে সংক্ষিপ্ত বিবরণ পডানো হত, তাও সিলেবাসের বোঝা কমানোর নামে বাতিল করা হয়েছে৷ এর ফলে ভারতীয় ভূখণ্ডের বাইরে বিশ্বের অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতা সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের কোনও ধারণা গডে উঠবে না৷
মোগল সাম্রাজ্যের অবমূল্যায়ন
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরু (১২০৬) থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু (১৭০৭) এই দীর্ঘ পাঁচশো বছরের ঘটনা প্রবাহকে ‘মুসলমান শাসন’ এই শিরোনাম দিয়ে দিল্লির সুলতানি ব্যবস্থা ও মোগল শাসনকে একটা পরিচ্ছেদে সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণনা করা হয়েছে৷ মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাসকে গুরুত্বহীন করে বাবরকে আক্রমণকারী হিসেবে ধরে নিয়ে মুসলমানরাই সমস্ত অধঃপতনের জন্য দায়ী বলা হয়েছে৷ অথচ ইতিহাস বলছে সেই সময়ে দিল্লির ও দাক্ষিণাত্যের সুলতানি আমলে এবং মোগল সাম্রাজ্যে শিল্প, কলা, সঙ্গীত, বাদ্যযন্ত্র, স্থাপত্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে হিন্দু মুসলমানের মিলিত সংসৃক্তির এক অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছিল৷ মোগল সাম্রাজ্যে সুদূর আফগানিস্তানের সীমানা থেকে উত্তর-পূর্ব ভারত ও দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শাসন, যোগাযোগ ব্যবস্থা গডে তোলা, নগরায়ন ও সামুদ্রিক বাণিজ্য ব্যবস্থা প্রভৃতি গড়ে উঠেছিল, একে কেন্দ্র করে একদল ধনী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছিল, যা পরবর্তীকালে ইউরোপীয় বণিকদের এ দেশে আসতে প্রলুব্ধ করেছিল এবং এই পথ ধরে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল৷ সিলেবাসের বোঝা কমানোর নামে এই বিষয়গুলি ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে৷
যুদ্ধকে সাম্রাজ্য বিস্তারের পরিণাম না বলে ধর্মীয় বিরোধের পরিণাম হিসাবে দেখানোর অপচেষ্টা
মোগল সম্রাট আকবর ও ঔরঙ্গজেবের নাম উল্লেখিত হয়েছে রানা প্রতাপ ও শিবাজীর সাথে যুদ্ধকে কেন্দ্র করে, যা দুই রাজার মধ্যে সাম্রাজ্য বিস্তার বা দখল না বলে হিন্দু মুসলমানের বিরোধ বলে দেখানো হয়েছে৷ অথচ উভয় রাজার সৈন্য বাহিনীতে হিন্দু এবং মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষ ব্যাপক সংখ্যায় ছিলেন৷ উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, রাজা মানসিংহ ছিলেন সম্রাট আকবরের প্রধান সেনাপতি এবং হাকিম খান সুর ছিলেন মহারানা প্রতাপের প্রধান সেনাপতি৷ এ রকম উদাহরণ আরও অনেক দেওয়া যেতে পারে৷ একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে বিশ্ব ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ যেমন, দক্ষিণ আমেরিকার ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম, ইউরোপের এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে শিল্পবিপ্লব সিলেবাস থেকে বাদ পডেছে৷ সাম্প্রতিক ঘটনাবলি যথা ধর্মের নামে দেশভাগ, ২০০২-এর গুজরাট দাঙ্গা, নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন ইত্যাদি বিষয়গুলি তাদের নতুন ইতিহাস রচনায় বাদ গেছে৷ বাদ পডেছে ভারতীয় নবজাগরণ থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ভারতীয় জাতিগঠনের প্রক্রিয়া, আঞ্চলিক ভাষা ও সংসৃক্তির বিকাশ এবং ঐক্যের মধ্যে বৈচিত্র্যের ইতিহাস, দেশের সংবিধান রচনার ইতিহাস ও তার নির্যাস৷
ইতিহাস লেখার বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি
একই ভাবে স্নাতক স্তরে ইতিহাসের একটি সিলেবাস ইউজিসি তৈরি করেছে৷ তাঁর সঙ্গে সংগতি রেখেই ইতিহাসের পুনর্লিখন করা হবে বলে প্রচার করছে৷ একটা সময়ে ব্যক্তির নিজের উপলব্ধির ভিত্তিতেই ইতিহাস লেখা ও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে৷ রাজা বাদশাদের কাহিনি, যুদ্ধের বিবরণকে ইতিহাস হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে৷ নবজাগরণের যুগে এই ধারণার বদল ঘটে৷ তথ্যভিত্তিক বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস চর্চা শুরু হয়৷ মানুষ নিজের চিন্তা দ্বারা ইতিহাসকে নির্মাণ করেছে নিছক অতীতকে জানার জন্য নয়, অতীত সংক্রান্ত জ্ঞান নিয়ে বর্তমানকে বুঝতে৷ তাই সভ্যতা বিকাশের নিয়ম জানতে, তাকে পরিবর্তন করতে বারে বারে ইতিহাসকে জানতে চেয়েছে৷
ইতিহাস রচনারও একটি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি রয়েছে৷ অতীতে কী ঘটেছিল তা জানতে হলে আমাদের একটি নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়৷ বিজ্ঞান সর্বদাই প্রমাণ দাবি করে৷ প্রমাণ ছাডা কোনও ঘটনার সত্য-মিথ্যা নির্ধারণ করা যায় না৷ এই ক্ষেত্রে কারও ব্যক্তিগত বিশ্বাস, মনগডা ধারণা বা কল্পনার উপরে নির্ভর করা চলে না৷ ইতিহাসে বক্তব্যের সমর্থনে উপযুক্ত প্রমাণ না থাকলে সেগুলি ইতিহাস না হয়ে কল্পসাহিত্য হয়ে উঠে৷ অথচ ইউজিসির প্রস্তাবিত সিলেবাস একটু বিশ্লেষণ করলেই দেখতে পাওয়া যাবে ইতিহাস জানার জন্য, বস্তুনিষ্ঠ তথ্যভিত্তিক ঘটনাগুলিকে আডাল করে ধর্মভিত্তিক শাস্ত্র ও মহাকাব্য, বেদ, বেদাঙ্গ, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতির উপরে জোর দেওয়া হয়েছে৷
পাঠের শুরুতেই ‘আইডিয়া অব ভারত’ নামে পেপারে দেশকে জানার জন্য সময় ও কালের বিশ্বজনীন ধারণার পরিবর্তে ভারতীয় ধারণার কথা বলে দেশকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন সত্ত্বা হিসেবে দেখানো হয়েছে৷ সিন্ধু ও কাল্পনিক সরস্বতী সভ্যতাকে এক বলে সিলেবাসে নিয়ে আসা হয়েছে৷ যার কোনও ভূতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায় না৷
ভারতে আর্যদের আগমন মিথ না বাস্তব
ভারতে আর্যদের আগমনের বিষয়টিকে ইতিহাস সিলেবাসে ‘মিথ’ বা পৌরাণিক কাহিনি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বিষয়টির আরও গুরুত্ব এই কারণেই যে, নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির অংশ হিসেবে সম্প্রতি খড়গপুর আইআইটি প্রকাশিত ‘রিকভারি অব দ্য ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম’ নামক ক্যালেন্ডারে আর্যদের আগমনকে ‘মিথ’ বলে তুলে ধরে বলা হয়েছে, আর্যদের আদি বাসস্থান এ দেশে এবং সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আছে। এর মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে স্বীকৃত ঐতিহাসিক তথ্যগুলিকে অস্বীকার করা হয়েছে। আইআইটি-র মতো জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠানে তথ্য বিকৃতির এই প্রবণতা সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত মারাত্মক শুধু তাই নয়, তা সত্য বিকাশের অন্তরায়। ইতিহাসে এটা প্রমাণিত যে, আর্য ভাষাভাষী উপজাতির মানুষ মধ্য এশিয়ার উঁচু স্তেভূমিতে বসবাস করত। ভাষাতত্ত্ববিদেরা ইন্দো-ইউরোপীয় উপজাতিদের ভাষাগুলির অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখান, মধ্য এশিয়া ছিল ইন্দো ইউরোপীয় ভাষাগুলির উৎসস্থল।
এই গোষ্ঠীর ইন্দো-ইরানীয় শাখাকে বোঝাতে আর্য পরিভাষাটি ব্যাবহৃত হয়। এরাই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহের পূর্বসূরি। কয়েক হাজার বছর ধরে এখান থেকে একটি গোষ্ঠী যায় ইউরোপের দিকে, অন্যটি ইরানের দিকে। পরে ইরানের শাখাটি বিভক্ত হয়ে একটি অংশ উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে ভারতভূমিতে প্রবেশ করে। এরাই ভারতীয় আর্যদের পূর্বসূরি (রোমিলা থাপার, দ্য থিয়োরি অব আরিয়ান রেস অ্যান্ড ইন্ডিয়াঃ হিস্ট্রি অ্যান্ড পলিটি’, ১৯৯৬)।
এরাই ধীরে ধীরে বৈদিক সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল। সিন্ধু ও আর্য সভ্যতা যে এক নয় তা পুরাতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, ভূতাত্ত্বিক, জিনতত্ত্ব ও ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার সূত্রে প্রমাণিত। সিন্ধুতে উন্নত নগরকেন্দ্রিক ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতার সঙ্গে গ্রামকেন্দ্রিক আর্য সভ্যতার যে সামান্যতম মিল নেই এই ঐতিহাসিক সত্যটি প্রমাণিত। বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসের এই পর্বগুলিকে অস্বীকার করে মনগড়া বিশ্বাসকে ইতিহাস বলে চালানো হচ্ছে।
ইতিহাসের নামে ধর্মীয় বিদ্বেষ
দেশের সমাজ মননে নানা ভাবে মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব জাগ্রত করা ও ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এই চিন্তাকে স্থায়ী রূপ দিতে স্কুলপাঠ্যের মতোই উচ্চশিক্ষার সিলেবাসকেও সেই ভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে। সময়ক্রম মেনে ইতিহাস তুলে ধরার বদলে সুলতানি সময়কাল, মোগল সাম্রাজ্যের পর্বগুলিকে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে, নয় তো এমন ভাবে সিলেবাসে নিয়ে আসা হচ্ছে যাতে কোনও সামগ্রিক ধারণা ছাত্রদের মধ্যে গড়ে না ওঠে। সুদীর্ঘ সময়ের মোগল ইতিহাসকে কেবল আফগানদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক এবং শিবাজি ও অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিগুলির সঙ্গে দ্বন্দ্ব এই ভাবে আলোচনার জন্য রাখা হয়েছে। যাতে ছাত্রদের মধ্যে সেই সময়ের রাষ্ট্রীয় কাঠামো, কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ভিত্তি, সামাজিক স্থিতি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের উন্নত মানসিকতার বস্তুনিষ্ঠ ধারণা না গড়ে উঠতে পারে। এই পর্বে রাষ্ট্রকে কেবল ইসলাম ধর্ম প্রসারের মাধ্যম হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে যা থেকে মনে হবে তাঁদের রাজনৈতিক অভিযানগুলি ধর্মীয় উদ্দেশ্যে হয়েছিল। অথচ এই ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের সমর্থনে কোনও জোরালো প্রমাণ নেই।
আবার রাণা প্রতাপ, শিবাজি, গুরু গোবিন্দ সিং প্রমুখ যাঁরা মোগল শাসনের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন তাঁদের উপরে জোর দেওয়া হয়েছে। এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে মনে হবে তাঁরা সত্যই জাতীয় বীর। অথচ জাতি, জাতীয়তাবোধ প্রভৃতি ধারণাগুলি সামন্ততন্ত্র-রাজতন্ত্রের সময় গড়েই ওঠেনি। আমাদের দেশে ব্র্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে নবজাগরণ ও পরবর্তীকালের স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই বোধ ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। কারণ অখণ্ড ভারতকে ঘিরে জাতীয়তাবাদী ধারণা যখন এ দেশে গড়েই ওঠেনি তখন তারা জাতির জন্য সংগ্রাম করেছিলেন বলে দেখানো হচ্ছে। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের সময়ে ঝাঁসির রানী, নানা সাহেবদের গুরুত্বকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তাঁরা কোনও মুসলমান শাসকের বিরুদ্ধে যাননি উপরন্তু মুসলমানকে সম্রাট বলে স্বীকার করেছিলেন। যেহেতু এঁদের ব্যবহার করে মুসলমানবিরোধী মানসিকতার বিকাশ ঘটানো যাবে না তাই এঁদের গুরুত্ব দেওয়া হল না। মারাঠা, রাজপুতদের সঙ্গে মোগলদের লড়াই ছিল রাজনৈতিক আধিপত্যের জন্য, শিবাজির ঘনিষ্ঠ দেহরক্ষীদের মধ্যে মুসলিমরা ছিলেন। আবার মুঘলদের সেনাপতি অনেকেই হিন্দু– এই ইতিহাসকে ছাত্রদের কাছে আড়াল করা হচ্ছে।
একটি পেপারে হিন্দু, মুসলিম দুই আলাদা সম্প্রদায়ের সমাজ, জাতিসত্ত্বার ইতিহাস আনা হয়েছে। ইতিপূর্বে এই বিষয়গুলি কখনও এভাবে আসেনি। সিলেবাস প্রণেতারা যদি এই ভাবে দেখতে চান তা হলে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে সুলতানি শাসনের পূর্ব পর্যন্ত বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি ধর্মের সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরামহীন সংঘর্ষের বিষয়গুলিকে এড়িয়ে গেলেন কেন? মৌর্য বংশের শাসন ধবংসকারী ব্রাহ্মণ রাজা পুষ্যমিত্র শুঙ্গ কী ভাবে বৌদ্ধ স্তূপগুলিকে ধ্বংস করে, মঠগুলিকে আগুনে পুড়িয়ে উৎসবের সূচনা করেছিলেন, তা স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, যে তাঁর কাছে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মাথা এনে দিতে পারবে তাকে একশো স্বর্ণমুদ্রা দান করা হবে। একই ভাবে একাদশ শতকে হুন রাজা মিহিরকুলের হাতে বৌদ্ধ মঠ ধ্বংস ও হত্যার পিছনে প্রধান কারণ ছিল মধ্য এশিয়াতে বাণিজ্য বিস্তারে বৌদ্ধ ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ।
ইতিহাসে মনগড়া ধারণার অনুপ্রবেশ
‘হিস্ট্রি অব কমিউনিকেশন ইন ইন্ডিয়া’ নামে একটি পেপারে নারদ ও কৃষ্ণের চরিত্র আনা হয়েছে। প্রাচীনকালের মুনি-ঋষিরা গাডি, এরোপ্লেন ব্যবহার করতেন, এক দেশ থেকে অন্য দেশে, এমনকি গ্রহাণুপুঞ্জে যাতায়াত করতেন। মন্তে্রর জোরে সমুদ্রকে শান্ত করতেন, পাহাড় পর্বতকে উঠিয়ে যেখানে খুশি নিয়ে যেতেন। রামচন্দ্র মন্ত্রের জোরে শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মধ্যে মানুষ নয় কেবল বানরদের নিয়ে পাথরের সেতু বানিয়েছিলেন। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, টেস্টটিউব বেবি তৈরির প্রযুক্তি তাঁদের জানা ছিল, এই সমস্ত অবৈজ্ঞানিক, অনৈতিহাসিক, আজগুবি বিষয়গুলিকে নানা ভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সিলেবাসে আনার চেষ্টা হয়েছে।
একই সঙ্গে ‘কালচারাল হেরিটেজ ইন ইন্ডিয়া’ পেপারে মেলা, খেলা, উৎসব, রিচুয়াল, কুম্ভমেলা, বৈশাখী মেলা, গুরুপূর্ণিমা, রথযাত্রা, গঙ্গাসাগর, দশেরা, দেওয়ালীর পাশাপাশি নিরপেক্ষতার ভান করতে মুসলমানদের আজমির শরিফ দরগা ও ঈদের কথা আনা হয়েছে। পারফর্মিং আর্ট ইউনিটে ভজন, কীর্তন, হরিকথা, গুরুবাণীর কথা বলে তারা গণতান্ত্রিক দেশকে গুরুবাদের দেশে পরিণত করার সামগ্রিক আয়োজন রেখেছেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা বহু সংস্কৃতির মিলনের মধ্য দিয়ে আজকের ভারতীয় সংস্কৃতির যে বহুত্ববাদী চরিত্র গড়ে উঠেছে সেটা ছাত্রদের সামনে আড়াল করা হয়েছে। বহুধর্মীয় ঐতিহ্যের দেশে সিলেবাস প্রণেতারা কেবল হিন্দু ধর্মের কথা এনে সরাসরি ধর্মীয় আধিপত্যবাদের বিষয়টিকে সামনে এনেছেন। অথচ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষের কেবল হিন্দু চিত্তকে স্বীকার করলে চলবে না। ভারতবর্ষের সাহিত্য, শিল্পকলা, স্থাপত্য বিজ্ঞান প্রভৃতিতে হিন্দু মুসলমানের সংমিশ্রণে বিচিত্র সৃষ্টি জেগে উঠেছে’।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ইতিহাসের এই পরিবর্তনগুলিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তা এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আনা হয়েছে। প্রতিটি পেপারে মুখ্যত ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, আর্ট ও আর্কিটেকচার বিষয়গুলিকে আনা হয়েছে। রাজনৈতিক ঘটনাবলিকে ধর্মীয় মোড়কের আড়ালে বিশ্লেষণ করার মধ্য দিয়ে জনসাধারণের মধ্যে বিভাজনের রেখাটি সহজেই টানা যায় ও শাসকের নির্মম শোষণ, অত্যাচারের বিষয়টিকে আড়াল করা সহজ হয়ে উঠে।
হিটলার ইতিহাসের নাৎসিকরণ করেছিল
আমাদের দেশের ইতিহাসের এই পুনর্লিখনের, ধর্মীয়করণের কারণগুলির উৎস অনুসন্ধানের জন্য আমাদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে জার্মানির শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিশ্লেষণ করতে হবে। ইতিহাসবিদ উইলিয়াম শিরার তাঁর সাড়া জাগানো ‘রাইজ অ্যান্ড ফল অফ দ্য থার্ড রাইখ’ গ্রন্থে হিটলারের শিক্ষানীতির বিশ্লেষণ করে দেখান, কী ভাবে জার্মানিতে নাৎসিবাদকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পাঠ্য বইগুলিকে অত্যন্ত দ্রুত পুনর্লিখিত ও সিলেবাসকে পরিবর্তিত করা হয়েছিল। ইতিহাসকে এত বিকৃত করা হয়েছিল যে সেটা হাস্যস্পদ হয়ে পড়ল। হিটলার ক্ষমতায় আসার পরে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা ১৯৩৫ সালে ‘অ্যানসেস্ট্রাল হেরিটেজ সোসাইটি’ গড়ে তুলেছিল। এদের কাজ ছিল নাৎসিরা যে সব তত্ত্ব আমদানি করেছিল তার সপক্ষে প্রমাণ জোগাড় করা। সেদিন এর জন্য তাদের কোনও বস্তুনিষ্ঠ গবেষণার প্রয়োজন হয়নি। বিভিন্ন কনসেন্টে্রশন ক্যাম্পে গিয়ে মৃত ব্যক্তির মাথার খুলি জোগাড় করে তাদের বর্ণবৈষম্যবাদী তত্তে্বর পক্ষে যুক্তি খাড়া করা হত। সেদিন জার্মানিতে ইতিহাস বিকৃতির জন্য কেবল সিলেবাসের বই পরিবর্তন করে হিটলারের বাহিনী ক্ষান্ত থাকেনি, সমগ্র জার্মানিতে তাদের অপছন্দের বইগুলিকে পুড়িয়ে ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলিকে ধ্বংস করেছিল। আজ আমরা কী দেখছি ভারতে? শুধু কি সিলেবাসের পরিবর্তন করা হচ্ছে? শুধু রবীন্দ্রনাথের, প্রেমচন্দ, মহাশ্বেতা দেবীর রচনাগুলি বাদ দেওয়া হচ্ছে? ইতিহাসবিদদের বইও পোড়ানো হয়েছে। উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানের নাম একের পর এক বদল করে দেওয়া হচ্ছে। এলাহাবাদ, মুঘলসরাই, ফৈজাবাদ প্রভৃতির নাম বদল করে হিন্দু নামকরণ করা হয়েছে। শতাব্দীপ্রাচীন স্থাপত্যকে গায়ের জোরে গুঁড়িয়ে, ক্ষমতার জোরে আইনি বৈধতা দেওয়া হচ্ছে।
জাতীয় শিক্ষানীতির অংশ হিসেবে ইতিহাসের এই সিলেবাস নিয়ে আসার পিছনে আরএসএস সহ হিন্দু সংগঠনগুলির গভীর ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা রয়েছে। সিলেবাসের এই পরিবর্তন সেই পরিকল্পনার অংশ। অটলবিহারী বাজপেয়ীর সময়ে সঙ্ঘ পরিবার বলেছিল তাদের কাছে অর্থমন্ত্রকের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল মানবসম্পদ মন্ত্রক। ঐ সময়ে হরি গৌতমকে ইউজিসি-র চেয়ারম্যানের পদে বসিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস পরিবর্তন শুরু হয়। সেই সময়ে সিলেবাসে পৌরোহিত্য, বাস্তুশাস্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে আসা হয়েছিল। শিক্ষাব্যবস্থার ভারতীয়করণের নামে স্কুল থেকে শুরু করে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে ধর্মীয় অন্ধতা ও কুসংস্কারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। স্কুলে বাধ্যতামূলকভাবে সরস্বতী বন্দনা ও বন্দেমাতরম সঙ্গীত চালু করার প্রস্তাব আনা হয়েছিল। সঙ্ঘ পরিবার ১৯৫২ সালে উত্তরপ্রদেশের গোরখপুর জেলাতে সরস্বতী শিশুমন্দির গড়ে তুলেছিল তাদের ইতিহাস ও দর্শন ছোট থেকে ছাত্রদের মনে গেঁথে দেওয়ার জন্য। সঙ্ঘ সারা ভারতে বাইশ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় আটত্রিশ লক্ষ ছাত্র ও এক লক্ষ ষাট হাজার শিক্ষক নিয়ে (বিদ্যাভারতীয় ওয়েবসাইট, ২০১৯) শিক্ষা ব্যবস্থার ভারতীয়করণ করে চলেছে। সঙ্ঘের ইতিহাস নির্মাণের তাত্ত্বিক সাভারকার ১৯২৩ সালে ‘হিন্দুত্ব’ গ্রন্থে লিখেছিলেন ‘হিন্দুদের কাছে হিন্দুস্তানের স্বাধীনতা কেবলমাত্র তখনই মূল্যবান হয়ে উঠবে যদি সেখানে তাদের হিন্দুত্ব, তাদের ধর্মীয়, জাতীয় এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের নিশ্চয়তা থাকে। নিজেদের দেশ থেকে পালিয়ে এসে এ দেশে আশ্রয় চেয়েছিল যারা কিংবা ভয়ে বা অর্থ ও ক্ষমতার লোভে নিজেদের মহান পথ পরিত্যাগ করে যারা ধর্মান্তরিত হয়েছিল তাদের বংশধর অথবা বর্বর অনুপ্রবেশকারীদের উত্তরসূরি যারা, যাদের পূর্বপুরুষ আমাদের পবিত্রভূমিকে নষ্ট করেছে, পবিত্র মন্দির ধ্বংস করেছে, হিন্দুরা কখনও সেইসব মানুষের সঙ্গে যৌথভাবে দেশের মালিকানা গ্রহণ করতে পারে না। এ দেশ কখনও তাদের দেশ হতে পারে না। যদি তাদের এ দেশে বাস করতে হয়, তবে হিন্দুস্তান যে শুধুমাত্র হিন্দুদের, আর কারও নয়, এই কথা স্বতঃসিদ্ধ বলে মেনে নিয়েই থাকতে হবে।’
সঙ্ঘের দ্বিতীয় প্রধান গোলওয়ালকর বলেছিলেন ‘দীর্ঘ হিন্দু যুগের ইতিহাস হল ভারতের ইতিহাস। সেই হিন্দু যুগ, কখনও তার অবস্থা স্বাধীন ও গৌরবময়। কখনও ভারতীয় স্বাধীনতা ও সম্মানের স্বার্থে বিদেশি আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত। স্বীকার করা হয় না এ সত্যটাও যে, ইতিহাস কাল পরিচিত হয় সে দেশের রাষ্ট্রীয়দের নামেই, রাজারাজড়ার বেশধারী বিদেশি তস্কর ও একনায়কতন্ত্রীদের নামে নয়’ (বাঞ্চ অব থটস)। আরএসএস যে হিটলারকেই তাদের আদর্শ বলে মনে করত তার প্রমাণ মেলে গোলওয়ালকরের লেখাতে, ‘জার্মানদের জাতিত্বের গর্ব আজ মুখ্য আলোচ্য বিষয় হয়ে পড়েছে। নিজেদের সংস্কৃতিকে কলুষমুক্ত করতে জার্মানি গোটা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে সেমিটিক জাতি ইহুদিদের দেশ থেকে বিতাড়ন করেছে। জার্মানি এটা প্রমাণ করেছে যে, নিজস্ব ভিন্ন শিকড় আছে এমন জাতি বা সংস্কৃতি একসঙ্গে মিশে একটি পূর্ণাঙ্গ সত্তা তৈরি করা অসম্ভব। এই শিক্ষা হিন্দুস্তানে আমাদের গ্রহণ করা এবং তার থেকে শিক্ষা লাভ করা প্রয়োজন (ওই)। হিটলারের নীতিগুলিকে সেদিন আরএসএস সমর্থন করেছিল। এই নাৎসি ধাঁচাতেই সংগঠনটি তাদের তাত্ত্বিক ভিত্তিটি তৈরি করেছে।
হিন্দু ধর্মভিত্তিক ইতিহাস লেখবার জন্য সঙ্ঘের শাখাটির নাম ‘অখিল ভারতীয় ইতিহাস সংকলন যোজনা’ যা ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ৩৫০টি প্রকাশনায় সারা ভারতের পাঁচশোর বেশি অধ্যাপক এই ইতিহাস পুনর্লিখন কাজের সঙ্গে যুক্ত। সম্প্রতি এই সংগঠনটির অনুষ্ঠানে গিয়েই মানবসম্পদ বিকাশমন্ত্রী নতুন ইতিহাস চালুর কথা বলেছেন। একই ভাবে সঙ্ঘ ‘ভারতীয় পুরাণ অধ্যয়ন সংস্থা’ নামে নতুন একটি সংস্থা গঠন করেছে ‘পুরাণ অন্তর্গত ইতিহাস প্রকল্প’ লিখতে। সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টোরিকাল রিসার্চ ও ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট-এর অধিকর্তার পদে বসানো হয়েছে।
একইভাবে সঙ্ঘের বিজ্ঞান শাখা ‘বিজ্ঞান ভারতী’ প্রায় তিরিশটি রাজ্যে বিজ্ঞান-দর্শন প্রচারের কাজে নিযুক্ত। ২০১৫ সালের ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে সঙ্ঘের বিজ্ঞান চর্চা ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, অন্ধতাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তার নমুনা প্রকাশ পেয়েছে। সম্প্রতি শিবপুরের আইআইইএসটিতে ছাত্রদের ইন্ডাকসন অনুষ্ঠানে গীতা পাঠের উপরে সেমিনার করা শুধু নয় বেদ বেদাঙ্গ ও পুরাণের উপরে কুইজ প্রতিযোগিতার আসর বসানো হয়েছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরকারি মঞ্চে দাঁড়িয়েই একটি বিশেষ ধর্মের অনুসারী ইতিহাস লেখার ডাক দিচ্ছেন। ঐতিহাসিক স্থানের নাম পরিবর্তন করে একটি জাতির ইতিহাস পরিবর্তন করা যায় না। ‘আমাদের এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, একটি দেশের ইতিহাস হল সেই দেশের জাতীয় স্মৃতি। কারও যদি স্মৃতি লোপ পায় তাতে তাঁর জীবনে যেমন বিপদ নেমে আসে, একইভাবে কোনও দেশের জাতীয় স্মৃতি বা ইতিহাস যদি ভ্রান্ত হয়, তাহলে সেই জাতিরও সমূহ বিপদ।’ সম্প্রতি অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটি আয়োজিত একটি সর্বভারতীয় সেমিনারে বক্তব্য রাখতে গিয়ে দেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রফেসর ইরফান হাবিব এই কথাগুলো বলেছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘কোনও বিষয় নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য ঘটতে পারে, কিন্তু ঐতিহাসিক তথ্য নিয়ে কোনও রকম আপস চলে না।’ তাঁর মতে অতীত সম্পর্কে জ্ঞান হবে সুসংহত ও সঠিক।
ইতিহাস কেবল শাসক, রাজা, সম্রাটদের নয়, সমাজের উৎপাদনের সাথে যুক্ত সাধারণ মানুষেরও। ইচ্ছামতো কোনও ঘটনাকে ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়া যায় না। পাকিস্তান তাদের দেশে ইতিহাস শুরু করেছে মহম্মদ বিন কাসেমের সময় থেকে, যার দ্বারা ঐসলামিক সিন্ধ প্রদেশের জন্ম হয়েছিল। ভারতের ইতিহাসে বর্তমানে পাকিস্তানের ছায়া পড়েছে।’ আমাদের দেশের ইতিহাসকেও এই ভাবে বিকৃত করা হচ্ছে এবং এই পরিবর্তনগুলি সবই করা হচ্ছে ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতি গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়েই। এই বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকতে হবে এবং বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে রক্ষার প্রয়োজনে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।